অনন্তের মাঝে এক নক্ষত্রপথিক

 


চিন্ময় গুহের ‘ঘুমের দরজা ঠেলে’ নামক প্রবন্ধগুচ্ছ আমাকে চমকে দিয়েছিল। উক্ত প্রবন্ধগুচ্ছ অনেকটা ছাত্রবন্ধুর মতো। বিশেষত, ফরাসী সাহিত্যের একটি রূপরেখাকে স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করা যায়, যদিও টাইম লাইন ধরে নয়। কিন্তু সে যাই হোক না কেন, লেখকের জীবন ও সাহিত্যশৈলীকে তিন-চার পাতার মধ্যে এত সুন্দরভাবে আলোচনা করার উদ্দেশ্য পাঠককে কৌতুহলী করে তোলা, যে কাজে তিনি অনেকাংশে সফল। যদিও, তার পাশাপাশি অন্যান্য সাহিত্যের অনেক (এবং ভারতীয়) মহীরুহের কথাও আলোচনায় এসেছে। বোঝা যায়, চিন্ময় গুহ ফরাসী সাহিত্যের পাশাপাশি অবশিষ্ট বিশ্বসাহিত্য আত্মস্থ করেছেন।

‘হে অনন্ত নক্ষত্রবীথি’ তারই দ্বিতীয়াংশ। যদিও, লেখকের ভাষায়, “আমার পূর্ববর্তী গ্রন্থ ‘ঘুমের দরজা ঠেলে’ (২০১৬)-র সঙ্গে এর সুরের মিল, যদিও এটি একটি স্বতন্ত্র বই।” এখানে উনি আরেকটু এগিয়ে গিয়ে অন্যান্য শিল্প যেমন সিনেমা বা চিত্রকলা নিয়ে আলোচনা করতে গেছেন। বার্গম্যান বা আন্তোনিওনি কিম্বা দ্যগা বা মাতিস নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে কোথাও যেন তাল কেটে গেছে। সাহিত্যের আঙ্গিনায় ঔপন্যাসিক কিম্বা কবিদেরকে নিয়ে যতটা তিনি স্বচ্ছন্দ, বাকি দিকগুলোতে ততটা মনে হয় নি

চিন্ময় গুহের লেখার মধ্যে একটা সুররিয়েলিস্টিক স্টাইল আছে। এই স্টাইল কি ফরাসী চিন্তনের প্রভাব? এমন হয় না, যে একটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রের ভাষার সাথে সাথে সেই ভাষার একটা ছন্দ থাকে, মনোভাব প্রকাশের একটা ভঙ্গী থাকে। সেই ভঙ্গীই কি তিনি তার লেখার মধ্যে আনতে চেয়েছেন? সুররিয়াল বৈশিষ্ট্যের সাথে সাথে একটা কাব্যিক ছন্দ, নিশীথ রাত্রি, পরাচেতনার সাথে সাথে চরিত্রগুলোর মিশে যাওয়া, এমনকি দিবাকর কিম্বা অমিয় চক্রবর্তীর কথাও তিনি যখন বলছেন তখনও তা তার লেখনীতে প্রবহমান।

এই পর্বে তার মাধ্যম হল অনন্ত নক্ষত্রবীথি। ঘুমের ঘোর পেরিয়ে রাতের আকাশের এক অনন্ত রূপকে রূপকের মাধ্যমে দেখার চেষ্টা নিঃসন্দেহে অভিনব। এই বিষয়টাকে তিনি পেয়েছেন একটি কবিতা থেকে, “হে পাবক, অনন্ত নক্ষত্রবীথি তুমি, অন্ধকারে / তোমার পবিত্র অগ্নি জ্বলে।” এই কবিতার রচয়িতা জীবনানন্দ দাস সম্ভবত বাংলার সুররিয়েল কাব্যের অবিসম্বাদিত রাজা।

এক-একজন শিল্পীকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া, অল্প কথার মধ্যে, সহজ কাজ নয়। বিশেষত তার জীবন যেখানে তার কাজের প্রভাব ফেলে, সেই জায়গা থেকে লিখে যাওয়া, বেশ কঠিন। অন্তত সেই শিল্পীর সমগ্র জীবনের সাথে তার কাজের প্রভাব অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। অনেকে শিল্পীর জীবনটাকে সরিয়ে দিয়ে কাজটাকে প্রাধান্য দিতে পছন্দ করেন। যদি শিল্পীর দর্শনকে ছুঁতে চাওয়ার ইচ্ছা হয়, বিশেষত, যে জায়গায় নিজের জীবনের সাথে সেটা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত, তা সে যাই হোক, সেক্ষেত্রে শুধুমাত্র তার সৃষ্টির সাথে ভালভাবে পরিচয় থাকলেই চলে যায়। কিন্তু যেখানে শিল্পীকে সমগ্রতার নীরিখে বিচার করতে চাওয়া হয়, যদি মনে হয়, এমন একটা সৃষ্টি শিল্পীর পক্ষে করা সম্ভবপর হল কি করে? সাধারন মানুষ হিসাবে আমার জীবনে এমন শিল্পসৃষ্টি তো দূর, এমন চেতনার সংযোগও আপাতভাবে সম্ভবপর হচ্ছে না, তখন কিন্তু সেই শিল্পীর জীবনে ঢুকতেই হয়, তার ব্যক্তিগত পরিসরে নজর দিতেই হয়। সেখান থেকেই বোঝা যায় যে, শিল্পীরাও মানুষ। তারাও আর চার-পাঁচজন সাধারন মানুষের মতো একটা দৈনন্দিন লড়াই আছে, যাকে আমরা ‘সাধনা’ বলি।

এই কাজটাই খুব সুন্দরভাবে চিন্ময় গুহ করেছেন তার এই পর্বেও। যদিও কোথাও আমার মনে হয়, পূর্ববর্তী রচনারগুলোতে যে পরিমাণ আঁটোসাঁটো ভাব ছিল, এ পর্যায়ে সেটা অনেকটাই কমে গেছে। তার একটা বড়ো কারণ, হয়তো অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস, আরেকটা বড়ো কারণ সাহিত্য ব্যতিরেকে অন্যান্য ক্ষেত্রগুলোকেও চারণভূমি হিসাবে বেছে নেওয়া, যার পরিমাণ, এই পর্যায়ে অনেক বেশি। আর সেই জায়গাগুলোতে বারবার ঠোক্কর খেতে হয়েছে আমাকে। মনে হয়েছে, ঠিক সুরে সুর মিলল না। তা সে আল্যাঁ রেনে হোক, এরিক রোমের হোক, পাবলো পিকাসো হোক, কিম্বা এদগার দ্যগা।

চিন্ময় গুহের বক্তব্যের মধ্যে একটা মজা আছে। তিনি নিজে দেখছেন, এমনভাবে তার যাত্রা শুরু হয়। আর এই পথ একটা মায়াময় অতীতের পথ। অনন্ত নক্ষত্রবীথি তার মাধ্যম। যেন এক কনশাস লেভেল থেকে সেমি-কনশাস লেভেলের দিকে যাত্রা, সেখানে শিল্পীর কাজের পেছনের চেতনবোধের কথা বলতে চাইছেন। এবং তিনি জানেন, তাকে শেষ করতে হবে মাত্রে কয়েক পাতার মধ্যে। কারণ, পেছনে যে প্রকাশকের শব্দজব্দের অঙ্কুশ রয়েছে।

তবুও এর মধ্যে থেকেও যেভাবে একে একে বলেছেন কীট্‌স, মঁতেন, কাফকা, রবীন্দ্রকুমার দাশগুপ্ত, জোলা, রবীন্দ্রনাথ, দিবাকর কিম্বা র‍্যাঁবোর কথা তা চমৎকার। কিন্তু, কোন এক অদ্ভুত কারণে আমাকে বিষ্ময়ে ফেলে না, যেমনটা ফেলেছিল তার পূর্ববর্তী প্রবন্ধগুচ্ছ। আমাকে পড়ার জন্য উৎসাহিত করে না, কেবলমাত্র একটা নির্দিষ্ট ছকবাঁধা চেনপরিচিত ছন্দে ও ভাষায় স্রষ্টাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় মাত্র।

==================================

হে অনন্ত নক্ষত্রবীথি

চিন্ময় গুহ

সিগনেট প্রেস

মুদ্রিত মূল্যঃ ২০০ টাকা

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ সমর্পিতা

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে