পিপাসার্ত অভিমুখে কয়েকটি কবিতার কোলাজ
কেউ কবিতা
লেখে, আবার কারো কারো কাছে কবিতা আসে। সাইফুল ইসলাম সৌরভের ক্ষেত্রে কি
ঘটনা?
“কবিতা
লিখতে লিখতে যারা মৃত্যুর দিকে হেঁটে যায়” উৎসর্গপত্রটাই চমকে দেওয়ার মতন। কবি কি মৃত্যুর
দিকে যান, না কি মৃত্যুকে উত্তীর্ণ করে কালকেও জয় করতে চান? মহাকালকে ছুঁতে চান?
জীবনের পথে চলার পিপাসাই কি মৃত্যুর আবেগবিবর্জিত পরিণতি? না কি মৃত্যুর মুখোমুখি
হয়ে মৃত্যুকে প্রশ্ন করে, চোখে চোখে রেখে, নিজের সত্ত্বা দিয়ে তার আন্তরিক
উত্তরটাকে আবিস্কার করার উত্তেজনায় এগিয়ে চলা! কবি নিজে প্রশ্ন করেন, কিম্বা সমগ্র
জগতের আজ-কাল-পরশুর অর্বুদ অর্বুদ মৃত্যু অভিমুখী জনঅরণ্যের বাসিন্দাদের দেখতে
দেখতে চিরকালের মহাজীবনের প্রশ্নগুলোকেই রাখতে চান আপন ভাষায়? যদি তা না হয়ে থাকে,
তাহলে এ কাব্যগুচ্ছ কবির ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষামাত্র।
চিরকালীন সমষ্টিতে তার স্থান আছে, নিজের অন্তরের বিশ্বে তার প্রকাশ জাজ্বল্যমান। সে
আকাঙ্ক্ষায় প্রশ্নগুলো থাকে, তার কোনো সাধারণ সূত্র থাকে না।
ক্যালাইডোস্কোপের মতন কখন যে কি আলিপন ফুটে উঠবে তার কোন স্থিরতা নেই। সাইফুল
ইসলাম সৌরভের কবিতাগুলো পড়তে পড়তে আমার এটাই মনে হল।
“কবিতা হয়তো ভাল লাগবে অথবা লাগবে না। কবিতার
কাজ জ্ঞান দান বা কোনো কিছু জানানো নয়, কবিতার কাজ ভাল লাগা
পর্যন্তই..”, বলেছেন কবি স্বয়ং। যিনি এমন চিরায়ত ভাবপরম্পরায়
বিশ্বাস করেন, তার বইয়ের কোন রিভিউয়ের প্রয়োজন আছে কি? কবিতাগুলিকে কি তিনি
প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথেই দান করে দেন নি সেইসব আপামর পাঠকদের জন্যে, যারা তার
কবিতা খুঁজে নেবেন?
তার হাত
ধরেই এ বই যখন আমার হাতে এসে পৌছয়, আমি তার দেখনো ভাবপথে হাটতে যাই, চোখে পড়ে অনেক
ভাবনার কোলাজ। সেই পথের মধ্যে এগিয়ে চলতে চলতে আলগা চোখে জীবনের যে স্বচ্ছতা এবং
অস্বচ্ছতা চোখে পড়ে তাকেই লিখে রাখার প্রয়াস দেখতে পাই। তার সে কবিতায় ভাব আছে, কিন্তু
ভাষার বাঁধন বড়ো আলগা, এলোমেলো। “এই বাতাসের, মানুষের, বীজাণু ও মৃতদের / ভাষা
বুঝতে বুঝতে তার গুপ্তধন / আবিস্কার করতে করতে যারা / পথ থেকে পথে পথে পথকে করে
দিশেহারা, / তাদের মন আর মননের মতন / নিতে দিন আমাদের ক্ষণিক যতন...” [প্রার্থনা]।
ভাষাকে সহায় করতে চেয়েছেন তিনি, কিন্তু কেন? “একটা অন্ধকার টানেল পার হচ্ছি আমরা,
/ নতুন করে সাপের মত বদলে গিয়ে--- / বোকামি, ভুল ক্ষুদ্রতার খসে নিয়ে চামড়া, /
হৃদয়ের এ ঘর থেকে অহৃদ্যতার হামলা...” [টানেল]। এই ভাষার খোঁজে, জীবনের খোঁজে যে
কবিতাগুলো জন্ম নিল, তাই শেষে রূপ নিল ‘পথ চলার পিপাসা’ --- “অনেক কবিতা লিখে চলে
গেছে যুবকের দল / অনেক কবিতা তাই যুবকের শেষ সম্বল...” [কবিতার জন্ম]
আগেই বলেছি,
এই কবিতাগুচ্ছ কোন নির্দিষ্ট সার্থক বিষয়কে কেন্দ্র করে রচিত নয়। কবিতায় কবির
দর্শন যেখানে, সেখানে কবির বক্তব্য অপরিস্ফুট, সেখানে যেন পিপাসিত কবি ছন্দে এবং
ভাবে হাতড়ে হাতড়ে খুঁজে বেড়াচ্ছেন তার রূপ। অন্যদিকে কবিতায় যেখানে কবি ব্যক্তিগত রূপে
প্রকট, সেখানে তার কবিতার ভাষার ভাব এবং বুনোট অনেকটাই স্পষ্ট রূপ নিয়েছে। আব্বা,
আম্মি কিম্বা প্রেমাষ্পদেষুর জৈবনিক টানাপোড়েনকে যখন স্পষ্ট করে রূপ দিতে চাইছেন,
তখন তার আবেদন মন টানে। “আব্বা বললে মনে হয় একটা শিমূল গাছ / যার
ছায়ায় বসে আছি আমরা ক’জন, / যার শাখায় ঝুলে আছে দোলনা জীবন...” [জন্মদাতা] কিম্বা “আদিগন্ত
কোমলতার অঞ্জলি ভরে, / অফুরান মায়া দিয়ে যান অকাতরে। / তবু প্রতিবেশের শক্তমত অযুত
আঘাতে / চিত্ত পীড়া ব্যাধি তাকে করে নির্বাক--- / করেছে শিশুর মত অপূর্ব অবাক!”
[মা, অপূর্ব অবাক]
সৌরভের
প্রথম কাব্যগ্রন্থ। অভিনন্দন তাকে। প্রাথমিক স্তরে কোন কবিই একাকী উঠতে পারেন না,
এক বা একাধিক কবি এসে তার হাত ধরেন, পথের দিশা দেখান। সৌরভও তার থেকে পৃথক নন। তার
কবিতায় এপার বাংলার জীবনানন্দের বিষন্নতার পরশ আর সুনীলের ঝলক মেলে। “হয়তো
শঙ্খচিলের মতোই ফিরে আসতে হবে জীবনের তীরে। / লোকালয়ে ফিরে আসতে হবে অতিথির মতো
ধীরে ধীরে। / কারণ মানুষ মাত্রই এক স্বপ্নবিলাসী ঘুমের দেশের বাসিন্দা।” [ফিরে
আসতে হবে]
সৃষ্টি এবং
স্রষ্টা সম্পর্কে আমার একটা অভিমত আছে। নিজের হাতে নিজের সৃষ্ট শিল্প-সন্তানদের নির্মমভাবে হত্যা করে, আবার, ফিনিক্স পাখীর মতো, জন্ম দিয়ে, মৃত্যুর অভিঘাতে পুণর্জন্ম দিয়ে, এমনি বারংবার,
যখন সে সন্তান নিজেই নিজের স্রষ্টাকে ছাপিয়ে বড়ো হয়, তখন, সৃষ্টি সার্থক হয়। নচেৎ, আধো আধো শিশুর হাসিকান্নার মতো প্রখর গ্রীষ্মবিকালের ধূলামলিন পথের মাঝে কখন
যে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে, স্বয়ং মহাকালও তার খবর রাখে না।
সৌরভের এমন সার্থক
সৃষ্টির অপেক্ষায় রইলাম। জীবন বড়ো ছোট, তা হোক, এক জীবনে অনেক জীবন পার করেছি, করছি,
আশা করি, তার জীবনেও একদিন আমার জীবন ছুঁয়ে যাবে। আমি
বিস্মিত হয়ে বলব, আরে! এ কবিতা তো আমার
কবিতা…
=============================================
পথ চলার
পিপাসা
সাইফুল
ইসলাম সৌরভ
চৈতন্য
পাবলিকেশান
মুদ্রিত
মূল্যঃ ২০০ টাকা
ছবি
কৃতজ্ঞতাঃ সমর্পিতা
Comments
Post a Comment