প্রকৃতির প্রতিশোধে ‘অচ্ছুৎ’ সমস্যা
আমার রবীন্দ্রনাথ – পর্ব ১০
১৮৮৪ সালে রবীন্দ্রনাথের বয়স
মাত্র ২৩ বছর। প্রকাশিত হল ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ’। যা প্রকৃতপক্ষে একটি ‘নাট্যীয়’,
অর্থাৎ, যা ‘আত্মগত নয়, কল্পনায় রূপায়িত’, রবীন্দ্ররচিত প্রথম কাব্যনাট্য। ১৮৮৩
সালের মার্চ মাসে রবীন্দ্রনাথ কারোয়ারে যান তার মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের
কাছে, সঙ্গে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাদম্বরী দেবী। কিছুদিন পরে জ্ঞানদানন্দিনী
দেবী নিজ পুত্র-কন্যা সুরেন্দ্রনাথ ও ইন্দিরা সমভিব্যাহারে তাদের সাথে যোগ দেন। এইখানেই
তিনি এমন এক বোধের স্বরূপের সাথে পরিচিত হন, যার ফলস্বরূপ কবিতার ঘরানা বদলে যায়
(ছবি ও গান), রচিত হয় কিছু ব্যাঙ্গগদ্য, এবং ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ’ নামক এক
অভূতপূর্ব কাব্যনাট্য। জাহাজে ফেরার পথেই এটির কতকগুলি গানও রচনা হয়ে যায়, যার প্রথমটি
‘হেদে গো নন্দরাণী’। উক্ত কাব্যনাট্যে মূল চরিত্র দুটি – সন্ন্যাসী ও বালিকা।
অন্যান্য বহু চরিত্র এসেছে এবং গেছে, কিন্তু মূল বিষয়টা এই দুই চরিত্রকে ঘিরেই গড়ে
উঠেছে।
মূল বিষয়টা কি? রবীন্দ্রনাথের
ভাষায়, “ক্ষুদ্রকে লইয়াই বৃহৎ, সীমাকে লইয়াই অসীম, প্রেমকে লইয়াই মুক্তি। প্রেমের
আলো যখনই পাই তখনই যেখানে চোখ মেলি সেখানেই দেখি, সীমার মধ্যেও সীমা নাই।” একদম
শেষ বয়সে রচনাবলীর জন্যে সূচনায় লিখছেন, “... শূন্যতার মধ্যে নির্বিশেষের সন্ধান
ব্যর্থ, বিশেষের মধ্যেই সেই অসীম প্রতিক্ষণে হয়েছে রূপ নিয়ে সার্থক, সেইখানেই যে তাকে
পায় সেই যথার্থ পায়।” আবার ‘আলোচনা’ নামক অচলিত সংগ্রহের একদম প্রথমেই ‘ডুব দেওয়া’
এবং ‘জগৎ সত্য’ নামক ছোট্ট দুটি প্রবন্ধে এর বিস্তারিত আলোচনাও পাওয়া যায়।
বাস্তবিক, ‘ছবি ও গান’
কাব্যগ্রন্থের ‘যোগী’ কবিতায় এই সন্ন্যাসীর আভাস পাওয়া গেলেও একটু ভাল করে দেখলে
বোঝা যায়, যোগী’র সন্ন্যাসী আর প্রকৃতির প্রতিশোধে’র সন্ন্যাসীর মধ্যে পার্থক্য
মূলত অহংকারের। প্রথমজন সমস্ত কিছুকে আপন করে নিজেকে বিলিয়ে দিতে চাইছেন, অপরজন
জেতার অহংকারে ফেটে পড়তে চাইছেন। ফলে কবিতার থেকে কাব্যনাট্যের সন্ন্যাসী অনেক বেশি অন্তর্দ্বন্দ্বে
ভুগেছেন।
যে বিষয়ের কারণে এই কাব্যের
প্রতিষ্ঠা, তার বীজ কিন্তু নিহিত হয়েছিল ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ কবিতার বোধের
নির্যাস থেকে। এখানেও বারবার তিনি সন্নাসীকে সত্যরূপ সুন্দর এবং মায়ারূপ সুখের
জটিলতার দ্বন্দ্বে ফেলছেন, “ধীরে ধীরে মোহময় মরণের ছায়া / কেন রে আমারে যেন
আচ্ছন্ন করিছে!” সপ্তম দৃশ্যে সন্ন্যাসীর সংলাপে স্পষ্ট বোঝা যায় জগতের অসীম
সৌন্দর্যচেতনার যে পরিচয়কে সন্ন্যাসী নস্যাৎ করতে চাইছেন, সেই সৌন্দর্যের পরাচেতনা
জড়িয়ে রয়েছে প্রভাতসংগীতের পাতায় পাতায়। কবিতার ছত্রে ছত্রে যাকে আমরা বাঁধনছাড়া উচ্ছ্বাস হিসাবে
দেখছি, সেটাই এই কাব্যনাট্যে শব্দের বাঁধনে পোক্ত এবং ছন্দময় ভাষার নাটকীয় দ্যোতনায়
উজ্বল।
কিন্তু, আমি এ নিয়ে কথা বলতে
চাইছি না। কারণ এ নিয়ে বহু আলোচনা আগেও হয়েছে, নতুন কিছু নয়। এই কাব্যনাট্য পড়তে গিয়ে
একটা অংশ আমাকে ভাবাল। আমি বারে বারে সেই অংশটাকে পড়লাম। এবং মনে হল, এ নিয়ে
আলোচনা যদি আগে না হয়ে থাকে, তাহলে এখন হলে ক্ষতি কি? অন্তত রবীন্দ্রনাথের অসংখ্য
আলোকোজ্জ্বল ছটার একটি রশ্মির মুগ্ধতা আপামর রবীন্দ্রপ্রেমীর সাথে শেয়ার করা যেতেই
পারে।
তৃতীয় দৃশ্যে যেখানে ‘বালিকার
প্রবেশ’ হচ্ছে, দেখা যাচ্ছে, সেখানে নগরবাসী তাকে ঠাঁই দিতে চাইছে না, শুধু তাই
নয়, নগরের মূল দেবীমন্দির, যেখানে মানুষের শান্তির আশ্রয়, সেখানেও এই বালিকার ঠাঁই
নেই – “দূর হ! দূর হ তুই অনার্যা অশুচি! / কী সাহসে এসেছিস মন্দির মাঝে!”
চন্ডালিকা ছাড়া তার আর কোন লেখায়
এমনভাবে অচ্ছুৎ সমস্যার পরিচয় পাওয়া গেছে কি? তেইশ বছরের রবীন্দ্রনাথ অচ্ছুত
সমস্যাকে দেখছেন কীভাবে? “অনার্য, অশুচি ও যে ম্লেচ্ছ ধর্মহীন---”। কি সাংঘাতিক
চারটে শব্দে অচ্ছুৎ মানুষের পরিচয় ঘটছে! তৎকালীন ভারতবর্ষে এই অন্তজ জাতির
নির্বিশেষ শোষনের দৃশ্য তার কি চোখে পড়েছিল? মনে রাখতে হবে, সেই সময় মহাত্মা
গান্ধীর বয়স মাত্র পনের বছর, রামস্বামী পেরিয়ারের বয়স সবে ছয় বছর পেরোচ্ছে, আর
বাবাসাহেব আম্বদকরের জন্মাতে আরও আট বছর বাকী। একমাত্র মহারাষ্ট্রে জ্যোতিরাও এবং
সাবিত্রীবাঈ ফুলে এই কাস্ট সিস্টেমের বিরুদ্ধে পুরোদমে লড়ছেন।
আমরা জানি, রবীন্দ্রনাথ বিলেত
যাওয়ার পূর্বে বেশ কিছুদিন বোম্বাইতে ছিলেন। তখন কি এরকম শোষণ এবং অবিচার তার চোখে
পড়েছিল? কিম্বা স্থানীয় কাগজ থেকে এই ‘ফুলে’ দম্পতির কথা জেনেছিলেন? কিম্বা কোন
মর্মান্তিক দুর্ঘটনার সাক্ষী হয়েছিলেন, প্রত্যক্ষ কিম্বা পরোক্ষে? সংবেদনশীল
রবীন্দ্রনাথ মনে মনে কি এতদিন অপেক্ষা করেছিলেন এর যোগ্য জবাব দেওয়ার জন্য?
কাব্যনাট্যে সরাসরি না হলেও এই অভিঘাতকে তিনি ছোট করে দেখেন নি এবং একমাত্র
সন্ন্যাসী সম্প্রদায়কেই এর রক্ষাকর্তা হিসাবে দেখছেন। তাই তিনি সেই সন্ন্যাসীর মুখ
দিয়েই অশুচিতার যোগ্য জবাব দিচ্ছেন --- “সকলেই তাই। / সেই শুচি ধুয়েছে যে সংসারের
ধূলা। / দূরে দাঁড়াইয়া কেন! ভয় নাই বাছা।”
আমরা জানি, সমগ্র ভারতবর্ষে, আজও,
সন্ন্যাসীর সমাজচেতনা দৈনন্দিন জীবনে কতটা প্রভাব ফেলতে পারে। সেই কারণেই কি সেই
সম্প্রদায়ের কথাই মাথায় আসছে মুক্তিদাতা হিসাবে রবীন্দ্রনাথের? চরম দুঃখে, এক
পৃথিবী অসহায়তা নিয়ে তার কাছে এসেই অবশেষে অচ্ছুৎ বালিকা বলছে, “প্রভু, প্রভু,
দয়াময়, তুমি পিতা মাতা, / একবার কাছে তুমি ডেকেছ যখন / আর মোরে দূর করি দিয়ো না
কখনো।”
বহু বছর পর, জাতির পিতা, সেই
অচ্ছুৎ অশুচি ভারতবর্ষকেই ‘হরিজন’ আখ্যা দেবেন, আর বলবেন,
“মুছ অশ্রুজল বৎসে, আমি যে সন্ন্যাসী।
নাইকো
কাহারো 'পরে ঘৃণা-অনুরাগ।
যে
আসে আসুক কাছে, যায় যাক দূরে,
জেনো
বৎস মোর কাছে সকলি সমান।”
সেই সন্ন্যাসী আর এই সংসারী একই
হৃদয়বেদনায় জর্জরিত হয়ে নির্মান করলেন এমন এক পথ, যে পথ সামাজিক সচেতনতার পথ; অনেক
দিনের মোহ অন্ধকার ক্ষয়ের পথ; মানুষের প্রতি মানুষের অপমানের উপসংহারের পথ।
=================
ছবির পান্ডুলিপিটি প্রকৃতির
প্রতিশোধ সম্পর্কিত কবির স্বহস্তে লিখিত একটি পৃষ্ঠা।
তথ্যসূত্রঃ রবীন্দ্র রচনাবলী (সুলভ সংস্করণ) – ১, ৯, ১৫,
প্রকৃতির প্রতিশোধ, জীবনস্মৃতি, প্রভাতসংগীত, আলোচনা, রবীন্দ্রজীবনী – প্রভাতকুমার
মুখোপাধ্যায়, ইন্টারনেট।
[ছবি কৃতজ্ঞতাঃ সমর্পিতা]
ভালো লাগলো ৷
ReplyDelete