জন-অরণ্যের এক টুকরো ভীড়ের গল্প

 


সে একটা সময় ছিল...

কিছু মানুষ ফিরতে চেয়েছিল। তার আপন চিরপরিচিত মাটিতে, যে মাটিতে সে জন্ম নিয়েছিল। যে মানুষ পেটের টানে যাযাবর হয়, সেই মানুষই বেঁচে থাকার টানে আবার ঘরে ফিরতে চায়। তেমনই কিছু মানুষ কপর্দকশূন্য হয়েও ফিরতে চেয়েছিল। খালি পায়ে, কিম্বা খালি গায়ে; শক্ত সামর্থ্য অবস্থায়, কিম্বা ধুঁকতে ধুঁকতে; অসহায় অবস্থায়, কিম্বা রাজার মতো; ফিরতে চেয়েছিল তারা সবাই, কেউ পেরেছিল, কেউ পারেনি...

একদিন এমনই কিছু ঘুমন্ত মানুষের ওপর দিয়ে চলে যাওয়া মধ্যরাতের ট্রেন তাদের চিরনিথর করে দিয়েছিল। সেই ট্রেনটা কি এখনও চলছে? তার ড্রাইভার কেমন আছে এখন?

বারো বছরের কিশোরী চারদিন টানা হাটার পর রাস্তাতেই শেষ নিঃশ্বাস ফেলেছিল, হয়তো তার মায়ের কোলে তখন তার থেকে তার আশ্রয়ের দূরত্ব মাত্র পঞ্চাশ কিলোমিটার!

কয়েকটা লরি, বাস কিম্বা ট্রেলার ট্রাক আজও কি পড়ে আছে এককোনে, নিঃশব্দে, লোকচক্ষুর অন্তরালে? তাদের চালকেরা কি আজও ভুলতে পারে সেই ঘটনাকে, যেখানে তারা নিজেদের অজান্তেই পিষে দিয়েছিল পথের মাঝে, কিম্বা পথের ধারে পড়ে থাকা ঘুমন্ত পরিযায়ীদের, যে পরিযায়ীরা নিজগৃহে পরবাসী, যাদের সেখানে থাকার কথা ছিল না কোনোভাবেই? রাজ্যের সীমান্তের সামনে দাঁড়িয়ে যারা জানতে পারে, তারা বর্ডারে দাঁড়িয়ে আছে, যে বর্ডার আসলেই ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’, সেই ল্যান্ডেই গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে তারা উপলব্ধি করে --- তারা অনুপ্রবেশকারী, তারা উদবাস্তু।

সেই রাজা-রাণীদের কি হল? যারা বেরিয়েছিল পথে-প্রান্তরে? পথের টানে নয়, পথ শেষের গন্তব্যে। তারা কেমন আছে আজ? টাকার গদিতে থাকা সত্ত্বেও তারা সেদিন পরিযায়ী। অর্থ তাদের রাস্তা পরিস্কার করতে পারে নি। তাদেরও হয়তো কিছুক্ষণের জন্যে বর্বর হতে হয়েছিল। বর্বর হতে গেলে কি কেবল হৃদয়শূন্য হতে হয়? হৃদয়-পুত্তলির জন্যেও হৃদয়হীনা হওয়া যায়।

অনেক কিছুই স্মৃতিতে ভাসে। যে স্মৃতি আমরা ভুলে যেতে চাই। আপনজনকে আমরা দেখতে পাই, হাসপাতাল কিম্বা নার্সিং হোমের মেঝেতে শোয়ানো। বেড নেই। চাইলেও নেই। ঘুষ দিলেও নেই। মন্ত্রী বললেও নেই। ভয় হত, মৃত্যু এলে প্লাস্টিক বন্দী দেহটাকে আর দেখা যাবে না। কোনো চোরাপথের ফার্নেস হয়ে কিম্বা আধপোড়া, কিম্বা না-পোড়া দেহ নদীর জলে ভেসে যাবে কোনো মানুষ তার খবর রাখবে না, এমনকি যে ভাসাচ্ছে সে-ও, লাশ একদিন থমকে যাবে নদীর পাড়ে, কিম্বা আধপোতা বালিতে

সেই ভীড়ের আতঙ্কের মধ্যেও জাতপাতের নিষ্ঠুরতা ছিল, ঈশ্বর-নিরীশ্বরের দ্বন্দ্ব ছিল। মানুষ তখনও ভোলে নি, ভুলতে পারে নি, এখনও ভোলে নাহয়তো এই দ্বন্দ্ব মৃত্যুরও ঊর্ধ্বে বলেই ভোলা যায় না। আপন সন্তানের ক্ষুধার্ত কান্নাকে উপেক্ষা করেও ফিরিয়ে দেওয়া যায় খাদ্য এবং অবশেষে, সে-ই রাইফেল হাতে তুলে নেয়, এক প্যাকেট খাবারের জন্য।

রাজকুমার রাও, পঙ্কজ কাপুর, ভুমি পেন্ডেকার, আশুতোষ রাণা, দিয়া মির্জা এবং আরও অনেকে মিলে তৈরী করেছে একটা সিনেমা, নাম ‘ভীড়’। মধ্যমণি অবশ্যই অনুভব সিনহা। তারই লেখা, তারই প্রযোজনা, তারই পরিচালনা। শাহরুখ খানের এক হাজার কোটির ছায়াছবি কিম্বা দক্ষিনী ছবির মারকাটারি ভিড়ে আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে অনুভব সিনহার এই মাস্টারপীস। বাঙালীরা ‘রকি’ কিম্বা ‘পুষ্পা’র জন্যে রাত থেকে হলে লাইন দিয়েছেন। হয়তো তারা ভুলে গেছেন, অনেকগুলো বাঙালী পায়ের ছাপ একদিন পথের মাঝে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে এই সিনেমার গল্পটার মতোই, যারা আর আসবে না তাদের চিরপুরাতন এই ধানসিঁড়িটির তীরে...

======================

BHEED

Cast: Rajkumar Rao, Bhumi Pendekar, Pankaj Kapoor

Directed By: Anubhav Sinha

Duration: 114 mins

OTT Platform: Netflix

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে