ফরাসী সাহিত্যের স্রোতধারায়
“উচ্চভ্রূ নয়,
সাধারণ পাঠকের জন্য বিভিন্ন সময়ে রচিত এই নির্বাচিত প্রবন্ধগুলি একসঙ্গে প্রকাশিত
হলে সেটা কারুর কাজে লাগতে পারে মনে করেই এই বইয়ের পরিকল্পনা। চুরমার হতে থাকা
আজকের এই পৃথিবীতে এগুলির মধ্যে কোনও গোপন অন্তঃসূত্র পাওয়া যাবে ভাবতে চাই।”
শ্রীযুক্ত চিন্ময় গুহের কাছে আপামর
বাঙালী পাঠকসমাজের কৃতজ্ঞ থাকা উচিৎ। এই নিয়ে আমি ওনার তৃতীয় বইটি পড়লাম। বই না
বলে ‘ছাত্রবন্ধু’ বলা ভাল। ফরাসী সাহিত্যের যত দিকপাল আছেন তাদের অধিকাংশই তার
হৃদয়ের আতশকাঁচে যেভাবে ধরা পড়েছে, তাকেই নিজের আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে আমাদের
কাছে মেলে ধরেছেন।
‘ছাত্রবন্ধু’ই বটে। না হলে তো আমি
জানতেই পারতাম না, রবীন্দ্রনাথের ‘গীতাঞ্জলী’ ফরাসীতে অনুবাদ করেন স্বয়ং আদ্রে
জিঁদে! আমি জানতে পারতাম না রম্যাঁ রল্যাঁ শুধু তার অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে ফরাসী
সাহিত্য তথা বিশ্বসাহিত্যে কী অসামান্য প্রভাব রেখেছিলেন, শুধু তাই না, তিনি ভারত
প্রেমিকও ছিলেন। আমি জানতে পারতাম না, সার্ত্রে শুধুমাত্র অস্তিত্ববাদের জনক নয়,
সমগ্র ফরাসী ইন্টালেকচুয়াল তথা বিশ্বদর্শনের নবরূপকার আক্ষরিক অর্থে তার
জীবদ্দশাতেই মহান পথিকৃৎ হয়ে পড়েছিলেন।
চিলেকোঠার উন্মাদিনী’র এই লিখন
পর্যায়টিকে বেশ কয়েকটা ভাগে ভাগ করা যায়। যার প্রথম শুরুই হয়েছে ‘আত্মহত্যা’
বিষয়টাকে কেন্দ্র করে। এই আত্মহত্যা পর্যায়ক্রমে ভিভিয়েন এলিয়ট হয়ে কখন যেন ঢুকে
পরে টি এস এলিয়টে। পরের পর প্রবন্ধ টি এস এলিয়টকে ঘিরে। কিন্তু, এখানে ‘ঘুমের দরজা
ঠেলে’ কিম্বা ‘হে অনন্ত নক্ষত্রবিথী’-র সেই লিখন মাধুর্যতা সম্পূর্ণ অনুপস্থিত।
উক্ত দুটো গ্রন্থে পাঠকের সাথে সংযোগ স্থাপনের যে দায় নিয়ে লিখেছিলেন, এ পর্যায়ে
কোথাও তার লেখা নিষ্প্রাণ লাগে। তথ্যে ভরপুর এই লেখাগুলো যে কোন কলেজ স্টুডেন্টদের
নোট্সের মতো মনে হয়। যদিও তার লেখার গভীরতা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই।
লা রোশফুকো, গুস্তভ ফ্লবের কিম্বা
ওগ্যুস্ত্যাঁ ওসাঁ পেরিয়ে যখন জর্জ সাঁদে-তে এসে ঢুকলেন, তখন মনে হল যেন তার
পুরোনো সত্ত্বাটা আবার ফিরে আসছে। এবং মলার্মে থেকে সেই যে নিজের ফর্মে ফিরলেন, আর
পিছনে ফিরে তাকাতে হয় নি। এর মাঝে ‘স্বপ্নের কারিগর’ এক অসামান্য লেখা। জাঁ
আনুই-এর নামই শুনিনি, অথচ ফরাসী সাহিত্যে তার কি মহাসাগরীয় অবদান!
আমি সত্যি অর্থে গোগ্রাসে গিলতে
শুরু করলাম যখন ‘সার্ত্রে’ পর্ব শুরু হল। ‘আয়না ভাঙতে ভাঙতে’ শীর্ষক প্রবন্ধ থেকে
সার্ত্র এবং তৎপরবর্তী রম্যাঁ রল্যাঁ সম্পর্কিত চারটি প্রবন্ধ। সেই সাথে তিনি
যুক্ত করেছেন পরিশিষ্টে দুটো গুরুত্বপূর্ণ চিঠি। আমার সমস্যা হচ্ছে, আমি এনাদের
নাম শুনেছি, কিন্তু কাউকেই আমার পড়া হয়ে ওঠে নি। চিন্ময় গুহ কৌতুহল তৈরী করতে
পারেন। কৌতুহল থেকে প্রবল কৌতুহল তৈরী করে সার্ত্রে এবং রম্যাঁ রল্যাঁ-র লেখা
খুঁজতে বাধ্য করছেন আমাকে। আমি চাইছি লক্ষ্মী মেয়ের মতো বইগুলো জোগাড় করে পড়ে
ফেলতে। এমনটা করানোর ক্ষমতা চিন্ময় গুহের লেখায় আছে। কিন্তু, জানি না, কতটা আমি
কতদূর এগোতে পারব। আমাদের এখানে বইয়ের এবং যথার্থ অনুবাদের বড়ো অভাব, শুধু তাই নয়,
দিগ্দর্শী পাঠকও অপ্রতুল।
অনুবাদ বলতে মনে পড়ল, এখনকার লেখক-প্রকাশকেরা
তার এই পর্যায়ের ‘বাংলা অনুবাদের সমস্যা’ শীর্ষক প্রবন্ধটি পড়েছেন কি? সলমন রুশদীর
‘মিডনাইটস্ চিলড্রেন’ পড়তে পড়তে আমি যে কি অসহায়তা বোধ করছিলাম তা উক্ত বইটির
রিভিউতে বলেছি। আজ একই কথা পড়লাম চিন্ময় গুহের লেখায়। বাংলা সাহিত্যকে অন্ধকার
থেকে অন্ধকারে ঠেলে দেওয়ার দায় থেকে আজকের অনুবাদক-প্রকাশকেরা পরবর্তী প্রজন্মের
পর প্রজন্ম ধরে বইতে পারবেন তো? জানি একথা তারা বলতে পারেন যে, মরে গেলে আর কে কার,
কিম্বা বর্তমানের কত না কত সমস্যার জটাজাল! কিন্তু যে শ্রদ্ধায় চিন্ময় গুহ সত্যজিৎ
রায়ের সাথে রদ্যাঁ-র ভাস্কর্যে মিল খুঁজে পাচ্ছেন এত বছর পেরিয়ে এসে, সেই একই অ-শ্রদ্ধায়
যখন ভবিষ্যতের অসাড়চিন্তাকীটদ্রষ্ট বাঙালী যুবক-যুবতী তাদের মুণ্ডপাত করবেন, সেটার
কথা ভেবে আত্মপ্রসাদ লাভ করতে পারবেন কি? উক্ত প্রবন্ধটি নিয়ে ভাবার সময় এসেছে,
আলোচনা করার সময় এসেছে। চিন্ময় গুহ এর আগেও অনুবাদ নিয়ে লিখেছেন ‘ঘুমের দরজা ঠেলে’
প্রবন্ধে। জানি না, ওনার আর কোন গ্রন্থে অনুবাদ নিয়ে আলোচনা করেছেন কি না, তবে,
আমার ইচ্ছা আছে এই পর্যায়টিকে নিয়ে আলাদা করে লেখার। কারণ, চিন্ময় গুহের এই
প্রবন্ধটা আমার কাছে সমালোচনা কম, সাবধানবাণী বেশি মনে হল।
চিন্ময় গুহ, বাস্তবিকই, ফরাসী
সাহিত্যের ধারাটিকে যেভাবে আমাদের কাছে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার অক্লান্ত পরিশ্রম
করেছেন, তা কি সার্থক হয়েছে? আমি জানি না। কোন যথার্থ প্রকাশক, কিম্বা অনুবাদকের
চোখে কি পড়েছে? পড়লে এতদিনে কাজ শুরু হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। ২০০৬-এ এই লেখাগুলো সংকলন
হয়েছে। আজ আমি পড়ে তার রিভিউ লিখছি। তার মানে কমপক্ষে ২৫ বছরেরও বেশি সময়
অতিক্রান্ত। কিছু কি কাজ হয়েছে? চোখে তো পড়ে না! ফরাসী সাহিত্যের কটা লেখা অনুবাদ
হয়েছে এই সময়ে? হয় নি, তা বলা যায় না অবশ্যই। কোথাও না কোথাও তো কেউ না কেউ অনুবাদ
করেইছে। কিন্তু ঢিমে তেতালায় পা ফেলাকে এগোনো বলা যায় না, আবার পিছোনোও বলা যায়
না। এ এক অদ্ভুত অবস্থা! কিন্তু, আসলেই, এভাবে ফাঁকির পথটা চওড়া হয়, আমরা বঞ্চিত
হই। আর আপামর বাঙালী সমাজ স্কুলে বাঙলা ভাষাকে আবশ্যিক করার আনন্দে নেচে মরছে দেখে
লজ্জায় মরে যাই। তারা ভাবছে, এভাবে বাংলা ভাষা তার প্রাপ্য সন্মান পেল! তা কি পাওয়া
যায়? না হয়েছে? কসমোপলিটান না হয়ে বেঁচে থাকা যায় না? বাইরের চিন্তাধারাকে আমাদের
ভাষায় না ভাবাতে শিখলে নতুন কোনো চিন্তা সম্ভব নয়। সেরকম বেঁচে থাকাটা বর্তমানের সিরিয়ালের
চরিত্রগুলোর মতো বেঁচে থাকা হবে। বেঁচে থাকবে, যেভাবে কোমায় বছরের পর বছর ধরে
মানুষ বেঁচে থাকে। অবশ্য তাকে যদি বেঁচে থাকা বলে। চিন্ময় গুহের লেখা কথাগুলো মনে
পড়ে যায়...
“আমরা সবাই জানি জানলা বন্ধ হয়ে
গেলে কী ভয়ংকর হয়ে ওঠে আলোবাতাসহীন জীবন, আর ‘অনুবাদ’ ও ‘জানলা’ কথা দুটো যখন ভাষা
ও জ্ঞানের ক্ষেত্রে সমার্থ, তখন দেখা দরকার জানলা খোলে না কেন, বা খুললেও এত কম
কেন! জানলা না খুলে বেশ আছি ভাবলে সেটা আত্মহননের সামিল। তা ছাড়া সতেরো শতকের
জীবনদ্রষ্টা লা রোশফুকো তো মনে করিয়েই দিয়েছেনঃ ‘বোকা বনে যাওয়ার সবচেয়ে সহজ উপায়
হল নিজেকে অন্যদের চেয়ে চালাক ভাবা।’... মনে রাখতে হবে, অনুবাদ সম্পর্কে এই অবজ্ঞা
ও অশ্রদ্ধার দিকটি অনুবাদ ও অনুবাদকের একটি বৃহত্তর মৌলিক সংকটের রূপরেখাকে তুলে
ধরে।”
==================================
চিলেকোঠার উন্মাদিনী
চিন্ময় গুহ
আনন্দ পাবলিশার্স
মুদ্রিত মূল্যঃ ৩০০ টাকা
ছবি কৃতজ্ঞতাঃ ইন্টারনেট
Comments
Post a Comment