দুই ভাই আর এক টুকরো কিশোরবেলা

 



Since you are God’s dear children.

You must try to be like Him.

Your life must be controlled by love.

Just as Christ loved us and gave His life for us.

As a sweet-smelling offering and sacrifice.

That pleases God.

 

‘মানুষ’ কেমন হওয়া উচিৎ --- বজ্রাদপি কঠোরানি মৃদুনি কুসুমাদপি --- বজ্রের চেয়েও কঠোর, কুসুমের চেয়েও কোমল কুসুমের মতো কোমল মন নিয়েই তো সে জন্মায়। সে যা দেখে তার মধ্যেই বিস্ময় লুকিয়ে থাকে। প্রতি মুহূর্তের প্রাকৃতিক বিস্ময়তার সাথে সাথে মিলিয়ে নেয় অন্তরের কল্পনার বিস্ময়তাকেআর সে চায়, তার কাছের মানুষজনও এই কোমলতাকে মায়ময় স্নেহময়তা দিয়ে ঘিরে রাখে, আগলে রাখেযেমনটা এক কিশোর চায়, ঠিক তেমনটা করেই গড়া সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস – রুকু সুকু।

রুকু আর সুকু দুই ভাই। কেমন তারা? “দাদু রুকুর নাম রেখেছেন ‘ভালমানুষ’। সত্যিই সে ভালোমানুষ, ধীর, স্থির। এক জায়গায় ঘন্টার পর ঘন্টা ধৈর্য ধরে বসে থাকতে পারে। নিজের মনে, নিজের ভাবেই থাকে। ভাল বই পেলে নাওয়া-খাওয়া ভুলে যায়। সুকুর নাম রেখেছেন ‘পালোয়ান’। ছটফটে পালোয়ান। সব সময় একটা-না-একটা কিছু তার মাথায় ঘুরছে। এক জায়গায় পাঁচ মিনিট চুপ করে বসে থাকতে পারে না। কাজ চাই, কাজ। সুকুর কাজ অনেক সময় বড়োদের মতো অকাজ। সুকুর ভয়ে সবাই তটস্থ।” তাদের বাবা ডাক্তার মুখার্জিমা রাজ্যেশ্বরী সুগৃহিণী। দাদু সুধীরঞ্জন বার্মার খনির একদা ইঞ্জিনীয়ার, দাদুর বন্ধু প্রাক্তন মেজর কালী মুখার্জিমোটামুটি এই ছয়টি চরিত্র। মূল চারটি চরিত্র নিয়ে যে লীলাবতী ঘর তৈরী হয়েছে ডালটনগঞ্জের জঙ্গলঘেরা পাহাড়ী বাংলোতে, সেই মায়াময় পরিবারটি কেমন? মাতামহের ভাষায়, “তোর সংসার একেবারে জমজমাট। মনে হচ্ছে ভগবান যেন নিজে হাতে, নিজের মনের মতো করে সাজিয়ে দিয়েছেন। ... ভগবান আছেন এবং তোমাদের মধ্যেই আছেন।” জীবনের একদম শেষ প্রান্তে এসে যে দাদু দেখেন --- “জীবন যেন একটা চৌবাচ্চা। এক নল দিয়ে জল ভরা হচ্ছে, আর-এক নল দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। কখনও খালি হচ্ছে না। এক দিকে সুখ, এক দিকে দুঃখ।... এই বয়সে জীবন খেলা ছাড়া আর কী!

কিশোরের দেখার চোখ কেমন হওয়া উচিৎ? বিশেষত যে কিশোর পরিবেশের অত্যন্ত কাছে থেকে বড়ো হচ্ছে, কলকারখানার নিরেট কঙ্কাল থেকে অনেক অনেক দূরে। সে উৎসাহী চোখ মেলে দেখতে চাইছে দুনিয়াটাকে, যে দুনিয়া পৃথিবী বিচ্ছিন্ন নয়, পৃথিবীর সাথে মিশে আছে। যার মধ্যে কোন মন্দ নেই, অসচ্ছতা নেই, দুঃখ নেই, আছে শুধু আনন্দ --- “... দেখতে ভালোবাসে রুকু। গ্রীষ্মের দুপুরে একটা পিচফল হাতে নিয়ে সেগুনের ছায়ায় চুপ করে বসে থাকো। চারদিকে লু ছুটছে। আকাশের গায়ে তামাটে পাহাড়। একটা ভোমরা এলিয়ে পড়া ফুলের ইঞ্চিখানেক দূরে ভোঁ ভোঁ করছে। মাঝে মাঝে ছোঁ মেরে গর্ভকেশর থেকে পরাগ আর মধু তুলে আনছে। সেগুনের তলার ঝোপে এক ডাল থেকে আর-এক ডালে মাকড়শা ঝুলে ঝুলে জাল বুনে চলেছে। পিঁপড়ের সারি চলেছে পিঠে ডিমের বোঝা নিয়ে। এই টুকটুকে সোনালী মাছি মায়ের নাকের নাকছাবির মতো ফিনফিন করে উড়ছে।” সে জানে --- “জীবন পুষে রাখার জিনিস নয়, জীবনকে উড়িয়ে দিতে হয় পাখীর মতো।

আমি হারিয়ে যাই আমার নিজের কিশোরী বেলায়। সবুজ ধানের ক্ষেতে যে বেসামাল ঢেউ বয়ে যায় আমি সেই ঢেউয়ে নিজেকে এলিয়ে দিতে চাই। একদা আমার বুকের ওড়না দিয়ে যে গাছের ডালে দোলনা বানিয়ে চড়েছিলাম, ছিঁড়ে গিয়ে মাটিতে পড়ে কোমরে চোট পেয়েছিলাম, এমনকি ধুলোমাখা মুখ নিয়ে বাড়ীতে গিয়ে পিটানি খেয়েছিলাম, সেই দু-টুকরো ওড়নাটাকে আবার ফিরে পেতে ইচ্ছা করে। সুপুরী গাছের খোলায় চড়ে গাড়ী গাড়ী খেলতাম। ভাই টানত, দাদা টানত, দিদি টানতো, পাড়ার বন্ধুরা টানতো, রেস হতোমাটির রাস্তা দিয়ে উড়ে যেত আমাদের পঙ্ক্ষীরাজ, ধুলো উড়ত, পাথরের টুকরো ছিটকে যেত। তারা আজ কই? তাদের কিশোরবেলার সাথে সাথে আমার কিশোরীবেলাও কোন আমগাছের কোটরে রাখা আছে কাঁচা আম ছেলার বড়ো বড়ো দুটো ঝিনুকের সাথে। কাসুন্দি আর কাঁচা লংকার সেই ঝাঁঝ আর ঝাল বুনো ঝোপের আড়ালে ফুলের বনে মিশে গেছে, আর সে ফিরে আসে না। স্মৃতি থাকে।

দুঃখ আছে। মৃত্যু আছে। দাদু মারা যান এক রাত্রেদাদুর বন্ধু মেজর মুখার্জি নিখোঁজ হন আরেক দিন। বন্ধুর শোকে তিনি কি আত্মহত্যা করেন? “ডক্টর মুখার্জি পায়ে পায়ে খাদটার ধারে এলেন। ধাপে ধাপে নেমে গেছে বড় গাছ ছোট গাছ। ডালে ডালে শকুন বসে আছে। ... কিছু উড়ছে, কিছু উড়ে যাচ্ছে, আবার এসে বসছে। নির্জন পাহাড় আর বনানীতে যেন তাণ্ডব চলছে। মৃতদেহ-লোভী কিংবা মানুষ! ডক্টর মুখার্জি স্তব্ধ হয়ে খাদের পাশে দাঁড়িয়ে রইলেন। পাতার ফাঁকে ফাঁকে অনেক নীচে প্রবহমান পাহাড়ি নদীর জল রোদে চিকমিক করছে। জোরে হাওয়া বইলে নাকে একটা গন্ধ এসে লাগছে। পাহাড়ের ঢালু বেয়ে মাঝে মধ্যে একটা-দুতো আলগা পাথর গরিয়ে পড়ছে। সেই অসীম নির্জনতা, উদ্ধত পাহাড়, শকুনের পাক খাওয়া, লাট খাওয়া খ্যা খ্যা, সবকিছুর মধ্যে দাঁড়িয়ে ডক্টর মুখার্জির মনে হল, জীবন বড় ভীষণ।

এই ভীষণে-সুন্দরে উপন্যাস রচনা করেছেন সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়। সেখানে যেমন একটি বাচ্চা মেয়ে জ্বরের ঘোরে আতঙ্কে বলে ওঠে, “আর মেরো না বাবা, ভীষণ লাগছে।” তেমনি একটি বাচ্চা ছেলে বলতে পারে, “জানো মা, ভগবান আছেন, আমি প্রমাণ পেয়েছি।

==========================

রুকু সুকু

সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

আনন্দ পাবলিকেশান

মুদ্রিত মূল্যঃ ১৫০/-

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ সমর্পিতা

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে