ভোটান্তরযুদ্ধ

 



সন্ধ্যেবেলা। লেভেল ক্রসিং। আমি আর ভাই। ভাইয়ের বাইক। আমি আরোহী। ক্রসিং ডাউন। মস্ত মালগাড়ী। সবে ইঞ্জিন পেরোচ্ছে শামুকের গতিতে। ক্রসিং-এর উল্টোদিকে তিন মাথার মোড়। ঠিক রাস্তার পাশেই ছোট মঞ্চ। বক্তৃতা মঞ্চ। 

একজন যুবক। বক্তৃতার তোড়ে জগৎ ভাসিয়ে দিতে চাইছে। আশেপাশের চেয়ারে বসা মানুষ। কেউ চা খাচ্ছে। কেউ ব্যস্ত নীচুস্বরের আলোচনায়। কেউ বা উদার দৃষ্টি মেলে রেখেছে লাইনের তারে, রেলের চাকায়একটু দূরে পুলিশের উদাসীন পাহারা। 

যুবকের এত উচ্ছ্বাস! কেন? বিগত কয়েক বছরের হিসাব নিকাশ - ইতিহাস - আবেদন। মুখস্থ নয়, যেন তাগিদ। যুবকের আড়চোখ লক্ষ্য করলাম। ভাইয়ের আড়চোখ লক্ষ্য করলাম। দুজনের চোখ ত্রিভুজের অন্য যে বিন্দুর দিকে সেটা একটা জেরক্সের দোকান। মঞ্চের ঠিক উল্টোদিকে।

চোদ্দ-পনেরোর কিশোরীরাএকঝাঁক চিকন এবং স্ফীত, জিনস এবং সালোয়ার, লম্বা এবং বেঁটে শারীরী ভাষা প্রজাপতির মতো। এসেছে নোটস ফটোকপি করাতে। কোন কিছুকেই পাত্তা দিচ্ছে না তারা। ঝলমল করছে আলোর আড়ালে। আলোর মতো। রাজনীতি, ভোট আর একশো আঠাশ জন মানুষের দৃষ্টি উপেক্ষা করে তারা হেসে যাচ্ছে খিলখিলিয়ে। হাসতে হাসতে ঢলে পড়ছে একে অপরের গায়ে। তারা যুদ্ধ দেখেনি, মৃত্যু দেখেনি, বিদ্বেষ দেখে নি, চোরাগোপ্তা দেখে নি, বিশ্বাসঘাতকতা দেখেনি। 

উন্নত বুক, উদ্ধত মাথা। 

তাদের মাথার ঠিক ওপরে ফ্ল্যাটবাড়ীগুলোকে ছাড়িয়ে সন্ধ্যারাতের রক্তমাখা আকাশ হাসছে খিলখিলিয়ে, তাদের সাথে। সবুজ-হলুদ-কমলা-লাল পতাকার রঙ মাইকের শব্দের দাপটে ছিটকে ছিটকে গিয়ে লাগছে তার গায়ে। যত লাগছে তত তার খলখলে হাসি বাড়ছে। মেখে নিচ্ছে ঔদ্ধত্যের বিজয়রক্ত। বুকে বিদ্যুৎ। আর আকাশ জোড়া মেঘ। সময় হয়েছে ভাসিয়ে নেওয়ার। তখন চাঁদ ওঠেনি। 

আমি ভাসতে চাই। এ সব কিছু থেকে বেরিয়ে গিয়ে ভেসে যেতে চাই --- নদীর মতো, জলের মতো। নিবিড় তিমির প্রবল কালরাত্রি এসে আমায় জড়িয়ে ধরুক। বলুক, "আজি রজনীতে হয়েছে সময়, / এসেছি ওহে প্রধন্যা!' 

রাত হলসিন্ধুপারের চাঁদ উঠল আঁধার মেঘমালা ভেদ করে। হাসল সে। মেঘ ছিন্নভিন্ন হল। রক্তমাখা আকাশ এখন সাদা-কালোর স্নিগ্ধতায় মাখা। সে বলল, 

"রাজকুমারী, দেখুন চাঁদ উঠেছে।"

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে