আমি আর আমার সাইকেল


একদিন চলে গেলেই হয়। যেদিকে দুচোখ যায়। আমার প্রাণপ্রিয় সাইকেল আমায় ডাকে। বলে, চল্ সেই দিকশূন্যপুরে, নীল দেওয়ালের আবডাল পেরিয়ে, ধূসর মলিন মেঠোপথের সীমানা ছাড়িয়ে, দুঃখভরা সর্ষেক্ষেতের ঠিক মাঝখান দিয়ে আমার সাইকেল কি আমায় নিয়ে যেতে চায় সেখানে?

যেতে পারি। কিন্তু তবুও যেতে পারি না।

এই মরমী পৃথিবীতে আমার সাথে আমার সাইকেলই তো ছিল একমাত্র। একবুক দুঃখের বোঝা যখন আর আমি বইতে পারতাম না, সেই আমাকে বয়ে নিয়ে আসত আমার ঘরের কোনায়, শান্তিনীড়ে। তীব্র আনন্দের বিষে যখন আমার সারা শরীর জর্জরিত, সুখের মায়াময় মাদকতায় যখন আমার প্রাণ ওষ্ঠাগত, আমার সাইকেল তখন আমায় নিয়ে গেছে বাটখাড়ার মাঠের প্রান্তরে। সে প্রান্তরে পাগলের মতো ঘুরে ঘুরে নেচেছি আমি, আমার স্কার্টের ঝুল নাগরদোলার মতো ঘুরেছে সুতীব্র উচ্ছ্বাসে, আমার সাইকেল ছিল সে আদিম নাচের নীরব দর্শক।

বৃষ্টিবিহীন বৈশাখী দিনে কাঁচা আম কুড়ানোর বন্ধুনী-সংকেত, কিম্বা কালবোশেখীতে আমার হতভাগাকে ক্যারিয়ারে বসিয়ে ঝড়ের বেগে উড়ন্ত ধূলা-ঢেউয়ের মধ্যে সাতারের অপার্থিব আনন্দ দিয়েছে আমার সাইকেল। সেই সাথে তার দুষ্টুমিও টের পেয়েছি। রাস্তায় অযথা ঝাকুনি দিয়ে হতভাগার দুটো নিবিড় হাত আমার কোমর জড়িয়ে ধরেছে প্রবল পরাক্রমে। আমার পিঠে নিজের বুক চেপে ধরে, কাধে মাথা রেখে আমার উড়ন্ত চুলের গহীনে হারিয়ে গিয়ে এক হয়ে যেতে চেয়েছিল সে। মিঠে চুম্বনের চাইতেও মিঠেকড়া সে সুখ

সাইকেল সংকেত দিয়েছে আমায় সন্ধ্যাবেলার রক্তিম মরীচিকার। ধানক্ষেতের আলে শুয়ে থেকেছি আমি আর আমার সাইকেল। আলের দুধারে মাথা উঁচু করা ধানের শিষ। আমায় কেউ দেখতে পায় না। আমি কাউকে দেখতে পাই না। দিগন্ত বিলীন। কেবল একটুকরো আকাশে শরৎ মেঘের রক্তিম মারকাটারি রঙের লেখা। যে লিখন বলে, এখনও কি সময় হয় নি তোর? এখনও কি ছুটি হয় নি?

কে ডাকে? কে ডাকো আমায়? তোমারও কি সাইকেল আছে? আমায় বসিয়ে নিয়ে যাবে তোমার কাছে? আমার কি ছুটি হবে না? আমার সাইকেলের ক্রীংক্রীং থেকে তোমার কাছে ছুটির আবেদন তো পাঠিয়েছি কতবার। তোমার সাইকেলের ক্রীংক্রীং থেকে আবেদন মঞ্জুর হওয়ার সংকেত আসবে কবে?

অপেক্ষায় থাকি। আমি আর আমার সাইকেল।

===========================

[আজ বিশ্ব সাইকেল দিবস]

[ছবি কৃতজ্ঞতাঃ সমর্পিতা]

[বিঃ দ্রঃ – এটা আমার সাইকেল না... এটার মতোই দেখতে আমার মেয়ে-সাইকেলটা। সে পোজ দিতে চায় নি সমর্পিতাকে আমার সাথে। কেন? জানি না।]

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে