টপ টপাস কিম্বা ধপ ধপাস
ওই হয় না, মনে করুন, বর্ষাকালে
একটা সুন্দর রাস্তা দিয়ে আপনি হাঁটছেন। চারদিক কি সুন্দর। আপনি প্রাকৃতিক
দৃশ্যাবলী দেখতে দেখতে হাঁটছেন। এবং আপনি জানেন না কখন যেন পাকা রাস্তাটা দ্রুত
কাঁচা রাস্তায় পরিণত হয়েছে। আপনি টের পেলেন যখন, ততক্ষণে একটা আছাড় খেয়ে মাটিতে
চিত্তির হয়ে পড়েছেন।
গোয়েন্দা টাইপ দাদু-নাতি গল্প
পড়তে গিয়ে আমার এই হাল হল। মলাট দেখে মনে হল ভূতের গল্প। তারপর পড়তে পড়তে বুঝলাম
গোয়েন্দা গল্প। আর দাদু নাতিকে যেভাবে কোমল স্বরে সব অ্যাবিউসিভ টাইপ কথা বলছেন,
বর্তমান যুগের নাতি হলে দাদুর সাথে একটা খন্ডযুদ্ধ বেঁধে যেত হয় তো।
১
---
‘ইতি
তোমার মা’ কিম্বা ‘রুকু সুকু’-র পর ‘কলকাতার নিশাচর’ পড়তে গিয়ে আমার সেই অবস্থা
হল। চাহিদার যে উচ্চতায় পৌছে গিয়েছিলাম, ‘টপাস’ কিম্বা ‘ধপাস’ করে সেই চাহিদা
প্রপাত ধরণীতলে।
জানি,
সব লেখা একরকম ধারায় লেখা যায় না, কিন্তু লেখা পড়ার সময় যদি সন্দেহ হয়, এটা কি সেই
একই লেখকের লেখা, তাহলে বলতে হবে গোড়াতেই গুরুতর গন্ডগোল। কোন সিগনেচার নেই। ধারভার
নেই। আছে কেবল একটা মোটামুটি কিশোর গল্প খাড়া করার দায়। এটার প্রথম প্রকাশ কি বই
হিসাবে? না কি শারদীয়া পত্রিকা? ইদানীং শারদীয়া পড়ার অভিজ্ঞতা বেশ করুণ।
শব্দসংখ্যার দায় আর সময়ের দায় দিয়ে বেশ ফাঁকিবাজী রচনা করা যায়। লেখক কিম্বা
প্রকাশকেরা বোঝেন না, ফাঁকিবাজী তাতে চাপা থাকে না।
এই
গল্পে সবই বেশি বেশি। চোখে লাগার মতন বেশি বেশি। মানছি, কিশোর সাহিত্যে কল্পনার
আধিক্য প্রবল, কিন্তু তা বলে তারও তো একটা সীমা আছে! পটভূমিকা রাতের কলকাতা।
বেলেঘাটার পচা খালের পাশ দিয়ে দাদু-নাতি কাবলে বেড়াল খুঁজতে বেরিয়েছে। প্রথমে
বোঝার উপায় ছিল না মানুষ দুটোর চরিত্র সম্পর্কে। পড়তে পড়তে মনে হয়েছিল দাদু পাগল,
নাতি হাফ পাগল --- “মা আমাকে সঙ্গে পাঠিয়েছেন দাদুকে সামলাবার জন্য। বলা যায় না
ঝোঁকের মাথায় কখন কী করে বসেন!” তো এই দাদু-নাতি ভাঙ্গা গাড়ীর মধ্যে উকি মারে,
গাছের ডালে টর্চ মারে। এবং
এর ফাঁকে ফাঁকে দাদু দু-একটা বেশ ভালো ভালো জ্ঞানের কথা বলে। যুক্তি-তক্কের
অবতারণা করে। এইভাবেই আস্তে আস্তে রাস্তা ধরে এগোতে থাকে তারা। এর বাড়ী তার বাড়ী
উঁকি মারে। আস্তে আস্তে রেললাইন পেরিয়ে থানায় পৌছয়। তখন বোঝা যায় দাদু খুব বড়ো
ব্যরিস্টার। দুজনে রাত একটার সময় তাদের প্রিয় কাবলী বেড়াল খুঁজছেন।
আর এরই মাঝের ঘটনাক্রমটি কি? ---
“শোনো তা হলে, খালধারে ভাঙা মটরগাড়ী, তার ভেতরে পরচুল, পায়ের কাছে শব্দ করা আলুর
পুতুল, বন্ধ ডাক্তারখানায় তিনটে লোক, হার্টের গোলমালে একজন কাত, হা, হা, মা, মা,
মালগাড়ির পেটে শিশুর ক্ষীণ কন্ঠ, গাড়ি হাওয়া, লাইনে পেনসিল।”
এর ফলাফল কি? একজন আসামী
গ্রেফতার। তাও আবার একটা অপরাধ নয়। এই গল্পে কোন কিছুই বাঁধ মানে নি। একেবারে তিন-তিনটে
অপরাধ --- বাচ্চা চুরির অপরাধে অপরাধী অভিনেতা অসীমকুমার, নোটজালের অভিযুক্ত আসামি
কালু সর্দার, বম্বের নকল ডিরেক্টর, যে কি না পূর্ববছরে শতিনেক লোককে চিট করে হাওয়া
হয়েছিল। সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় কোন কিছুতেই থেমে থাকেন নি।
এই গল্পে ব্যারিস্টারের কথায়
পুলিশ ফুল ফোর্স নিয়ে বেরিয়ে যায়, সাথে সাথেই। এমনটা হয় কি? সরকারি কর্মচারীদের
নিয়ে কি আমরা এমনি এমনিই হ্যাটা করি? থানায় কি পরিমাণে হ্যারাস হতে হয় তা একটু
আধটু জানা আছে বৈ কি। আর সময় ব্যাপারটা এনাদের পায়ের কাছে পোষা বেড়াল, ও হ্যাঁ,
কাবলী বেড়ালটা বাড়ীর পাঁচিলে যেমন ছিল, তেমনিই পাওয়া গেল গল্পশেষে।
যাই হোক, এই নিয়েই একটা আস্ত
নভেলা। এক রাতের কলকাতা দর্শন। পড়তে পড়তে আমি একবার ঘুমিয়েও পড়েছিলাম। কে জানে
বাবা, মনে হয় আমি বড়ো হয়ে গেছি ---
“দ্যাখো আমি বাড়ছি মাম্মি”
২
---
এর পরের নভেলা, ক্যালিপসো
থ্রম্বোফব। পড়তে গিয়ে ঠোক্কর খেলাম। গরমকালে কলকাতাতে শিশির পড়ে? শিশির, না ধোঁয়াশা?
কিম্বা, এমন কি হয় যে, সারারাত যে বস্তুটা মাটিতে পড়ে আছে ভোরবেলায় তা ভিজে ভিজে
লাগবে, শিশিরপাতের জন্য? এমন নিঃশব্দ শিশিরপাত কলকাতায় সারা বছর পড়ে! হবেও বা।
কলকাতা আমার কাছে স্বপ্ননগরী। গেছি এক-দুবার। শুনেছি সেখানে কি না হয়, আর কি না
পাওয়া যায়। তেমন করে খুঁজলে হয়তো জলহস্তীর রোস্টও পাওয়া যাবে। জয় কলকাত্তাইয়া কালী
মাঈ কি...
যাই হোক, এই গল্পে গোয়েন্দা দাদু
ও তার অ্যাসিস্টেন্ট নাতি কিছুটা সপ্রভ হয়েছে। নাতি টকটকিয়ে কথা বলছে। এখানে
দুর্বৃত্তজনের হাতিয়ার সুপারসনিক সাউন্ড – কেউ কিচ্ছু টেরটি পাচ্ছে না। টেলিফোন
ধরলেই – হরিবোল। কি হরিবল্...! টেলিফোনের হেডপীসের মধ্যে দিয়ে কান ফুটো করে দিয়ে
মেরে ফেলা যাচ্ছে – “ওই রিসিভারের কানের অংশটি মারাত্মক, ওর মধ্যে এমন কোনও কল আছে
যা সুপারসনিক শব্দ তরঙ্গ ছাড়ছে, যে তরঙ্গের ক্ষমতা অসীম। স্পেনে, এক্সম্যান বলে এক
খুনি, ওই শব্দতরঙ্গ দিয়ে অনেক খুন করেছিল। নাইট অব দি বেলথাবাব বইতে পড়েছি।
বিশ্বাস না হয় রিসিভারের মুখে একটা কিছু চাপা দিয়ে দেখুন।”
মনে প্রশ্ন, সুপারসনিক শব্দ তারের
মধ্যে দিয়ে আসলে তো রিসিভারটারই তো আগে ফর্দাফাই হয়ে যাওয়ার কথা, যে শব্দ ল্যাম্পস্ট্যান্ড
কেটে দিচ্ছে, সেই শব্দ কি টেলিফোনের তার দিয়ে আনা-নেওয়া করা সম্ভব? কিম্বা তা দিয়ে
রিসিভার অক্ষত রাখা সম্ভব? ভাল কথা, উক্ত বইটা গুগলে সার্চ করে পেলুম না। না আতা,
না পাতা। এতএব এক্সম্যান লোকটা কিভাবে ওরকম একটা মোক্ষম শব্দকে করায়ত্ত করে মারতে
শুরু করল, জানা গেল না। যদি ক্যালকুলাসের কাছ থেকে পেয়ে থাকে, আলাদা কথা, হার্জে
মহাশয় জানেন। আরেকটা প্রশ্ন, খুনী শব্দবাণটি ছাড়লেন, অথচ বন্ধ করলেন না। ধরা পড়া
ন্যুনতম ভয় নেই তার! প্রমাণ রেখে যাচ্ছেন অবলীলায়। যেন মনে বলছেন, ধুস্... ও সব
আমার এক পাঁইট।
তারপর, এ গলি, সে গলি, এ সুড়ঙ্গ,
সে সুড়ঙ্গ দিয়ে দ্বিতীয় হুগলী সেতুর সামনে আসার পর, আসল খুনী অ্যাম্ফিবিয়াস গাড়ী
করে জল ছিটিয়ে গঙ্গা দিয়ে দে ছুট। এক্কেবারে ‘ফাস্ট এন্ড ফিউরিয়াস’ টাইপের
ব্যাপার। এ নির্ঘাত ডমিনিক টরেটোর আদিগুরু – ক্যালিপসো-থ্রম্বোফব।
এই হল গপ্পো। যারা ফেলুদা পড়ে,
কাকাবাবু পড়ে, মিতিন মাসী পড়ে তারা তো বটেই, এমনকি ব্যোমকেশ পড়া কিশোর-কিশোরীও
হেসে ফেলবে এমন আলুনী গল্প পড়ে।
দুটো গল্প, দুটো নভেলা, একটা বই। দেখনদারি এবং লেখনদারি
--- দুটোতেই --- “ভেরি ফিশি”...
================
কলকাতার নিশাচর
সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
আনন্দ পাবলিশার্স
মুদ্রিত মূল্যঃ ১০০/-
Comments
Post a Comment