রুশদী-র মধ্যরাতের সন্তানেরা
“My son will understand. As much as for any living
being, I’m telling my story for him, so that afterwards, when I’ve lost my
struggle against cracks, he will know. Morality, judgment, character… it all
starts with memory… and I am keeping carbons.”
সলমন
রুশদী’র ‘মিডনাইটস্ চিলড্রেন’। এক গভীর গহীন অরণ্য। কেউ
এই অরণ্যের সামনে থেকে ফিরে যায়। কেউ গভীরে হারিয়ে যায়। কেউ ঢুকে পড়ে, বেরিয়ে আসে,
এবং সেই অরণ্যে ঢোকার আবার তার সাধ জাগে।
এই অরণ্যে চলতে গেলে কয়েকটা নিয়ম মানতে হবে – জঙ্গলের নিয়ম –
‘রুশদী’ পাঠের নিয়ম ---
১। Post
Colonial Literature – ১৯৪৭ পরবর্তী ভারতের ইতিহাস জানাটা জরুরী।
আধো আধো জ্ঞান হলে চলবে না। আমি এ ব্যাপারে কৃতজ্ঞ রামচন্দ্র গুহের ‘India
After Gandhi’ বইটার কাছে।
২। বইয়ের চরিত্রগুলোর জটিলতা –
মূলত তিন প্রজন্মের কাহিনী। মূল তিন অংশে বিভক্ত এই বইয়ের গল্প বলা একরকম অসম্ভব।
যত গল্প এগিয়েছে, ততই জটিলতা বেড়েছে। লতায়-পাতায়, শাখা-প্রশাখায়।
৩। উপন্যাস ব্যখ্যান ধারা – ভাষা
ইংরাজী হলেও, মডার্ন ইংরাজী নয়, আবার ক্লাসিকও নয়, এর মাঝামাঝি। ফলে পড়তে গেলে
একটু ঠোক্কর খেতে হবে বৈ কি। সেই সাথে, রুশদীর নিজস্ব ম্যাজিক রিয়েলিজমের হাত ধরে
বাক্যের জটিলতা (বা সৌন্দর্যতা) উপন্যাসকে আরোও গহীন চিন্তনের জায়গায় নিয়ে গেছে।
৪। পৌরাণিক কথা, রূপক, বাস্তব
এবং লেখকের আত্মচেতনা – পাশাপাশি হাত ধরে চলেছে। এবং অদ্ভুতভাবে সমান্তরালে না
গিয়ে অনেক জায়গাতেই একে অপরের সাথে মিলে মিশে গেছে। ধীর স্থির হয়ে এই বুননের
গাঁটগুলোকে নিরীক্ষণ করে এগোতে হবে।
৫। ধৈর্য – প্রথম পর্বেই
বুঝতে না পেরে হাত গুটিয়ে নিলে চলবে না। রবার্ট ব্রুস টাইপ পাঠক হতে হবে, একবার না
পারিলে দেখো শতবার। এবং না বুঝেও অনেক সময় এগিয়ে যেতে হবে। এগোতে এগোতে একসময়
ছন্দটা বোঝা যাবে। আর একবার ছন্দ বোঝা গেলেই, তাড়াহুড়া না করে ধীরে ধীরে এগোতে
হবে।
মোটকথা, এই বই শুরু করার আগে একটা প্রস্তুতিপর্ব রাখা চাই-ই চাই।
নচেৎ, এ উপন্যাসকে আত্মস্থ করা তো দূর, শেষ করে উঠতে পারাটাই দুরুহ।
আমি এখন যে লিখছি, জানি, সম্পূর্ণটা লিখে উঠতে পারব না। সম্ভব না। আমার এই লেখা
একটা বাচ্চার আধো আধো কথার মতো।
মোটামুটিভাবে গল্পের অ্যানাটমিটা হল, কেন্দ্রীয় চরিত্র সেলিম
সিনাই জন্মেছিল ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট ঠিক মধ্যরাত্রে। এবং জন্মের পরেই বদলা বদলি
হয়ে যায় আরেকজনের সাথে। শিবার সাথে। গল্পটা এই সেলিমের
পরিবারেরই কাহিনী, যেখানে সে সিনাই পরিবারের প্রকৃত সন্তান নয়। তার
এই কাহিনী এগোয় ভারতের প্রগতির সাথে সাথে। বলাই বাহুল্য, জন্মক্ষণটিই একটি রূপক।
মোট তিরিশ বছরের স্বাধীন ভারতকে তিনি দেখিয়েছেন। শেষ করেছেন ইন্দিরা গান্ধীকৃত
‘ইমার্জেন্সী’ পিরিয়ডের সমাপ্তিতে। শুরু করেছেন মোটামুটিভাবে
জালিয়ানওয়ালাবাগের সময়ের কিছুটা আগে থেকে। ১৯১৮ থেকে। সেলিমের সাথে সাথে আরও এক
হাজার জন জন্মায়, দশ বছরে সংখ্যাটা প্রায় অর্ধেক হয়ে আসে। যাদের প্রত্যেকেই কিছু
না কিছু ক্ষমতা নিয়ে এসেছে। শিবা, পার্বতী অপর দুই মূল চরিত্র। এরাই
মধ্যরাতের সন্তান।
প্রত্যেকটা চরিত্রকে রূপকার্থে ধরলে উপন্যাসের একটা স্তরকে ধরতে
পারা যায়। যে স্তরে সেলিম নিজে অনাবদ্ধ ভারত, সেখানে সে জন্মক্ষণ থেকেই নিজের
আইডেন্টিটি খুঁজছে – কখনও ভারতে, কখনও পাকিস্থানে, কখনও বাংলাদেশে। তার বিরোধী
শিবা রক্ষণশীল ভারত, অন্ধ দেশপ্রেমী, যথেচ্ছাচারী। পার্বতী
যেন আধুনিক ভারত। তার হৃদয় নতুন ভারতের দিকে, সেলিমের দিকে, যাকে পার্বতী
হারিয়ে যাওয়া আইডেন্টিটি ফিরিয়ে দিলেও পার্বতীকে সে বিবাহ করতে অপারগ।
ভারত কি নবচেতনার পথে হাটবে, না কি সনাতনী ধারায়? সেলিম কাকে প্রকৃত ভারতরূপে
দেখতে চায়? কার ছাঁদে নিজেকে ঢালতে চায়? পার্বতী, না শিবা? জানে না সে। প্রত্যাখ্যাত
পার্বতী শিবার কাছে গেলেও শিবা তাকে সন্তানসম্ভবা করে, কিন্তু গ্রহণ করে না। রক্ষণশীল
মনোবৃত্তি কি এইভাবেই আধুনিকতার পথের বাধা এবং ধ্বংসস্বরূপ? সে কী বুঝতে পারে না,
আধুনিকতার হাত না ধরলে মহতী বিনষ্টি? আবার পার্বতীর অবাধ মুক্তচিন্তাও কি কাম্য?
বাঁধনহীন আধুনিকতা শেষে কি নিজেরই ধ্বংস ডেকে আনে না? পার্বতীকে অবশেষে বিয়ে করে
সেলিম, তার উত্তরসূরীকে সামাজিক প্রতিষ্ঠা দিতে। আধুনিকতার
হাত ধরে ভারত, দ্বিধাগ্রস্থভাবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে জন্ম দিতে গিয়ে
অবশেষে পার্বতীর মৃত্যু হয়, ‘ইমার্জেন্সী’র অন্ধকারে। রয়ে
যায়, পুত্রসন্তান, আদম সিনাই, রুগ্ন, সেলিম তাকে পুত্র বলে স্বীকার করে। তার কান
হাতীর মতো বড়ো। সে শোনে, কিন্তু কোন কথা বলে না। ‘মিথ’ এসে হাত ধরে উপন্যাসের,
ভারতের, সেলিমের। ভারতে তখন অন্ধকার।
ভারতকে নষ্ট করছে কে? রাজনৈতিক ক্ষমতার লোভ? রাজনৈতিক পটভূমিতে
মিডনাইটস্ চিলড্রেনদের ব্যবহার করা হয় ভোটব্যাঙ্কের জন্য। ব্যর্থ, পরাজিত নেত্রী
তাদের ভ্যাসেকটমি করে ছেড়ে দেন। এইভাবেই কি সুপরিকল্পিতভাবে মগজ
ধোলাই হয়? বন্ধ করার চেষ্টা হয় ভবিষ্যতের পথ? যাতে অন্য নেতা বা নেত্রী এদের
ব্যবহার করতে না পারে? সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ মনে পড়ে যায়।
সমাজের বাঁধাধরা নিয়মের পথ ধরে কখনই কোন ক্ষণজন্মা আসে না। তাই
কি মিডনাইটস্ চিলড্রেন ও তার পরবর্তী প্রজন্মের সবাই বাস্টার্ড, বেজন্মা? এটাই কি
অভিশাপ? এটাই কি আশীর্বাদ? সেলিমের মৃত্যুর সাথে সাথে ভারত কোন অন্ধকার ভারতের
দিকে যাচ্ছে, সে প্রশ্ন থেকেই যায়। যদিও, মধ্যরাতের সন্তানের সন্তানেরা আস্তে
আস্তে সেই অন্ধকারে বেড়ে উঠছে, সকলের অলক্ষ্যে। কিন্তু, কেমন হবে তারা? বন্ধু, না
শত্রু? আলো, না অন্ধকার?
সেলিম
কখনও ভারতে, কখনও বাংলাদেশে, কখনও পাকিস্থানে। একটুকরো ভারতকে যারা তিন টুকরো
করেছে, সেলিমের কাছে সেই তিনট টুকরোই যে এক টুকরো। ফলে, সব জায়গাতেই সে হারতে
হারতে, হারাতে হারাতে এগোয়। জন্মলগ্নেই ভারতে হারায় নিজের পরিচয়। পাকিস্থানে
পরিবার। বাংলাদেশের সুন্দরবনের মায়াময় ম্যাজিক রিয়েলিটির গহীনে নিজেকে। অবশেষে
ভারতে ফিরে নিজের অন্তিম দশার মধ্যে দিয়ে নিজেকে আহুত করে ভবিষ্যতের অগ্নিগর্ভ
অন্ধকারে।
তৃতীয় অংশের
‘বনপর্ব’ (In The Sundarbans) এক বিস্ময়কর নির্মাণ। এই
পর্বে সেলিমের উত্তরণ নিয়ে কেউ কথা বলেছে কি? হারুকি মুরাকামি কি পড়েছেন উপন্যাসটা?
কাফকাও একসময় বনের মধ্যে হারিয়ে গিয়ে নিজের আইডেন্টিটি খুঁজে পেয়েছিল। এমনকি আপন
মা এবং বোনের সাথে যৌনতার যে অভিশপ্ত কমপ্লেক্সিটি, যা ধরা দেয় তার ‘কাফকা অন দ্য
শোর’ উপন্যাসে, এখানেও সেলিমের তার সৎ বোনের প্রতি অমোঘ টান একই ইঙ্গিত করে। ‘অজাচার’
নতুন বিষয় নয়। সেই সাথে মিথ, পরাবস্তবতা এবং মনস্তাত্বিকতা। যদিও দুই লেখকের কলমে
তা ভিন্নপথে এগিয়েছে।
আরও অনেক লেখককে মনে পড়ে। গুন্টার গ্রাস। ‘দ্য টিন ড্রাম’-এর আদল যেন
এই উপন্যাসে। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ। শেষের কটি লাইন যেন ‘ওয়ান হাড্রেড
ইয়ার্স ইন সলিটিউড’-এর ভাবাখ্যান। যদিও এদের সবার থেকে সরে এসে সবশেষে সলমন রুশদী
একান্ত নিজস্ব গাঁথা রচনা করেছেন। গাঁথা ছাড়া আর কি-ই বা বলব একে? মহাভারতের মতো
যেন এ এক গদ্যের আঙ্গিকে ক্ষুদ্র মহাকাব্য। যে কাব্য এখনও এগিয়ে চলেছে...
অদ্ভুত ব্যাপার, ‘বুকার অফ্ দ্য বুকারস্’ পাওয়া এই উপন্যাসকে
এযাবৎ সার্থক বাংলায় রূপান্তর করার ক্ষমতা কেউ দেখাতে পারেন নি। এপার বাংলার
অনুবাদকেরা নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছেন, কিম্বা প্রকাশকের মিনমিনে অজুহাত শুনে দুঃখে
চুপ করে বসে আছেন। যে পরিমাণে ট্র্যাশ লেখা এখন বই-বাজারে বের হয়ে চলেছে, তাতে করে
এখনকার মান্যগন্য লেখক-লেখিকারা যদি সেইসব ট্র্যাশ লেখা বন্ধ করে এই ধরণের পোস্ট
কলোনিয়াল ক্লাসিক বইয়ের অনুবাদে হাত দিতেন, তাহলে তারা নিজেরাও টের পেতেন যে, ১৯৮১
সালেই এক ভারতীয়-বিদেশি ভারতকে নিয়েই কি অসম্ভব উচ্চমানের এক উপন্যাস নির্মাণ
করেছেন, যা আঞ্চলিক নয়, যা ঔপমহাদেশিক হয়েও বিশ্বমানের, টেক্সট বুক হওয়ার যোগ্য।
তাহলে তাদের লেখার গুণমানে বহুল পরিবর্তন আসতো, পাঠকও অনেক সমৃদ্ধ হতে পারতো।
রইল বাকি ওপার বাংলা। প্রমিত হোসেন একই নামে এর বঙ্গানুবাদ করেছেন
বটে, কিন্তু তার ওপর চালাকি দেখে বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। যে কোন বই নেওয়ার আগে
পাঠক প্রথম তিন-চার পাতা পড়ে। ইনি প্রথম তিন-চার পর্ব পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ করেছেন। আর
তারপরেই ছাটতে ছাটতে প্রায় সাড়ে ছয়শো পাতার বইটাকে টেনে এনে দাঁড় করিয়েছেন মাত্র
৩৮০ পাতার আশেপাশে (একটি উদাহরণঃ A Public Announcement –এর দ্বিতীয় এবং তৃতীয় প্যারা – বাংলায় যে এর একটা প্যারায় অনুবাদে কি অর্থ
দাঁড়াল তা খোদায় মালুম)! তিনি মনে করেছেন, সলমন রুশদীকে আধাখ্যাঁচড়া অনুবাদ করলেই
যথেষ্ট, ইংরাজী অক্ষম পাঠককূলকে যথেষ্ট করুণা দেখানো হল। তিনি
ভুলে গেছেন, এ ধরনের বই লিখতে গিয়ে কোথাও কোন ফাঁকি দেন নি স্বয়ং লেখক। রুশদী
চাকরি ছেড়ে দিয়ে তিনটি বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। আর প্রমিত সাহেব তার অবসর
সময়ে স্রেফ ফাঁকি মেরে কাজ সেরেছেন। এই অনুবাদ কেনা মানে পয়সা জলে দেওয়াই শুধু নয়,
তঞ্চকতার দায়ে পাঠকের হেনস্থামাত্র।
সলমন রুশদী তার এই বইতে নিজেও আছেন। আত্মজীবনীমূলক এই উপন্যাসে
প্রটাগোনিষ্ট ক্যারেক্টার সেলিম সিনাইয়ের চিন্তা-ভাবনার মধ্যে দিয়ে তিনি তার
নিজস্ব দর্শন, বিশেষত ধর্মীয় চিন্তাধারা, মানব চেতনার নিগূঢ় দর্শনকে ধরতে চেয়েছেন।
প্রত্যেকটা মানুষ অবশেষে বাঁচে তার নিজস্ব চিন্তাধারা নিয়েই, যা তার জীবনের
অভিজ্ঞতাসঞ্জাত। যা তার স্মৃতি। আর তাই, এই উপন্যাস শেষ করার পরেও আমার চোখে ভাসতে
থাকে এই কথাগুলো ---
“Memory’s truth, because memory
has its own special kind. It selects, eliminates, alters, exaggerates,
minimizes, glorifies, and vilifies also; but in the end it creates its own
reality, its heterogeneous but usually coherent version of events; and no sane
human being ever trusts someone else’s version more than his own.”
====================
Midnight’s
Children
Salman
Rushdie
Publishers:
RHUK
Price:
499/-
ছবি
কৃতজ্ঞতাঃ সমর্পিতা
Comments
Post a Comment