এক ভীমরতিপ্রাপ্তের নিজচরিতচর্চা

 


এক জীবনে একটা মানুষ কটা জেনারেশান দেখতে পারে? পাঁচটা, কপাল ভালো থাকলে। ঠাকুর্দার, বাবার, তার নিজের, সন্তানের, এবং সন্তানের সন্তানের... এর বেশি হলে কপাল ভালো বলতে হবে। আমি দেখেছি, একটা সময় পরে মানুষ তার সুখস্মৃতির কাছে ফিরে যেতে চায়, সেই স্মৃতিকে বাস্তবে ফিরে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা রাখে, বিশেষত বাঙালী হলে তো কথাই নেই।

“আমি শুধুই ফিরতে চাই। যেখানেই যাই, মনে হয় ফিরে আসি। উজানের গাড়ি ধরলে ভাটার দিকে চাই। ভাটার গাড়ী ধরলে ভাসতে থাকি উজানে। উল্টোটানে আমাকে ছিঁড়েখুঁড়ে খায়।... আর তো ক’টা বছর। আমি ফিরব। ঠিক ফিরব...”

      কথাগুলো অনিমেষ বৈশ্য-র। ফেসবুকে নিজের মনের অভিপ্রকাশকে ক্রমাগত লিখে চলা এক সাংবাদিকের। পরের পর ছোট ছোট অনুভূতির অনুরণনের ডালি সাজিয়ে তৈরী তার নিজস্ব জীবন, যার কিছু স্বাদ নুন-মরিচের স্বাদ, তাই-ই আমাদের সাথে শেয়ার করেছেনযে নুন-মরিচে কেবল বিগত দিনেরই প্রতিভাস মেলে।

      এই মানুষটি যে ছোট ছোট গদ্যে কাব্যিক সুষমায় তার নিজের অনুভূতির কথা লিখেছেন, তার মধ্যে রবীন্দ্রনাথ বাস করেনএবং, অতি সযতনে তিনি তার রবীন্দ্রনাথকে বারবার ফিরিয়ে আনেন। বলতে চান, তার জীবনের যে স্বাদটিকে তিনি বারবার চেটেপুটে খেতে চাইছেন, তা রবীন্দ্রনাথেরই দানআর তাই, তিনি রবীন্দ্রনাথকে ভোলেন না, তাকে অস্বীকার করে নিজের সুষ্পষ্ট অনুভূতির প্রকাশ ঘটাতে পারেন না বারবার দেখি, তিনি তার এই গোধুলীবেলাতেও রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকার করতে পারছেন না। তার লেখা থেকে মনে হয়, কোথাও যেন, বিশ্বাস করেন, রবীন্দ্রনাথ তার হাত ধরবেন, এবং একদিন তাকে তার আকাঙ্খিত ফেরার পথ দেখাবেন। তিনি সেই পথে হাটবেন, যে পথে রয়েছে, তার এক টুকরো শৈশব, কৈশোর, আর যৌবনকালের কিছুটা। বাকিটা হারিয়ে গেছে সংসারের কোন চোরাপথের বাঁকে, যাকে তিনি ত্যজ্য করতে চান।

মেঘ কাটে। সেই প্রান্তরের কিশোর অনেকটা পথ ফেলে এসেছে। বারবার সে ছুতে যায়, সেই চাঁদে পাওয়া মাঠের কাছে। সেই ইঁদুরের গর্ত কি আর আছে। দুটো দুধের দাঁত সে রেখে এসেছিল সেই গর্তে। সে দাঁত খোঁজে। যেন কোন প্রাগৈতিহাসিক দাঁত। আসলে দাঁত নয়। সেই ‘ফেলে আসা অরূপ বাণী’।

      আবেগ অতি বিষম বস্তু। ইমোশনাল বাঙালী পথে-ঘাটে দেখা যায়। এবং বেশির বেশিরভাগ এই ইমোশনাল বাঙালী হুজুগে হয়। আর সেই কারণেই, সে নিজেই নিজের আবেগের ঘরটাকে বারোয়ারি করে রাখে। বারোয়ারি লোক আসে, বেচাকেনা হয়, পরিশেষে পরে থাকে ঘরশূন্য জঞ্জাল। সেই জঞ্জালে কখন যে তার অতিপ্রিয় আবেগ ময়লায় বাসী হয়ে গেছে, নষ্ট হয়ে গেছে, সে টের পায় না। অনিমেশ বৈষ্য তার বাঙালপনা অবেগকে ধূলিমলিন হতে দেন নি। সেই আবেগকে তিনি পথেঘাটে সঙ্গে নিয়ে বয়ে চলেছেন, যে বাঙালপনায় আছে সবুজ মাঠের গন্ধ, তার যৌবনের স্পর্ধা

      “বাঙালের অন্য অভাব অনেক আছে। কেবল তেজ আছে যথেষ্ট। নানাবিধ পৌরুষলাঞ্ছিত কথায় সেই তেজ ঠিকরে বেরোয়...। আজও বাঙাল না বললে মনে হয় ভাত খাইনি। ডালকে ডাইল। কালকে কাইল। হালা, পুঙ্গির ভাই। আহা আমার বাঙাল বর্ণমালা!”

      হাহাকার আছে। যে প্রৌঢ়ত্বে দাঁড়িয়ে হাহাকার সান্ত্বনা দেয়, সেই হাহাকার। ম্যান্টেলের হাহাকার, পোড়া পাউরুটির হাহাকার, খাসির মাংসের হাহাকার, সমাধান নাটকের জন্য হাহাকার, বটুরামদা, কমলদার জন্য হাহাকার, ভূপর্যটনের জন্য হাহাকার।

আমি হাহাকার করেছি দুইবার, এক, বইয়ের শুরুতেই ফেরার টানে যে লেখক আছড়ে পড়ছেন বোধের আবেগে বারংবার, তারই অলংকরণে একটি অর্ধনগ্ন নারীকে এঁকে সেই বোধের দফারফা হওয়ার কারণে। আর ‘শব্দকল্পদ্রুম’-র আনারসের বনকে রবীন্দ্র-নজরুল সন্ধ্যায় ঢুকিয়ে পেজ সেট-আপ করতে চাওয়া প্রকাশকের চালাকীর ব্যর্থতায়। এ দুটো জায়গা বাদ দিয়ে এত উচ্চমানের অলংকরণ খুব কম বইতে আমি দেখেছিঅলংকরণে এবং প্রচ্ছদে পরীক্ষা-নিরীক্ষার ছাপ স্পষ্ট। যা মনে দাগ কেটে যায়।

অনিমেশ বৈষ্য বারবার পিছু ফিরতে চেয়েছেন --- “কত নরম অপরাহ্ন চলে গেল সুরকির পথ ধরে। শোনা তো হল না।” দু-এক জায়গায় চড় মেরেছেন আমাদের --- “ক্লাবঘরে চামচিকে, শেষযাত্রায় বন্ধু নেই, ঝুলন নেই, রামযাত্রা নেই, পীরের মেলা নেই। ... গলায় কাঁটা বিঁধছে। জল দেওয়ার কেউ নেই।” কখনও সাবধান করে দিয়েছেন, “ওই জেলে গিয়ে বুঝলাম, আমি একটা আস্ত ভন্ড। আমি দিনভর নিজেকেই তা দিচ্ছি। রোজ ডিম ফুটছে। উঠোনে গিজগিজ করছে আমারই পুঁজ-রক্ত। বিক্ষোভে-বিপ্লবে, প্রেমে-অপ্রেমে আমি আসলে আমাকেই চাই। ‘তোমাকে চাই?’ কে বলল?” কখনও বা স্নেহের আবিলতায় ভেসে গেছেন --- “দু’জনে দু’জনের হাত ধরে ঝাঁকুনি দেয়। এক মেয়ে নেমে যায়। আর এক জন হাত নাড়ে। কেউ কাউকে চেনে না। বিকেলের রোদে হাসির গুঁড়ো উড়তে থাকে।”

সব মিলিয়ে তার এই নুন-মরিচের জীবনের টুকরো টুকরো আকাঙ্ক্ষাগুলো রবীন্দ্র স্নেহধারা বেয়ে যে পথে চলেছে, স্মৃতিমেদুর এক বর্ষণসন্ধ্যায় তা এক পল্লীবালার কিম্বা একাকী লাইব্রেরীতে বসে থাকে কোন প্রৌঢ় মানুষের কাছে হঠাৎ হারানিধি হয়ে ওঠে বটে, কিন্ত সেটা সমুদ্রের ঢেউয়ে উঠে আসা মুক্তোর মতন, যা কিনা পরের ঢেউতেই জলরাশির গভীরে হারিয়ে যাবে... 

===============

নুন-মরিচের জীবন

অনিমেষ বৈশ্য

খোয়াবনামা, প্রান্তজনের কথা

মুদ্রিত মূল্যঃ ১৭৫ টাকা

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ সমর্পিতা

Comments

  1. মনে পড়ে যায় ছেলেবেলায় যখন পড়াশোনায় মন না দিলে মা বলত পড়াশোনা তো আর করছিস না বই-খাতা গুলো সব উনুনে দিয়ে দি......
    আজ সেই ঘটনার জ্বলন্ত উদাহরণ (থুড়ি, জ্বলন্ত উদাহরণ হবার আগের অবস্থা।) দেখে বুঝতে পারছি পড়াশোনাটুকু না করলে কি হত !!
    ভাগ্যিস চিত্রগ্রাহিকাকে "হাতির বই - ধৃতিকান্ত লাহিড়ী চৌধুরী (আনন্দ)" বইটির প্রচার করতে হয়নি !!

    ReplyDelete
    Replies
    1. এত বোঝা গেল, আপনি মায়ের কথা একদম শোনেন নি, না হলে ছবি সম্বন্ধে একটু হলেও জ্ঞান থাকত। শেষের বাক্যে হাসি পেল না। বাজে জোকস বলেন আপনি...

      Delete

Post a Comment

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে