রবীন্দ্রজগতের মার্গদর্শকেরা

আমার রবীন্দ্রনাথ



আজ বাইশে শ্রাবণ। রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণ দিবস। তাতে অবশ্য, আমার, খুব একটা কিছু আসে যায় না। রবীন্দ্রপ্রয়াণ শব্দটা আপেক্ষিক। আমার কাছে তার অস্তিত্ব নেই। আমার কাছে ‘রবীন্দ্রনাথ’ একটা তত্ত্ব। যে তত্ত্বের যাপন মহামতি গ্যেটে করেছিলেন, মহাপ্রাণ তলস্তয় করেছিলেন, ভাষা আলাদা, ভাব এক। ঈশ্বরের সভাকবি মাঝে মাঝে পৃথিবীতে আসেন। তারা মানুষকে বড় কাছ থেকে দেখেন। তারা সমালোচনা করেন না। আলোচনা করেন। মানুষ তাদের কাছে বিস্ময়ের পাত্র।

অবতারেরা রিবেলিয়ান গোত্রের। তারা নিজেদের অজান্তেই মানব সম্প্রদায়ের অভিমুখ ঘুরিয়ে দেন বটে, কিন্তু তাদের সামনে এলে মনে হয়, আমরা কত দীন-হীন, পাপী-তাপী। কিন্তু তাদের সভাকবিদের সামনে নিজেকে বড়ো মূল্যবান মনে হয়। প্রকান্ড এ বিশ্বে অ্যামিবার মতো ক্ষুদ্রতা নিয়ে যতটা মূল্যবান মনে হওয়া সম্ভব, ততটা। “মনে রেখো, তুমি বঞ্চিত হও নি” – মৈত্রেয়ী দেবীকে লেখা রবীন্দ্রনাথের এ আপ্তবাক্য কোন অবতার ভাবদরদ দিয়ে বলেন নি, বলতে পারেন নি।

আমার জীবনে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব বলে শেষ করা যাবে না। রবীন্দ্রনাথকে একটু অন্য আঙ্গিকে দেখতে বড়ো মন চেয়েছে বলে একটু অন্যরকম সংগ্রহ আমি তিলে তিলে করে চলেছি। সামান্য সংগ্রহ, কিন্তু আমার কাছে এর মূল্য অপরিসীম। মজার ব্যাপার, এর একটা বইও আমার পড়া হয়ে ওঠে নি এখনও। ইচ্ছা আছে, অদূর ভবিষ্যতে বইগুলোকে পড়ার।

আমার চারপাশের কিছু মানুষ আছেন, যারা আমাকে জানেন, আমার রবীন্দ্রপ্রীতিকে জানেন। আজ তাদের কথা বলতে ইচ্ছে করছে। কারণ, এই বইগুলোর পেছনে তাদের অবদান আছে বলেই, নিজেকে, এই বাংলা সিরিয়াল জগতের এক জঘন্য পরিসরে থেকেও, নিজেকে ভাগ্যবতী মনে হয়।

১। জেমস বন্ডঃ যে আমাকে বই থেকে শুরু করে ম্যাগাজিনের জোগান দেয়। সে আমাদের বাড়ীতে খবরের কাগজ দেয় নিয়মিত। আর তলে তলে যোগান দেয় অদ্ভুত সব বই। তার নাম জেমস বন্ড দেওয়ার কারণ? এক, জেমস বন্ড তার প্রিয় চরিত্র। আর দুই, বইদুনিয়ায় জেমস বন্ডের মতোই অদ্ভুত সব বই সে খুঁজে এনে দিতে পারে। এ পর্যায়ে আমাকে সে এনে দিয়েছে তিনটে বই, ‘সুরের বাঁধনে : রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে’, ‘তরুণ রবি : এক প্রতিভার নির্মাণ’ এবং ‘রবীন্দ্রনাথ ও ভিক্‌তোরিয়া ওকাম্পোর সন্ধানে’। প্রথম বইটি আউট অফ প্রিন্ট ছিল। তা সত্ত্বেও কীভাবে সে জোগাড় করে আনল জানি না। দ্বিতীয় বইটি সুধীর কক্করের। অর্ডার দিয়েছিলাম, এবং একবেলার মধ্যেই এনে দিয়েছিল। আর শেষ বইটি নিজে নিয়ে এসেছিল আমার জন্যে, পয়সার কথা বলতে সে বলেছিল, যা প্রায়ই বলে, “তোমার সুবিধা মতো দিও, এসব বইয়ের দাম যে হারে বাড়ছে, পরে পড়লেও এখন জোগাড় করে রাখাই ভালো।” লোকে সোনা জমায় ভবিষ্যতের জন্যে, আমি বই জমাই। আর জেমস বন্ড আমার স্যাঁকরা।

২। পিতাঠাকুরঃ উপার্জন অক্ষম আইবুড়ো কন্যা ঘাড়ের ওপর দিনের পর দিন পড়ে থাকলে মায়ের মনে শঙ্কা জাগে। কিন্তু আমার পিতাঠাকুরের মনে কোনদিন তার লেশমাত্র দেখি নি। বরং ধারেকাছে আমি থাকলে তিনি বেশ আনন্দেই থাকেন। মাঝে মাঝে ওষুধটা এগিয়ে দেওয়া; কিম্বা কাঁচা জামা-কাপড় পাট করে আলনায় রেখে দেওয়া; বা চশমাটা ভালো করে ধুয়ে, তারপর মুছে পরিস্কার করে রাখা, চমকে ধমকে কিম্বা আলগোছে একটু বাক্যালাপ --- এর বেশি কিছু চেয়েছেন কি? মনে তো পড়ে না। যদিও, রোগশয্যার পাশে আমি থাকলে সুখী হন, কিন্তু মা থাকলে শান্তিতে থাকেন। সেই মানুষটা অনেকদিন আমার ভ্যানিটি ব্যাগে হাত দিয়েছেন আমার অজান্তে। যার ফলে আমার কখনও টাকার অভাব হয় নি। আমিও জানি, তিনিও জানেন। কিন্তু আমরা পরস্পরকে কিছুই বলি না। যেন এটা আমার স্বাভবিক প্রাপ্য, আর ওটা তার খুশির প্রকাশের মাধ্যম। তিনি না থাকলে কোন বই-ই আমার পক্ষে কেনা সম্ভব হত না। এই বইগুলোও না।

৩। অলোক কাকুঃ যে আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল আমার তিন বছর বয়সে, কিন্তু নিজের স্ত্রীরত্নটিকে হারানোর বিনিময়ে নয় বলে আমি তার প্রেমিকা হয়েই রয়ে গেলাম। তিনি আমার পড়াশোনার গাইড। লাইব্রেরিয়ান অলোক কাকুর জন্যে এমন অনেক বইয়ের সন্ধান পেয়েছি, যা ভাবাও যায় না। আধা মফস্বলে থাকার যন্ত্রণা ঘুচিয়ে দিয়ে একের পর এক মণিরত্নের সন্ধান সে দিয়েছে। এখনও দেয়। এই বুড়ো একবার গিয়েছিল শান্তিনিকেতনে। সেখান থেকে আমার জন্যে নিয়ে এসেছিল মার্টিন কেম্পসেনের ‘অনুভবে অনুধ্যানে রবীন্দ্রনাথ’ বইটা। এই জার্মান সাংবাদিকটি শান্তিনিকেতনে থেকে বাংলা ভাষা শিখেছিলেন রবীন্দ্রপ্রেমে। এনার নামও শুনিনি কখনও, কিন্তু অলোক কাকু শুনেছিল।

৪। আমার হতভাগাঃ সে বেচারা পড়তে ভালোবাসে না একদম। কিন্তু তার ওপর আমার দাপট যে কি পরিমাণ বেশি সে বলার অপেক্ষা রাখে না। আমার বই প্রয়োজন, অর্থ নেই, পিতাঠাকুরকে বলা যাচ্ছে না, এমতাবস্থায়, আমার হতভাগা সম্বল, “ওরে ব্যাটা, বিয়ে করব তোকে, আমার ভাত-কাপড়ের দায়িত্ব নিবি তুই, আর তার আগে নেট প্র্যাকটিশ করবি না!” এতএব, দে বই কিনে দে, এই হল তার লিস্ট। এমন অনেক বই, বিশেষ করে আমাজন থেকে যেগুলো অর্ডার করাই একমাত্র পন্থা, সেগুলোর সে উদ্ধারকর্তা। তার পাসওয়ার্ড সে আমাকে দিয়ে রেখেছে। আমি যত খুশি বই অর্ডার করতে পারি এখন। সে জিজ্ঞাসাও করে না। বরং অর্ডার দিলে মনে মনে খুশিই হয়, যদিও, মুখে উলটো কথা বলে। সে-ই আমাকে দিয়েছিল Tagore & Gandhi, রুদ্রাংশু মুখার্জীর এই বইটা এক পয়লা বৈশাখের উপহার।

৫। গডব্রাদারঃ আমার হারানিধি, আমার জিগরের টুকরো, কলিজার আধা, দিলের খুন, চোখের রোশনাই, আমার জান-এ-মন্‌... আমার গড্‌ব্রাদার, আমার পিসতুতো দাদা। সবচেয়ে নীরবে, সবচেয়ে নিশ্চুপে যে আমাকে রবীন্দ্রনাথের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে, অদ্ভুত যত বই সে-ই আমাকে এনে দিয়েছে। যোগাড় কীভাবে কোথা থেকে করেছে, আমি জানি না, কিন্তু বইগুলো নাড়াচাড়া করি আর অবাক হই, খোঁজ পেল কি করে? জেমস বন্ডকে একবার একটা বই আনতে দিয়েছিলাম। ফেল করেছিল। বলেছিল, এ বই কলেজ স্ট্রীটে পাওয়া যায় না। তোমার দাদা এ বই পেল কি করে! কি করে পেলি রে, আমার স্যমন্তকমণি? সে মিটিমিটি হেসে উত্তর দিয়েছিল, “তোর আম খাওয়া দরকার আম খা, অত পাতা গোনার দরকার কি? আর শোন, এসব বই কিন্তু হাতছাড়া করিস না, আমি আর জোগাড় করে দিতে পারব বলে মনে হয় না।” সে দিয়েছিল তিনটে বই - ‘বিশ্বহৃদয় পারাবারে’, ‘রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কয়েকটি প্রহর’ এবং ‘স্প্যানিশ ভাষায় রবীন্দ্রনাথ’। বইগুলোতে হাত বোলাতে বোলাতে মনে হয়, তার হৃদয়ে যদি আমার হৃদয় মেশাতে পারতাম!

      তো এই হল ব্যাপার স্যাপার। রবীন্দ্রপ্রেমিক যেখানে আমার আশেপাশে, সেখানে বাইশে শ্রাবণ উদ্‌যাপন করা সাজে? মোটেই না। বরং এই বইগুলোর খবর আপনাদের সাথেও শেয়ার করা যায়। আর মূক বালিকার মাতৃভাষায় লেখা খানকতক শিশুতোষ শব্দে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা যায়...

      আমি তাই করি, তাই করে চলি...

=================

১। সুরের বাঁধনে : রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে – চিন্ময় গুহ – পরম্পরা – ১৫০/-

২। তরুণ রবি : এক প্রতিভার নির্মাণ – সুধীর কক্কর – দে’জ, থীমা – ২৯৯/-

৩। রবীন্দ্রনাথ ও ভিকতোরিয়া ওকাম্পোর সন্ধানে – কেতকী কুশারী ডাইসন – দে’জ – ৫০০/-

৪। Tagore & Gandhi – Rudrangshu Mukherjee – Aleph – 699/-

৫। অনুভবে অনুধ্যানে রবীন্দ্রনাথ – মার্টিন কেম্পসেন – কারিগর – ৪০০/-

৬। স্প্যানিশ ভাষায় রবীন্দ্রনাথ – তরুণ ঘটক – ক্যাম্প – ১৮০/-

৭। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কয়েক প্রহর – পাওল নাটোর্প – দেবব্রত চক্রবর্তী – ৪০০/-

৮। বিশ্বহৃদয় পারাবারে – মোরিৎস ভিনটারনিৎস – সিগনেট প্রেস – ৫৫০/-

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে