কিরিয়েস্তামি চতুর্বিংশতি

 



      সিনেমায় কি কবিতা বলা যায়?

হ্যাঁ যায়।

অনেক পরিচালক সিনেমায় কবিতা বলেছেন। ক্যামেরাকে ব্যবহার করেছেন। চরিত্রদের মধ্যে ছন্দ এনেছেন। ভাষায় কব্যিক সুষমা এনেছেন। গল্পে সুররিয়েলিজম এনেছেন। সিনেমাটোগ্রাফিতে রঙের বাহার এনেছেন। কিম্বা সুরের মায়াজালে কবিতার দ্যোতনা মিশিয়েছেন।

কিন্তু...

যদি এমন হয়, ক্যামেরা স্থির। মানবচরিত্র প্রায় অনুপস্থিত, থেকেও না থাকার মতো। ভাষা নেই। গল্প নেই। রঙের ব্যবহার নির্দিষ্ট। সুরের একটা নির্দিষ্ট গৎ আছে। তাহলে?

তারপরেও কি কবিতা বলা যায়?

যায়।

একটা না। দুটো না। টানা ২৪টা।

কবির নাম আব্বাস কিয়ারোস্তামি।

তার ক্যামেরা স্থির ফ্রেম ধরে রাখে। এবং সেই স্থির ফ্রেম কখন যেন নড়েচড়ে উঠতে থাকে। প্রকৃতি কবি হয়ে যায়। লিখে যায় মায়াকাব্য। প্রকৃতি সুর সৃষ্টি করে। কাব্য গান হয়ে ওঠে। এমনিভাবেই ছোট ছোট, পাঁচ-ছয় মিনিটে এক-একটা কবিতা রচনা করে প্রকৃতি। আব্বাস কিয়ারোস্তামি তা দেখেন। কেবলমাত্র দর্শকের মতোই প্রকৃতির কবিতা শোনেন। ক্যামেরায় রিলবন্দী হয়। আমরা দেখি। কোলাজের মতো করে... একটার পর একটা। ২৪টা দৃশ্যপট। ২৪টা কবিতা। ২৪টা মায়াজগৎ।

সমস্ত ফ্রেম স্থির। তার মধ্যেই কখনও কখনও চলেফিরে বেড়ায় চরিত্রেরা, প্রাণীরা। যেন খুব সাদামাটা, দৈনন্দিন, আটপৌড়ে তাদের চলন। আর তারপর, সমস্তটা মিলে... তৈরী হয়...

কবিতা, কবিতা আর কবিতা।

*       *       *       *       *

Frame 1: একটা পেইন্টিং। তুষারদেশের অধিবাসীরা ঘরে ফিরছে। তাদের পেছনে কুকুরেরা। পাখী উড়ছে। দূরে তাদের ঘরবসত। হঠাৎ করে যেন ছবি নড়ে ওঠে। কখনও পাখীরা উড়ে আসে। কখনও ঘরের চিমনী থেকে ধোঁয়া বের হয়। কখনও একটা কুকুর চলমান হয়। তৎকালীন দৈনন্দিন সমাজ জীবনের প্রতিচ্ছবি। কিন্তু, ছবি... ছবিই থাকে।

Frame 2: চলন্ত গাড়ী থেমে যায়। জানলার কাঁচ নেমে আসে ঈষৎ। বরফপড়া সন্ধ্যায় গাড়ীর জানলার ফ্রেমে ধরা দেয় দুই ঘোটক-ঘোটকী। বরফ বৃষ্টিকে তুচ্ছ করে, মানুষের উপস্থিতিকে তাচ্ছিল্য করে তারা নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত, মত্ত। প্রেম এমনিভাবেই কি সমস্ত দুনিয়াকে তুচ্ছ করে?

Frame 4: বরফাবৃত মাঠ। দূরে বনবিথীকা। হরিণের পর হরিণ চলে যায়। হঠাৎ... একটা গুলীর আওয়াজ। হরিণের দল দ্রুত পা চালায়। থেকে যায় একটা হরিণ। তার উৎকন্ঠিত শারীরি ভাষা বন্দুকের নির্ঘোষের দিকে। পথ ধরে এগোয়, পিছোয়। ইতস্তত... সে ফিরে আসবে তো? সময় বয়ে যায়... হরিণের দল চলে যায়... হরিণটা অপেক্ষায় থাকে... সে ফিরছে কি?

Frame 5: বরফাবৃত ঝোপ। ঘন ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে এক হরিণ। ঘাস খেতে শুরু করে। ইতিউতি দেখে। তার পাশ দিয়ে ফিরে যায় হরিণের দল। তাকে ডাক দিয়ে যায়। হরিণটি খেতে ব্যস্ত। বন স্তব্ধ হয়ে যায়। পাখী উড়ে যায়। নিঃশব্দ পত্রপুটে কোন আওয়াজ নেই। কেবল মাঝে মাঝে নেকড়ের ডাক, পাখীর ওড়ার ঝাপট। হরিণ ইতিউতি চায়, অতঃপর নিশ্চিন্তে খেতে থাকে। হঠাৎ, একটা আওয়াজ, হরিণ ঝোপে ঢুকতে চায়, নিরাপদ হতে চায়। আর সেখানে থেকেই বন্দুকের নির্ঘোষণা। মৃত্যু কখন যে কোথা থেকে অতর্কিতে ছুঁয়ে গেল, জানতেও পারল না...

Frame 10: বরফাবৃত পত্রহীন বৃক্ষের তলে একঝাক ভেড়া, গোল হয়ে, মাথাগুলোকে তারা গুঁজে দিয়েছে গাছের কাণ্ডের সাথে। আনত, প্রণত, অবনত। বিরামহীন তুষারপাতের মাঝে জাগ্রত এক কুকুর, তাদের রক্ষক। মাঝে মাঝে নেকড়ের ডাক তাদের চমকিত করে দিলেও, কুকুরের ভয়ে মাথা তুলতে পারে না, পালাতে পারে না, বিদ্রোহ করতে পারে না। এমনিভাবেই চলে সমাজ, এক মৃতপ্রায় আদর্শের কাছে তাদের মাথা বন্ধক রেখে, গর্জনরত কুকুরভক্তের প্রহরায়...

Frame 15: ওরা আইফেল টাওয়ার দেখছে। ওরা ছয়জন। পথ দিয়ে চলে যায় কত লোক। কাজের লোক, অকাজের লোক, কৌতুহলী লোক, উদাসীন লোক। ওরা তবুও... স্থির। আইফেল টাওয়ার দেখছে। রাত হয়, টাওয়ারে আলোর রোশনাই, আকাশ জুড়ে তুষারপাত, ঠান্ডা, গান গেয়ে চলে যায় গাইয়ে... তার মাঝে... ওরা জাঁকজমক দেখছে, দেখছে উল্লাস, দেখছে সমাজের চুড়ান্ত উন্মামাদকতা... স্থির হয়ে। ওরা আইফেল টাওয়ার দেখছে। দেখছে, দেখছে... দেখেই চলেছে...

Frame 22: সমুদ্রতীরে একটা পতাকা, দাঁড়িয়ে, পতপত করে উড়ছে। তার কোলে এক পাখী। একটা কুকুর, কোথা থেকে এল ধেয়ে। উন্মত্ত চীৎকারে তার অভিযোগ যায় না বোঝা। পাখীটা উড়ে যায়। একা দাঁড়িয়ে থাকে পতাকাটা। কুকুর চলে যায়। আবার ফিরে আসে। উন্মত্ত চীৎকার করে পতাকাটার দিকে তাকিয়ে। চলে যায়। আবার ফিরে আসে। প্রবল তিরস্কারে জর্জরিত পতাকা এবার পড়ে যায়। কুকুর নিশ্চিন্ত হয়ে চলে যায়। সমাজ, পরিবার, পরিজন কি এইভাবেই প্রথমে আত্মবিশ্বাস কাড়ে, আর তারপর মানুষটাকে...?

*       *       *       *       *

প্রেম, মৃত্যু, ঈর্ষা, দ্বেষ, আনন্দ, হাসি, কান্না, বন্দীদশা, কিম্বা মুক্তপ্রাণতা --- সমাজের এক-একটা দিক ধরা দেয় কিয়েরোস্তামির চোখে। ব্যপকহারে বনধ্বংস কিম্বা কাজের চাপে সম্পর্কের বিনষ্টতা থেকে ধূসর ক্লান্তি থেকে একাকীত্বতা --- ফ্রেমে ধরা পড়ে কত শত বিষয়। জালের প্রাচীরে বন্দী বিহঙ্গ কিম্বা অলস সময়ধারা বেয়ে ঘুমিয়ে থাকা গরু --- সব উঠে আসে স্থির ফ্রেমের অস্থির কোলাজে। ঘরের জানালা, সমুদ্রের তীর কিম্বা তুষরধবল বনভূমি --- তার ফ্রেমে হয়ে ওঠে বাঙময়।

মাঝে মাঝে আমার ক্লান্তি আসে। প্রায় একই ভাষার ব্যাবহারে উঠে আসে মৃত্যু [F5 & F13], প্রণয় [F6 & F7] কিম্বা উদাসীনতা [F3, F19, F12]। একই বিষয়কে অন্য আঙ্গিকে দেখিয়ে ক্লান্ত করে তোলেন তিনি। আবার পরপর নৈঃশব্দের ক্লান্তির মধ্যে কি অপূর্ব সুরমূর্চ্ছনা আনেন Frame 21-এ! কিম্বা একঘেয়ে সাদা-কালোর মহিমা থেকে বেরিয়ে রঙীনে এসে নীলের প্রেক্ষিতে অসংখ্য ভাঙা তক্তার ঢিপির ওপর বসে গলা ফাটিয়ে চীৎকারে সাবধান করে দিতে থাকা পাখীর চোখ দিয়ে শোনা যায় কাঠ চেরার শব্দ, দেখা যায় গাছের পতন। নীলাকাশে নীল মৃত্যুর পটভূমিকায় অবশেষে পাখিটা হারিয়ে যায়...

স্থির ফ্রেম কত কথা বলে! কত কথা বলতে পারে!

“I have often notice that we are not able to look at what we have in front of us, unless it’s inside a frame.” বলেছেন কিরিয়েস্তামি। সত্যিই তাই... সত্যিই কি তাই?

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে