চেনা ছকে এক অচেনা গাঢ় শঙ্খ
বিভিন্ন
সময়ে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়া কিছু লেখার সংকলন এই বইটি ‘ঘুমের দরজা
পেরিয়ে’, ‘হে অনন্ত নক্ষত্রবিথী’ এবং ‘চিলেকোঠার উন্মাদিনী’ বইত্রয়ের উত্তরাভাস।
এখানেও উঠে এসেছে একইভাবে বিভিন্ন সাহিত্যিকের, বিশেষত কাজগুলো, যার
অধিকাংশই ফরাসী। এবং অনেক ব্যক্তিরই প্রকারান্তরে পূর্বোক্ত বই তিনটেতে সরাসরি
কিম্বা অ-সরাসরি আভাস থাকার ফলে পড়তে খুব বেশি বেগ পেতে হয় না।
কিন্তু, এই
বইয়ের সার্থকতা কোথায়? এই বইতে আমি একটা বড়ো শিক্ষা পেলাম, কীভাবে অতি নম্র হয়ে
কোন লেখার, তা সে যতই প্রতিভাবান লেখক হোন না কেন, সত্যের খাতিরে, যা তিনি অনুভব
করেছেন, তাকে প্রকাশ করতে হয়।
ব্যাপারটা
খুলেই বলি।
এই বইয়ের
একটা মজার ব্যাপার হল, অনেকগুলো লেখাই প্রকারান্তরে বইয়ের রিভিউ। এর মধ্যে
বুদ্ধদেব বসুর ‘বোদলেয়ারের অনুবাদ’, যা বাংলা অনুবাদ
সাহিত্যে একপ্রকার কিংবদন্তী কাজ বলে ধরা হয়, তার কঠোর
সমালোচনা, চিন্ময় গুহের সুযৌক্তিক প্রণিধানের ফসল।
“বুদ্ধদেব বসুর মতো সত্যিকারের সাহিত্যবোদ্ধা এমন কথা প্রকাশ্যে উচ্চারণ করলেন
কেন? তাঁর গভীর শ্রমে করে তোলা কাজটির প্রধান ঘাটতি ঢাকতে চাইলেন বলে?” --- এমন
দুটি বাক্য লিখতে গেলে যে পরিমাণ সাহস, শ্রদ্ধা এবং নিজের ওপর আত্মবিশ্বাসের
প্রয়োজন হয়, সেটাই তাকে ‘চিন্ময় গুহ’ বানিয়েছে। অথচ সম্পূর্ণ প্রবন্ধটা পড়বার পরে
একটা বড়ো প্রশ্নসূচক চিহ্নের সামনে যে অনুবাদ সাহিত্য এসে দাঁড়ায়, সেই প্রশ্নের
সামনে দাঁড়ানোটা এই মুহূর্তে বেশি করে প্রয়োজন, বিশেষত প্রতিবেশী রাষ্ট্রের
অনুবাদের বহর দেখার পর।
এই
বইকে চারটি পর্বে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম পর্বে বিভিন্ন বইয়ের রিভিউ করা প্রবন্ধগুলো
বেশি দেখা যায়। কিন্তু তা অতি যত্নসহকারে। চিন্ময় গুহ রিভিউ করতে গিয়ে তীব্র বাদানুবাদে
লিপ্ত হওয়ার অবকাশ দিলেও তা কখনও শালীনতার সীমা ছাড়ায় না, বরং আলোচনার বিষয়বস্তুয়
হয়ে ওঠে। এ শেখার মতো এক বিষয় বটে।
ইদানীং, সৎ রিভিউ করতে গিয়ে এক ধরণের মন্তব্যের সন্মুখীন হতে হয়,
যার মূল বক্তব্য হল, নিজের লেখার / সিনেমা বানানোর তো মুরদ নেই, এতএব সমালোচনা
করার নামে যা-তা লিখে শিল্পীদের দুঃখ দেওয়ার ফ্যাশানটা এবার বন্ধ হোক। ফলে অনেক
রিভিউকার শুধুমাত্র সুখস্রাব্য বানানো কতকগুলো কথা লিখে প্রকারান্তরে বিজ্ঞাপন করে
পাঠক-পাঠিকাদের বিভ্রান্ত করেন, অথবা নিজের পিঠ বাঁচান। এই সমস্ত সমালোচকেরা জানেন
না, একটা বইয়ের কিম্বা সিনেমার সঠিক রিভিউ পাঠক বা দর্শকদের মনোমত বই চিনে নিতে
কতটা সহায় হতে পারে। সৎ রিভিউ একটা প্রোপাগান্ডাকে ধরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে,
সস্তা শিল্পের চটকদারিতাকে চিনিয়ে দেয়, অসাধারণ নির্মাণের সাথে পরিচয় ঘটায়।
শিল্পের নবতম পথনির্দেশের সহায়কও কোন কোন ক্ষেত্রে হয়। তারা ইতিহাস জানেন না,
কিম্বা জানলেও ভুলে গেছেন।
চিন্ময় গুহ
এই পর্বে প্রকারান্তরে সমালোচনার পর সমালোচনা করেছেন, গঠনগত সমালোচনা, যা অনেক
ক্ষেত্রেই বিতর্কের আভাস রাখে, কিন্তু, এতদ্সত্ত্বেও, অনেক ক্লাসিক সাহিত্য এবং
অজানিত প্রশ্নচিহ্নের সন্মুখে দাঁড় করিয়ে আমাদের একপ্রকার ঋদ্ধই করেন। অবশ্য এ
অন্য কথা যে, কয়জন আর ওই ধরণের মন্তব্যকারী পাঠক-পাঠিকা মন দিয়ে এই লেখাগুলো পড়েছেন,
বিশেষত ফরাসী সাহিত্যের প্রতি অগ্রসর হয়েছেন, কিম্বা বই কিনে পড়েছেন? এই ধরণের মন্তব্যকারীর
অধিকাংশই ভক্তকূল। আর ভক্তকূলের সমস্যা হল, তেনারা কোন কিছু তলিয়ে ভাবেন না। তেনারা
উগ্রভাবে বিরোধিতার বিরোধী হয়ে আক্রমণ করেন মাত্র।
চিন্ময় গুহের এই বইতে অনুবাদের দিক থেকে একটা বিশাল প্রশ্নচিহ্নের
সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। “আমার ধারণা, স্বাধীনতা-পরবর্তী ষাট বছরে বাঙালী মানসে
ক্রমশ এই বিকল্প ভাষ্যের অনুসন্ধানের প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়। দুশো বছরের কাছাকাছি
ইংরেজ ও তার বচনের সঙ্গে সচেতন ও অবচেতন সংঘাতের ফলে একদিন অন্যমনে খোলার চেষ্টা
করা হয়েছিল যে দূরের জানলা তা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে।” বিকল্প ভাষ্য অর্থে ইংরাজী
ভিন্ন অন্য ভাষার সরাসরি অনুবাদ, যা অনেক বেশি মৌলিকের অনুগামী, তার কথা বলা হয়েছে।
সত্যিই তো তাই। দুই বাংলায় আমেরিকা-ইংলন্ড ভিন্ন অন্য কোন দেশের লেখার যে অনুবাদ,
তার অধিকাংশই অনুবাদের অনুবাদ, অর্থাৎ ইংরেজী অনুবাদের থেকে অনুবাদ। সেই অনুবাদ
কতটা সার্থক তা জানার উপায় নেই। কতটা প্রোপাগান্ডা, তা বোঝার উপায় নেই। ফ্রেঞ্চ,
স্প্যানিশ, জার্মানী, জাপানী কিম্বা রাশিয়ান বা তদনুরূপ অন্যান্য ভাষা বিশারদ
বর্তমানে খুবই কম। এবং তাদের মধ্যে অনুবাদক আরও কম। ফলে যে অনুবাদ আমরা পড়ছি তা
কতটা যুক্তিযুক্ত, তা আদৌ সঠিক কি না, তার পর্যালোচনা করা আশু দরকার। চিন্ময় গুহের
‘বিকল্প ভাষ্যের সন্ধানে’ নামক প্রবন্ধ এবং তারপরেই ‘বুদ্ধদেবের ‘বোদলেয়ার’: পাঁচ
দশকের দূরত্ব থেকে’ প্রবন্ধ দুটি, এবং তৎপরবর্তী বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ গভীর পরীক্ষা,
পর্যবেক্ষণ ও সিদ্ধান্তের ফসল।
দ্বিতীয় পর্বের প্রথম দুটি প্রবন্ধ অভিনব। ‘এক পশলা চিঠি’ প্রবন্ধটি
আসলেই কিছু সাধারণ, অসাধারণ, চমকপ্রদ এবং বিতর্কিত চিঠি। এই পর্বের দ্বিতীয়
প্রবন্ধটা আমার কাছে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ – কারণ রবীন্দ্রনাথ। রাণু-রবীন্দ্রনাথ
সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে (মূলত চিঠিপত্র ১৭তম খন্ড) একটা অসাধারণ কথা
লিখেছেন, “আজকের ভিন্ন পরিবেশে উপসংহার-মুখি অতি-পাঠকেরা ভুল মানে করে ফেলবে এই
মধুর সম্পর্কের, এমন আশঙ্কা ছিল অবশ্য। আর অতি-পাঠকের মুশকিল হল তাঁরা অতি-পাঠকই,
পাঠক নন, যা মুহূর্তের মধ্যে নষ্ট করে দিতে পারে যে-কোনও পাঠের মতো
রবীন্দ্র-পাঠেরও প্রেক্ষিত।” এমন অতি-পাঠক এবং অতি-লেখক (তিনি অবশ্য এর উল্লেখ
করেননি) সাহিত্য জগতের ক্ষেত্রে আশঙ্কাজনক পিছল অন্ধকার পথ, যা নিমেষেই একজন
মানুষের মনে কালো কালিমা ঢেলে তার মানসিকতাকে বিনষ্ট করতে পারে।
তৃতীয় পর্বে আবার ফিরে গেছেন সমালোচনায়। এখানে কাফকা, ব্রাত্য বসু
নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি একহাত নিয়েছেন গ্যুন্টার গ্রাসকে, যা আমার কাছে বুদ্ধদেব
বসুর চাইতে কোন অংশে কম মনে হয় নি। তবে, এই পর্যায়ের সেরা লেখা ‘এদগার পো ও কবিতার
ভাষা’। এদগার পো-এর অন্য রূপ, যা নিজ দেশে কঠোর সমালোচনা, অথচ
বহির্বিশ্বে, বিশেষত ফ্রান্সে, কাব্যভাষার নব পথিকৃৎ হিসাবে মাথায় তুলে নেওয়ার
তুলনামূলক আলোচনা বিস্মিত করে।
চতুর্থ পর্বে একটাই প্রবন্ধ। দেশ কিম্বা বিদেশে থিয়েটার এবং তার
রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ নিয়ে যে বিপুল প্রতিস্পর্ধার নির্ঘোষ তা নিয়ে আলোচনা। তবে এই
পর্বগুলোর সার্থকতা কি তা নিয়ে একটা প্রশ্নচিহ্ন রয়েই গেল। ‘পূর্বভাষ’-এ এর কোন
সার্থক ব্যাখ্যা নেই। শঙ্খ ঘোষ ঠিক কি আঙ্গিকে এমন সূচিপত্র সাজালেন, তা খোলসা
করলে ভাল লাগত।
এই বইটা পড়তে পড়তে চিন্ময় গুহের সততা নিয়ে শ্রদ্ধা জেগে ওঠার
পাশাপাশি, তার চিন্তার সীমাবদ্ধতাগুলোও সামনে চলে আসছে, নেতিবাচক অর্থে নয়। এই
পর্যায় থেকেই আমি বুঝতে পারছি, তিনি কি লিখবেন, কতটা লিখবেন, কেমন লিখবেন, বিশেষত
ফরাসী সাহিত্য নিয়ে। হ্যাঁ, এর সাথে কয়েকটি নতুন বইয়ের তথ্য মিলবে, যা অতিরিক্ত লাভ।
চিন্ময় গুহের ওই একটিই কঠোর সমালোচক রূপ ছাড়া আর সমস্তই পূর্বোক্ত তিনটি বইয়ের
প্রতিধ্বনিমাত্র। ফলে এই বইতে ‘গাঢ় শঙ্খ’ ওই একটি বিষয়ের ওপরেই নিরূপিত বললে খুব
একটা ভুল বলা হবে না।
=============================
গাঢ় শঙ্খের খোঁজে ও অন্যান্য
প্রবন্ধ
চিন্ময় গুহ
আনন্দ পাবলিশার্স
মুদ্রিত মূল্যঃ ২৫০ টাকা
ছবি কৃতজ্ঞতাঃ সমর্পিতা
Comments
Post a Comment