কেউ নেই কিছু নেই সূর্য দুবে গেছ

 


মরে যেতে কখনও ভালো লাগবে না আমার। কারণ জীবন চমৎকার, জীবন ফ্যাসিনেটিং। মরে যাবার কথা ভাবলেই আমি প্রথম ভাবি আর কি আমার পুনর্বার দেখা হবে না...

      যিনি এই কথাগুলো লিখেছিলেন সেই ডাঃ প্রজ্ঞাদীপা হালদার আত্মহত্যা করেন ২০শে জুন ২০২৩, আজ থেকে তিন সপ্তাহ আগে রেখে গেছেন একটি সুইসাইড নোট। ভুল বানানে লিখিত মর্মান্তিক শেষ ফেসবুক পোষ্টটি আমার এই প্রবন্ধের শিরোনাম। মাটি থেকে প্রায় এগারো ফুট উঁচু ফ্যানের থেকে ঝুলন্ত নিথর ক্ষতবিক্ষত প্রজ্ঞাদীপার মৃত্যু হত্যা না আত্মহত্যা তা ভবিষ্যতে আদালতে প্রমাণ হবে। চমক লাগে, যখন দেখি, আত্মহত্যাবিলাসিনী প্রজ্ঞাদীপা উক্ত প্রথম প্যারাটি লিখেছিলেন আত্মহত্যার তিন বছর আগে, একটি বইতে অনেকটা Confessional Poetry-র আদলে ছোট ছোট গদ্যের প্যাটার্নে লেখা এই বই। নাম ‘আত্মহত্যার সম্পূর্ণ বিবরণী’।

      তার আত্মহত্যার পর বইটা আবার লাইম লাইটে ফিরে এসেছে। আমার হাতে অবশেষে এসে পৌছেছে আমারই এক শুভনুধ্যায়ীর হাত ধরে। হাতে আসামাত্রই পড়তে শুরু করলাম। এ বই গোগ্রাসে পড়ে ফেলবার বই নয়। ধীরে ধীরে, নিয়মিত, একটু একটু করে, অবশেষে শেষ করলাম। আমার মনে হল, বাংলা সাহিত্য ভবিষ্যতের এক শক্তিশালী মহিলা লেখিকাকে হারাল তিনি একাধারে সার্থক কবি এবং গদ্যকার হতে পারতেন তার গদ্যের সুললিত ছন্দ পড়িয়ে নেয় গোটা লেখাটাকে। পুরোনো গদ্যের ভাষার সাথে আধুনিক কথ্যভাষার সার্থক মিশেলে ছোট ছোট গদ্য নিবন্ধে সাধারণ এক নারীর টুকিটাকি দিনলিপির সাথে সাথে পরাচেতন মনের সার্থক প্রকাশশাড়ির ভাঁজে কিম্বা বিড়ালের পায়ের ছাপে মাঝে রেখে যাওয়া ধূসর গদ্যরেখাচিহ্নের পথ ধরে আমি হাটি তার আত্মহত্যাপ্রবণ মনের মধ্যে ঢুকে পড়ি। এগোতে থাকি আধো আলো আর আধো অন্ধকারের চোরাপথে।

      এই বইয়ের পাতায় পাতায় বিষাদময়তার অভিজ্ঞান। “আমার কিচ্ছু ভালো লাগে না, কেবল ইচ্ছা করে অন্ধকারে বসে বৃষ্টির শব্দ শুনতে। মেঘ, বৃষ্টি, শব্দ, বিষাদ এই-ই তো, আর কি।” প্রায় প্রত্যেকটা লেখা একাকীত্বের ধুসরতার অভিমুখে। “আজকাল আমার অমন একটা শান্ত দুপুরের পেটের মধ্যে ঢুকে ঘুমিয়ে পড়তে ইচ্ছে করে। মনখারাপ হয়, আসলে আমার ক্লান্ত লাগে খুব।” তার পড়াশোনা কেমন? “আত্মহত্যাপ্রবণ কবিদের ভীড় আমার টেবিলে। আমারও অমন কষের মতো খয়েরি মৃত্যু কিছু প্রবাসে যেতে সাধ। নেহাত হেমন্তকাল দূরবর্তী। আমি ক্রমশই নিজেই নিজের দর্শক হয়ে উঠি।” যেন তার সমস্ত সত্ত্বা দিয়ে যাবতীয় কালো কালো দুঃখকে শুষে নিয়ে রূপদান করেছেন এক-একটা গদ্যে। আর সেই গদ্যের ভাষা কিম্বা ভাব-বিভঙ্গিমা কী! লা জবাব। তিনি পড়িয়ে নিতে জানতেন, তিনি পড়িয়ে নেন। “আমার কোন উপন্যাস লেখা হয়নি আজও, তবু তো আমি আমাকেই লিখি। এত না লেখা বুকে নিয়ে মরে যেতে পারব? কষ্ট হবে না? তবু তো শখ হয় মৃত্যুর। হেমন্তকাল এলে আকন্ঠ বিষাদে ডুবে বসে থাকি। ... জীবনের বিপরীতে কী ভীষণ প্ররোচনাময় মৃত্যু বেঁচে থাকে।”

      ছয়টি ঋতুর ছয় পর্বে ভাগ করেছেন তার আত্মহত্যার যাবতীয় উপাদানকে --- গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত। যে উপাদানে তার শৈশব বড়ো সাংঘাতিকভাবে ফিরে ফিরে এসেছে।

      বিষাদময়তার পথেই একমাত্র যার আনাগোনা, তার লেখায় আত্মহত্যার প্ররোচনা তো থাকবেই, “বিরক্ত কোরো না, আমায় বিষাদে থাকতে দাও। একমাত্র আত্মহত্যাই আমার নিয়তি।” প্রজ্ঞাদীপা কি ওষুধ খেতেন? “এই সব ছুঁয়ে ছেনে মৃত্যু গেঁথে মালা হয়, অষ্টোত্তর শতনামে, যেখানে মনখারাপ পরিষ্কার বোঝা যায়, সেখানে তোমার থাকতে নেই। ডাক্তারবাবুর কাছে গিয়ে লাল নীল ওষুধ নিতে হয়।” আমার মনে পড়ে সেই অমোঘ বাক্য --- ডাক্তার, আগে নিজের রোগ সারাও।

এই লেখার পাতায় পাতায় লেখিকার নিজের শৈশব, কৈশোর, আর যৌবনের কথা। তাহলে কি আত্মহত্যার উন্মত্ত ইচ্ছার ধাপগুলোকেই তিনি বারংবার দেখতে চেয়েছিলেন? আবিষ্কার করতে চেয়েছিলেন এই অন্ধকার পথের শেষ ধাপটাকে? “বিষাদ আমায় স্থবির করে দেয়। আমার মেরুদণ্ড বরাবর পাকিয়ে ওঠে ব্যথা, আমার নৈঃশব্দ্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রক্তস্রোত মৃদু হয়ে ওঠে। আমি উঠতে পারি না, শুতে পারি না। আয়নার সামনে বানস্পত্যে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকি।” তার এই লেখা কি সেই দুঃখ-হতাশার মধ্যে থেকে বারংবার নিজেকে দেখতে চাওয়ার অন্তিম প্রচেষ্টা? “যে দিন আত্মহত্যা করব, সেদিন তোমার দেওয়া লাল শাড়িটাই পরব মনে করে। পায়ে পড়ব বাঁকমল।” এগারো ফুট উঁচু থেকে ঝুলতে যাওয়ার প্রাক্‌মুহূর্তে কি তিনি এমনই পরিপাটি করে সেজেছিলেন? বিষন্ন মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়ার আগে, সুইসাইড নোট লিখতে যাওয়ার আগে তিনি কি ভেবেছিলেন একসময়ে তারই লেখা এই লাইনগুলো --- “নভেম্বর-ডিসেম্বর-জানুয়ারী লাজলজ্জাহীন স্মৃতিমন্থন। ফেব্রুয়ারির দিন যেই উইড়্যা গেছে শুয়াপঙ্খী, আর পইড়্যা আছে মায়া। মার্চ-এপ্রিল-এর ক্যালেন্ডার জুড়ে ঋতুস্রাবের মতো লাল সব দিন, ছুটি ছুটি ছুটি, ভালরাক্ষস, চলো পাহাড়ে বেরিয়ে আসি। মে-জুন কেবল বিশ্বাসঘাতকতা আর গৃহত্যাগের মাস মনে রেখো।”

দেহত্যাগের জন্যে আপনি অবশেষে জুন মাসকেই বেছে নিলেন!

বারংবার এসেছে তার শৈশবের কথা --- সেই মফস্বল, সেই ছোট ছোট টুকরো টুকরো সাদা-কালো দিনগুলো। ঝুলন এসেছে, পূর্ববঙ্গীয় রান্নার বহুরূপতা এসেছে, এসেছে বইয়েরা, এসেছে গান, এসেছে সিনেমা, এসেছে ছবি, এসেছে আত্মীয়স্বজন, এসেছে দিদি, মা ও বাবা --- “বাবার মতো নয় বলে তেমন করে ভালবাসতে পারিনি কোনও প্রেমিককেইবাবাকেও কি ভালবাসি? বকি তো প্রায়ই, বাংলাদেশের কথায় বাবার চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। আমি বিদ্যানুরাগে আমাদের মিল খুঁজে পাই।”

তার জীবিত পিতা আজ কেমন আছেন?

“আমার স্বপ্নে সর্বত্র কিছু গা ঘিনঘিনে বিষন্ন ছাইকালো মাছ। ঘুমের মধ্যে আমি আঁশটে গন্ধ পাই। আমার বিড়ালবাসনা জাগে। আমি স্বপ্নের ভিতরেও মৃত্যুর হাত থেকে পালাতে চেয়ে হন্যে হই।” কিন্তু, পরক্ষণেই, মৃত্যুকে কাছে টেনে নেওয়ার অমোঘ এক আকর্ষণ থেকে নিজেকে সামলাতে পারেন না --- “কত জায়গাতেই আবার আসব বলে একটি বারও ফিরে যাইনি আমি, ফিরে যাওয়া হয় না বলে আজকাল সব কাজ শেষবারের মতো নিপুণতায় করতে ইচ্ছা করে, যেন কোনও দুঃখ না বেজে ওঠে অসম্পূর্ণতার।” কখনও পজিটিভ, কখনও নেগেটিভ --- বর্ষার ভরাক্রান্ততায় কিম্বা বসন্তের আবিলতায় এই সমস্ত নীরন্ধ্র হতাশার মাঝে কোথাও একটা ভালো লাগার বোধ কাজ করে, ছোটবেলার স্মৃতিচারণার দিকে ঠেলে দেয় তাকে। পাতার পর পাতা জুড়ে, কিম্বা কোন কোন পর্বে তার কিশোরীবেলা ধরা দেয়। কৈশোরের এক স্বপ্নমগ্ন রূপকথার মধ্যে বাঁচার উদগ্র ইচ্ছা জাগ্রত হয় --- “আমায় আপেলবাগানের বাড়ির চাবিটি দিও, আরও একটি সরল, ব্যঞ্জনাহীন দুপুরে বেঁচে থাকতে চাই পুনর্বার।” পরক্ষণেই বর্তমানে ফিরে আসেন। শাড়ীর ভাঁজে, কিম্বা বিড়ালিনীর নরম ওমে, কিম্বা বারান্দার ঝুলন্ত টবের গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে থাকা একাকীত্বের মগ্নমদিরতা তাকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করে --- “জীবনে একটা সময় পরে গিয়ে বোধহয় এক্সক্লুসিভ বলে কিছুই থাকে না।”

আমি জানি না, তার এই বই আত্মহত্যার পূর্ব সংকেত ছিল কি না। কারণ, পড়তে পড়তে আমার কখনই মনে হয় নি যে, এ তার নিজের জীবনের উপলব্ধিগত অনুভূতি নয়। মনে হয়, জীবনের প্রতিটা পদে পদে এই যে আত্মহত্যার প্ররোচনা, জীবনের চির অমীমাংসীত সিদ্ধান্তের সার্থক খোঁজে ব্যর্থ হয়ে ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছিলেন মৃত্যুর দিকে। অ-সুস্থ সম্পর্কের টানাপোড়েন তাকে বারবার ঠেলে দিয়েছিল শেষের সেই দিনের দিকে। বড্ডো তাড়াতাড়ি। কেবল রয়ে গেল এই একটি বই, এবং তার কয়েকটি বাক্যবন্ধ ---

“পেটে ক্ষতচিহ্নের উপর হাত রাখি। ঘা শুকোতে দেরি হয় বলে ব্যথা। এমন মায়ায় হাত রাখি যেন সেই অজাত সন্তান বেড়ে উঠছে আমার গর্ভে, যেমন মায়ায় লিখে রাখছি এই, আমার কখনও না হওয়া এই বইয়ের ভূমিকা, বিরহ ও তৎপরবর্তী হরিণজন্মের কথা।”

==============================

আত্মহত্যার সম্পূর্ণ বিবরণী

ডাঃ প্রজ্ঞাদীপা হালদার

৯ঋকাল বুক্‌স

মুদ্রিত মূল্যঃ ৩০০/-

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ সমর্পিতা

 

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে