I love you very much. Never forget that.
সিনেমাটা আমি কেন দেখতে চেয়েছিলাম
সেটাই আমার কাছে বিস্ময়ের। কারণ, আমি তো জানিই কি বলতে চাইছেন ডিরেক্টার Charlotte Wells, আমি জানি, তিনি কেন এই
ছবিটা বানাচ্ছেন। আমি জানি, পৃথিবীর সব বাবা-মেয়ে এমনই হয়। বাবারা অসহায়, মেয়েরা
রাজেন্দ্রনন্দিনী।
আমি এও জানি, পৃথিবীর সব বাবা এমন
নয়। অনেক পিতাই তার আপন পুত্রীকে শোষণ এবং নির্যাতন করেন। তারা পিতা নন। এমন অনেক
পুত্রীও আছেন, যারা পিতাকে নির্দয়ভাবে মনোকষ্ট এবং যন্ত্রনা দেয়। তারা কন্যা নয়।
অস্বাভাবিক কখনও স্বাভাবিকের তুল্য হতে পারে না। কখনও সাধারণ সম্পর্কের সংজ্ঞা,
এমনকি ব্যতিক্রম হওয়ারও যোগ্য হতে পারে না।
এখানে যদি আমি মনস্তত্বকে ধরে
এগোই, একটা বয়সের পর, বিশেষত এগারো-বারো বছর বয়সে, মেয়েদের মনে হয়, এবার তারা
পৃথিবীটাকে বুঝতে পারছে। ‘রজঃস্বলা’ মেয়েদেরকে এক ধাক্কায় অনেক অনেক বড়ো করে
দেয়। শরীরে, মনে তারা ভাবতে শুরু করে, তারা অনেক বড়ো হয়ে গেছে, তারা নারী হয়ে গেছে। বাইরের পৃথিবীর অসাধারণ
সমাজব্যাবস্থায় নারীদের স্বাভাবিকী ক্রিয়াকে তারা আপন করে নিতে চায়। আর এই চাওয়ার
ক্ষেত্রে, অধিকাংশ সময়ে, তাদের মনের কেন্দ্রস্থলে প্রথম আসে তার বাবা। আর
বাধাস্বরূপ হয়ে ওঠে তার মা।
ফ্রয়েড কমপ্লেক্সের কথা বলেছেন।
আমি মানি না। ফ্রয়েডের উক্ত কমপ্লেক্সের থেকেও জটিল এক রোম্যান্টিক সম্পর্কের
আবর্তে এই সম্পর্ক ঘুরতে থাকে। কন্যা চায়, এক অমোঘ টানে দুনিয়ার যাবতীয় ফোকাস তার
ওপর এসে পড়ুক। এবং এই ফোকাসের প্রথম চাহিদা পূরণের মাধ্যম হয় তার বাবা। সেই
চাহিদাকে সফল করার জন্য সর্বপ্রথম তারা চায় মায়ের স্থান নিতে। মায়ের সাথে এক অসম
সংগ্রাম চলতে থাকে। ঈর্ষা, হিংসা, দ্বেষ যে বিভ্রম তৈরী করে, তার মাঝখানে পিষে যান
এই পিতাঠাকুরটি।
এই চরম সংবেদনশীল সময়ে সম্পর্কে
যদি একবার শীতলতার সৃষ্টি হয়, বাকি জীবনে আর তা কমে কি? আমি জানি না। হয়তো কমে,
কিন্তু আমার মনে হয়, জোড়তাপ্পির রেখাটা থেকেই যায়। আর যদি ঘনিষ্ঠতা তৈরী হয়?
ইনসেস্ট? এক দেহজ চাহিদা? সেখান থেকে তৈরী হয় অপ্রাপ্তির এক অতৃপ্তি। যে সম্পর্কের ভিত্তি একটা
সুমধুর ভালোবাসা, সেই সম্পর্ক তখন এক মানবিক বিকারের জালে জড়িয়ে পড়ে এক অদ্ভুত
দূরত্ব সৃষ্টি করতে পারে। সেই সম্পর্কও আর জোড়া লাগে না।
পরিচালিকা ঠিক এই জায়গাটা থেকেই
তৈরী করতে চেয়েছেন সিনেমাটাকে। হাজার হোক, দুনিয়ার যাবতীয় বাপ-মেয়ে যে একই ধাতু
দিয়ে তৈরী। চাঁদের মতন অলখ টান তো সব বাপ-মেয়ের ধমনীর রক্তে। আচ্ছা, এটা কি
পরিচালিকার নিজের জীবনের এক টুকরো গল্প? গল্পটা তো লিখেছেনও তিনিই। আর কি সব
অপূর্ব চিত্রায়ন! Gregory
Oke-র সিনেমাটোগ্রাফি যেন ফটোগ্রাফির ছোট ছোট কোলাজ। যে ছবির ফ্রেম
অনেকক্ষণ ধরে দর্শকের সামনে থাকে, মিলিয়ে যায় না, প্রতিটা রঙের পরতে পরতে থাকে
গল্পের অনেক কথা, অনেক অনুভূতি বয়ে চলে সময়ধারার মতন। এখানে এডিটর Blair
McClendon-কেও বাহবা দিতে হবে। কাঁচি চালানোর টাইমিংটা যেন, দেখতে
দেখতে, মনে হচ্ছিল, এই বুঝি বেশি হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু না, একদম মোক্ষম সময়ে ফ্রেমটাকে
কেটে দিয়ে তিনি বুঝিয়ে দেন, ‘টাইমিং’ ব্যাপারটাকে তিনি কতটা তালুবন্দী করে
রেখেছেন। সেই সঙ্গে Oliver Coates-এর ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের
রেশ সিনেমাটা শেষ হওয়ার পরেও থেকে যায়, কোথাও যেন সিনেমার আত্মা সুরের রেশ হয়ে
আমার আত্মাকে জড়িয়ে ধরে, আমার হৃদপিন্ডটাকে মোচড়াতে থাকে এক অব্যক্ত বেদনায়। আমি
যখন এই লেখাটা লিখছি, তখনও পাশে বেজে মিউজিকটা।
বাবা Paul Mescal, মাত্র
তিরিশের আশেপাশে বয়স তার। মেয়ে Frankie Corio, এগারো বছর।
তারা ছুটি কাটাতে যায় তুর্কীতে। বাবা বিবাহ বিচ্ছিন্ন। একা থাকে। মেয়ে থাকে মায়ের
কাছে। বাবা মেয়েকে স্বভাবতই সময় দিতে চান, ফলে দুজনে ছুটি কাটাতে যায়। মেয়ের অপার কৌতুহল, কেন
এমন হল তার বাবা-মায়ের মধ্যে। তার বাবার পরশ সে কেন আরও বেশি করে পেল না। তার বাবার
গায়ের গন্ধ, চোখের স্নেহমাখা দৃষ্টি, দুই বাহুর উষ্ণতা, আনন্দের উচ্ছ্বাস --- এ সমস্ত থেকে সে কেন বঞ্চিত। এমনকি তার মনেও
হয়েছে, এ বেশ ভালোই হয়েছে। সে, একমাত্র সে-ই এমন নিবিড় করে বাবাকে পাচ্ছে এখন। মায়ের সাথে বিচ্ছেদ হয়েছে
বলেই না তার আই সৌভাগ্য। এখন যদি মা থাকত, সে কি পারত এমন করে ডিস্কোতে বাবার বুকে
নিজেকে মিশিয়ে দিয়ে নাচতে? সে কি পারত বাবার কোলে চেপে, গলা জড়িয়ে ধরে এমন
স্নেহনিবিড় আলাপ করতে? সে কি পারত, পরম সুখে ঘুমানোর সময়ে বাবার স্নেহমাখা হাত আর
ঠোঁটের স্বর্গীয় স্পর্শ তার কপালে, নাকে, গালে, চুলে?
এক-একসময় সে আর তার বাবা যেন
সমবয়সী হয়ে যায়। আর সেখানেই সে বুঝতে পারে না যে তার সীমারেখাটা ঠিক কোনখানে। যখন
কেউ তাকে তার বাবার বোন ভাবে, সে খুশিই হয়। যখন বাবা তাকে বকে, সে বড়দের মতো করে,
বলা ভাল, মায়ের মতো করে বাবাকে আঘাত দিতে পারে, টাকা-পয়সার খোঁটা, যেমনটা হয়তো সে
তার মা-কে দিতে দেখেছিল। আবার যখন মধ্যরাত্রে মাতাল বাবা তার নগ্ন দেহ নিয়ে
বিছানায় অঘোরে ঘুমাচ্ছে, সে তখন তার মায়ের মতো করে, কিম্বা বড়ো হয়ে যাওয়া মেয়ের
মতো বাবার গায়ে চাদরটা টেনে দেয়, সস্নেহে।
বাবা বেচারা কিছুই বুঝতে পারে না।
তার আত্মজাকে সে কিভাবে গ্রহন করবে? সে তো এখন আর ছোটোটি নেই। অথচ এমন কিছু বড়োও
হয় নি যে তার সাথে বড়োদের মতো করে মিশতে হবে। মেয়ের রাগ, অভিমান, আবদার তাকে
বিব্রত করে না। তাকে বিব্রত করে মেয়ের স্নেহ। মেয়ের আদর। মেয়ের ভালোবাসা। বাবা কেঁদে ফেলে। সে
কান্নার সাক্ষী থাকে দর্শক আর হোটেলের সেই সবুজ দেওয়ালটা। বাবা ভিডিও করে রাখে এই
স্মৃতিমধুর সময়টাকে। এমনকি সবশেষে বিমানবন্দরে মেয়ে যখন বারবার ফিরে তাকায় একটার
পর একটা বাঁকে, থামের আড়াল থেকে তার দিকে তাকিয়ে থাকে, টা টা করে মিস্টি হাসি
ছড়িয়ে দিয়ে, সেই মধুর দৃষ্টিটাকে ধরে রাখতে চায় নিজের বুকে। আর ধরে রাখে ভিডিও
ক্যামেরায়।
তার মেয়ে বড়ো, অনেক বড়ো, বাবার মতো
বড়ো। সে বাবার দিকে তাকিয়ে থাকে এক অমোঘ স্নেহময় দৃষ্টি দিয়ে। বাবা যখন তার সাথে
অন্যায় করার জন্য ক্ষমা চায়, বারবার, সে যখন বাবাকে ‘It’s Ok’ বলেও
থামাতে পারে না, তখন, সে প্রতিটা ক্ষমাপ্রার্থনার উত্তরে আলতো করে বাবার গায়ে হাত
বুলিয়ে দেয়, মাটিমাখা হাত মাটির মতোই সুশীল, ঠান্ডা, স্নেহশীলা, বলতে চায়, আমি আছি
তো তোমার পাশে, তুমি যতই বকো, আমি তোমায় ছেড়ে যাব না। বাবার হৃদয়ে নিজের হৃদয়
কেমনভাবে সে মেশাবে? বাবাকে নকল করে, বাবার হাবভাবকে নকল করে। মেয়ে যেন বাবা হয়ে
যেতে চায়, বন্ধুর মতো বাবাকে বলে তার প্রথম চুম্বনের অভিজ্ঞতা। সে বাবার জন্মদিন পালন করে যারা
সেখানে ঘুরতে এসেছিল সেই সব অপরিচিত পর্যটকদের সাথে কথা বলে সমস্বরে তার উদ্দেশ্যে
গান গেয়ে। বাবার
জন্যে সে এক পৃথিবী আত্মীয় জোগাড় করতে পারে। সে কেবল বাবাকে একটা কথাই বলতে চায়, আমি তোমার মেয়ে, আমি
তোমার, আমিই তুমি... পারে না। বদলে বলে, আমরা চিরদিন কেন এই হোটেলটাতে থেকে যেতে
পারছি না? যে সময়টাকে সে প্রাণপণে আটকে রাখতে চাইছে, তুর্কির এক মায়াভরা হোটেলে,
সেই সময়ও চলে যায়। থেকে যায় সেই সময়ের ভিডিও, বাবার কিনে দেওয়া একটা কার্পেট, আর
বাবার হাতে লেখা স্মৃতিবিজড়িত একটা পোস্টকার্ড। তাতে লেখা,
I love you very much. Never
forget that. ~ Dad
=============================
Aftersun
Directed By: Charlotte Wells
Cast: Paul Mescal, Frankie Corio, Celia Rowlson-Hall
Duration: 101 minutes
OTT Platform: MUBI
Comments
Post a Comment