সেই দাদাটি এবং ‘দেশ’-এর একটি প্রবন্ধ


 

সম্প্রতি ফেসবুকের এক জনপ্রিয় বই গ্রুপে আমার একটা দাদা জুটেছে। বড়ো ভালো সে দাদা। আমার প্রত্যেকটা লেখাকে সে সযত্নে, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ে আদরের সাথেলেখার ধার, ভার এবং ওজন যাচাই করে তারপর আমার সমালোচনা করে।

      আমি তার নাম রেখেছি – ‘হিজিবিজিবিজ দাদা’

      দাদাটি প্রথম প্রথম আমার যত লেখা পড়তেন, এবং এমনকি কমেন্টসও, কেবল ‘হা হা’ প্রতিক্রিয়া দিয়ে আসতেন। হাসির কথা হোক কিম্বা কান্নার কথা --- সবকিছুতেই ‘হা হা’যতই বলতুম, হাসি দিয়ে কি কিছু বোঝা যায়, ও দাদা, আপনি কিছু তো বলুনকিন্তু তিনি কিছুই বলতেন না, খালি হাসতেন। দিন কয়েক পর সেই দাদা কমেন্টস করতে শুরু করলেন, অনেকটা জাহাজের পেছনের গাধাবোটগুলোর মতো। যারা এসে আমার কমেন্টসে বাদ-বিবাদ-প্রতিবাদ করছেন, সেখানে এসে তাদেরকে বলতে লাগলেন, আপনি ঠিক কথা বলেছেন, আমার এই বোনটা এক্কেবারে গন্ডমূর্খ! সেই সময়ে আমার তাকে ‘হীরক রাজার দেশে’র বিদুষক মনে হতোরাজার ‘ঠিক কি না’-র উত্তরের সবকিছুতেই, ‘ঠিক ঠিক’। এবং অবশেষে একদিন আক্রমণ, তাও আবার বানান ভুল নিয়ে! লেখার কনটেন্টস নিয়ে ওনার কিছু যায় আসে না, আলোচনার গাম্ভীর্যতা নিয়ে পাত্তা দেন না। কেবল, লেখকদের সন্মানহানি আর বানান ভুল নিয়ে ওনার বেজায় মাথাব্যাথা, শুধু তাই নয়, লজিকের উত্তরে উনি কেবল একটাই কথা বলেন, ‘খামোশ! মেয়েমানুষ! বড়ো বাড় বেড়েছিস তুই...’

এই দাদার কথা কেন? কারণ এবারের দেশ পত্রিকায় দীপেশ চক্রবর্তীর লেখাটা পড়তে পড়তে ওনার কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল খালি খালি। শেষের দিককার ওনার আক্রমণের ভাষা থেকে আমি বুঝতে পেরেছিলাম, কার্টুন চরিত্রের আড়ালে, লক করা প্রোফাইল নিয়ে আমার এই দাদাটি নিশ্চই কোন এক বা একাধিক প্রকাশকের প্রাণের মানুষ এবং হয়তো বা, প্রুফ রিডার। যারা কেবল খুঁত খোজে তারা রিভিউকার হতে পারে নাদোষদৃষ্টি সত্যদৃষ্টিকে ঢেকে দেয়। ওনার ঠিক তাই হয়েছে।

কিছুদিন আগে উনি আমাকে চোরের মা বললেন, আর বললেন, আমি পাইরেটেড বই পড়ে চুরি সমর্থন করে গলাবাজি করি ইত্যাদি ইত্যাদি। বুঝলাম, এই দাদাটি সোনার চামচ মুখে নিয়ে মানিপ্ল্যান্টের ওপর বসে আছেন। উক্ত গ্রুপে ওনার পোস্টগুলো দেখে এও বুঝলাম, বছরে এক-আধবার উনি কোন ইংরাজী বইয়ের বক্সসেট কেনেন আর ভাবেন, প্রচুর বই কিনে ফেলেছেন। কিন্তু যারা গ্রামে বা মফস্বলে থাকে, প্রচুর বই কেনার সামর্থ্য যাদের নেই, যেখানে লাইব্রেরী নেই, বই অর্ডার দিলে আসতে লাগে কয়েকদিন (বাংলাদেশের বই আসতে একমাসেরও বেশি), অনেক কষ্টে পয়সা জমিয়ে বই কিনতে হয়, অথচ পড়ার ক্ষিধা আছে প্রচন্ড, তারা কি করবে?

“হতে চাই না, তবু বইয়ের ডিজিটাল কপির শরণাপন্ন হতেই হয়। কোনও একটি বইয়ের আশু প্রয়োজন, লাইব্রেরীর কপিটি কেউ পড়তে নিয়েছেন, অ্যামাজনে কিনতেও দু’-তিনদিন লাগবে, নিজের আরও দশটা কাজ আছে, ইন্টারনেট ঘেঁটেও বইটা পাই না --- এমন সময় কি করা যাবে?” দাদাটির পাশাপাশি দীপেশ চক্রবর্তীও জানেন না, বর্তমানে মফস্বলে বা গ্রামাঞ্চলে লাইব্রেরী থাকা না থাকা একই, শুধু তাই নয়, বিদেশি বইয়ের খোঁজ নিতে গেলে লাইব্রেরীয়ান মহোদয় এমনভাবে তাকাবেন, যেন আমি এলিয়েনদীপেশবাবুর এই প্রবন্ধে লাইব্রেরী বিভীষিকা নিয়ে সোচ্চার হওয়া উচিৎ ছিল। অবশ্য উনি যদি কলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের লাইব্রেরীগুলো কথাই ভেবে থাকেন, তাহলে আলাদা কথা।

আমি আমার দাদাটিকে উত্তরে বলি, বেশ করেছি পাইরেটেড কপি পড়েছি, আরও পড়ব। আমার পেছনে না লেগে লাইব্রেরীগুলো উন্নতি করার পেছনে লাগুন, সার্থক হবে আপনার জীবনটা। আমি আপনার জন্যে একটা বিজয়মাল্য গাঁথা লিখব।

“পিডিএফ পড়াই হোক কিম্বা গোটা বইয়ের অংশবিশেষ পড়া, দু’টি প্রবণতার পিছনেই আছে বৈদ্যুতিন মাধ্যমের দু’টি বাস্তব সত্য।” লিখছেন দীপেশবাবু। সত্য দুটি কি? ওনার মতে, প্রথমত, অনেক দুষ্প্রাপ্য এবং প্রিন্ট না হওয়া বই পড়তে গেলে ডিজিটাল কপি ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু একটা কথা তিনি একটু ছুঁয়ে গিয়ে এড়িয়ে গেলেন, তা হল, ঠিক তার আগের প্যারাতে লেখা তার মোক্ষম কথাটা --- “আমার সমবয়সী বন্ধুরা --- যারা এখনও বই পড়েন ও বেশ মন দিয়েই বই পড়েন --- তাঁরাও জানেন যে, তাঁরা ফোনে বই পড়েন, আর বেশিরভাগ বই-ই পড়েন পিডিএফ কপিতে।” কথাটা এখানেই। আমাদের এবং আমাদের পরবর্তী জেনারেশান বই পড়তে ভালোবাসে ফোনে, বলা ভালো ডিজিটাল মাধ্যমে। কিন্তু প্রকাশকেরা তো ছাপার বাইরে মাথাই ঘামাতে চান না। তারা বিশ্বাস করতেই চান না ডিজিটাল কপির মূল্য আছে। কিন্ডলের এই যুগে কেন তারা একটা বাংলা কিন্ডল ভার্সান বানাচ্ছেন না, সেখানে সমস্ত প্রকাশককে একই ছাদের তলায় আনছেন না! ডিজিটাল কপি কেনাও সহজ, পড়াও সুবিধাজনক, অন্তত আজকের জেনারেশনের কাছে। একটা ফোন এখন একটা লাইব্রেরীর সমান। আমরা এখন লাইব্রেরী হাতে নিয়ে ঘুরি, এতটাই সহজ এখন। সেই সহজতাটাকে কেন আমরা অহেতুক জটিল করছি? আমি মনে ভাবি, এই প্রকাশকেরা যদি ব্যাসদেবের আমলের হতেন, তাহলে এখনও ছাপা বইয়ের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে তালপাতার পুঁথির বই প্রকাশ করতেন। আর বলতেন, তালপাতাশিল্প ও পুঁথিশিল্প ধ্বংস করার কোন মানেই হয় না। সম্ভব হলে এর একটা সাইকোলজিকাল গবেষণাও প্রকাশ করতেন। যেমনটি এখন কিছুদিন ধরে ঘুরছে যে, ছাপা বই পড়লে নাকি একজন মানুষ অনেক মনযোগী হয়ে পড়ে! হায় তালপাতার পুঁথি!

দ্বিতীয় কারণটি দীপেশবাবু খুব ভালো বলেছেন। তার কথায়, অনেক পাঠক বইয়ের অংশবিশেষ কিম্বা নেটে সারমর্ম পড়ে রিভিউ দেন বা মন্তব্য প্রকাশ করেনসেটিকে তিনি অসুস্থতা বলছেন, সহমত, তবে আমি বলি, এটা পাঠকের মুর্খতা। এমন পাঠিক-পাঠিকা প্রচুর আছেন, যারা প্রায়দিনই কিছু না কিছু বইয়ের পূর্ণাঙ্গ পাঠের রিভিউ দেন। একটা বইয়ের রেশ তার মন থেকে যেতে না যেতেই আরেকটা বই ধরেনএ অনেকটা দৈনিক মদ্যপান করার মতোই ভয়ঙ্কর। লেখক লেখেন অনেক পরিশ্রম করে। তার ভাবনা-চিন্তা সেই বইয়ের পাতায় পাতায় থাকে। লেখার এই শৈলীই যদি পাঠকের মনে দানা না বাঁধে তাহলে পাঠের সার্থকতা কোথায়? এমন পাঠক আছে, বই অর্ধেক পড়ে ফেলে রাখে, কিম্বা বই কিনে ফেলে রাখে, কিম্বা তুমুল বই পড়ে তার লিস্ট জাঁক করে পোস্টিয়ে কলার তুলে সুখ পায়। আর দেখে কটা কমেন্টস পড়ল। দিনের শেষে লাভের ঝুলিতে লবডঙ্কা!

সবশেষে, হাসি পেল, দীপেশ চক্রবর্তী মহাশয় নিজের মত প্রতিষ্ঠা করলেন, বর্তমান সুবিধা আর চাহিদার কথাকে সম্পূর্ণ উড়িয়ে দিয়ে। “বইয়ের সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্ক হয়”, ঠিক, কিন্তু আজকের যুগে কার এত সময় আছে যে বই বহন এবং সংরক্ষণ করার কাজে সময় নষ্ট করবে? সেটা আসল, না পড়াটা আসল? দীপেশবাবু সেই পড়ার দিকে জোর দিলেন কই? যে মানুষ ট্রামে-বাসে চলতে চলতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বই পড়েন সে স্মার্টফোনেই স্বচ্ছন্দ বোধ করবে, এক হাতে পড়ার জন্য“ডিজিটাল বইকে তো আর এমন যত্ন করে লালন করবে না কেউ।” কেন নয়? প্রোফাইলের পাসওয়ার্ডটাকে কি আমরা সযত্নে মস্তিষ্কে লালন করি না? ডিজিটাল লাইব্রেরীটাকেও কি আমরা সাজাই না? ই-বুক পড়ার অ্যাপসগুলো কিম্বা কম্পিউটারের ড্রাইভ --- সজ্জাবিন্যাসের কত বাহার! দিনের শেষে সেটাও কি লাইব্রেরী নয়? যা চব্বিশ ঘন্টাই খোলা থাকে। এমন কি আমি ঘুমিয়ে পড়লেও?

=====================

‘দেশ’

বিষয় - গ্রন্থলগ্ন

২ মে ২০২৩

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে