সত্যজিৎ রায়ের দিগ্‌দর্শী কম্পাস

 


এক-একসময় এমন হয় যে, নিজেকে দেখে নিজেই একটু চমকে উঠি। মানে আমার এমন এমন সব সিনেমা ভাল লাগে কিম্বা বাজে লাগে যে আপামর বাঙালী সাধারণের মন্তব্যের প্রতিকূলে গিয়ে সেই সিনেমা নিয়ে কিছু বলতে বা লিখতে ভয় লাগে। না, ভুল প্রমাণিত হলে খারাপ লাগে না। যুক্তিপূর্ণ ভুলকে প্রতিষ্ঠা করলে আমার ভাল লাগে। কিন্তু, মত প্রতিষ্ঠা করার বদলে অহেতুক রামপাট আক্রমণ করে কন্ঠরোধ করব --- বাঙালীর এই চমকপ্রদ প্রথাটিকে আমি ইদানীং একটু ভয়ই করতে শুরু করেছি।

      তবুও বলি, সত্যজিৎ রায় সম্পর্কিত দুটো সিনেমা --- ‘অপরাজিত’ আর ‘সাবাশ ফেলুদা’, দেখে আমি একটু দমেই গেলাম।

      ‘অপরাজিত’ সিনেমা নিয়ে সে কি হইচই! কিছুদিনের জন্যে প্রশংসার বন্যা দেখে মনে হচ্ছিল বাংলা সিনেমা একটা মাইলস্টোন পেয়েছে, অথচ সিনেমাটাতে জিতু কামালের অসাধারণ ‘সত্যজিৎ’ কপি ছাড়া আর কিছুই নেই। এমনকি ইন্দির ঠাকরুনরূপী চুনীবালা দেবীর সমরূপ কোন চরিত্রকে পাওয়া গেল না এ বাঙালাভূমিতে! একজন পুরুষকে (হর কুমার গুপ্ত) দিয়ে অভিনয় করিয়ে স্বয়ং পরিচালক নিজের গলায় ডাবিং করে চরিত্রটাকে যাত্রাপালার থেকেও বিকটাকার করে দিলেন। আর ছোটখাটো পার্শ্বচরিত্র সম্পর্কে যত কম বলা যায় ততই ভাল। অথচ সিনেমাটা কিছুদিনের জন্য বঙ্গমুলুকে উচ্ছ্বাসে ভেসে গিয়েছিল।

*     *     *     *      *     *     *

      আবার দেখুন পরমব্রত’র অবস্থা। ‘সাবাস ফেলুদা’ দেখে লোকে বলতে শুরু করল, এবার খালি পরমব্রত’র জটায়ু হওয়াটা বাকি আছে। অরিন্দম শীল বলতে চাইলেন, তিনি ফেলুদাকে স্মার্ট বানাতে চেয়েছেন এখনকার সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে। ফলে সিরিজটা দেখার আগে আমি অরিন্দম শীলের কথাটা নিয়ে ভাবলাম। নতুন ফেলুদা কেমন হতে পারে? চড়া সবুজ এম্বাসেডার দেখালেই কি মডার্ন ফেলুদা? না তো! মেয়েলি ভাবুক তোপসেই কি আসল তোপসে? তা-ও না। ছ-ফুটের সত্যজিৎ মার্কা ফেলুদাই কি স্মার্ট ফেলুদা?

      মনে পড়ল, বিদেশে কিভাবে জেমন্স বন্ড বদলে গেছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে – Sean Connery থেকে Pierce Brosnan হয়ে Daniel Craigকিভাবে শার্লক হোমসের ব্যাটন Robert Downey Jr.-র হাত থেকে এসেছে Benedict Cumberbatch-র কাছে। তারা কতটা জটিলতার শিকার হচ্ছেন আস্তে আস্তে সময়ের চাহিদায়।

      সেদিক থেকে দেখলে ফেলুদায় কি আছে? ‘ক্রাইম’ ব্যাপারটার সাথে অবধারিতভাবে আদিম রিপু এবং লোভ-লালসা ইত্যদির জটিল-কুটিলতা জড়িত থাকে। ফেলুদা শিশুতোষ সাহিত্য থেকে উঠে আসা ষাটের দশকের এক নিরীহ টাইপ গোয়েন্দা। এতটাই নিরীহ যে সারা জীবনে তিনি এমন কোন কেস পেলেন না, যেখানে নারী চরিত্রের মায়াবী জটিলতা পাওয়া যায়। তা এমন শিশুবিমোহন চরিত্রটি যদি ২০২৩-এ এসে পৌছয় এবং বলে, ন্যাঃ, নারী চরিত্র থাকিলে চলিবে না। আমার স্রষ্টা গ্যাঙটকে কোন রিনচেন গোংপো-কে তৈরী করেন নি, এতএব ইহা বর্জনীয়, আমি বাড়ি চললুম। এমনকি বন্দুকটা পাল্টালেও চলবে না, তার ওপর বেঁটে ফেলুদা হলে তো ব্যঙ্গে বিদ্রুপে সিনেমাটা মাটিতে পুঁতে দেওয়ার বিধান দেওয়া হোক।

      অথচ আমার ভাল লাগল! এই প্রথম মনে হল, সত্যজিৎ রায়ের থেকে বেরিয়ে, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের থেকে বেরিয়ে, এমনকি সব্যসাচী চক্রবর্তীর থেকেও বেরিয়ে এসে একটা নতুন রকমের ফেলুদা দেখতে পাওয়ার ইঙ্গিত পাচ্ছি। তোপসে প্রেম করছে। তার মানে তোপসে আর মেয়েলি টাইপ নিরীহ বোকাপনা বালক নেই। সে-ও স্মার্ট হচ্ছে স্মার্টফোনের সাথে সাথে। কথাবার্তায় কিম্বা হাবেভাবে তাকে ফেলুদার যোগ্য সহকারি মনে হচ্ছে। পরমব্রত-র চোখের দ্যুতিতে দুধেভাতে বাঙালী নব্বইয়ের দশকের সন্দিপীয় নীরস ফেলুদা থেকে বেরিয়ে দু-হাজার তেইশের ঝকঝকে ফেলুদা হওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে।

      স্মার্ট হতে গিয়ে ফেলুদা সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিক না, ভালই তো। আসুক না তার জীবনে এক নারী। কিম্বা তোপসের বান্ধবীই না হয় জড়িয়ে পড়ুক কোন এক অভিযানে তাদের সাথে। অথবা ফেলুদার মনে বসন্তের বাতাস আসুক। সে বাতাস যে এনেছে, সে হোক না কোন হিংস্র সর্পিনী, অথবা বন্দী-বিহঙ্গিনী। সত্যজিৎ রায় বেঁচে থাকলে, তার ফেলুদা কি স্মার্ট হত না? তার ফেলুদা কি সাইবার হ্যাকিং করার সাহস দেখাতে পারত না? আন্তর্জাতিক এজেন্টদের সাথে টক্কর দিত না? তার ফেলুদা কি সিগারেটের বদলে চুইং গাম চিবাতে চিবাতে বলতে পারত না, বুঝলি তোপসে, সিগারেটের নেশাটা ছেড়ে দিয়ে ভালই হয়েছে রে!

      হয়তো পারত। হয়তো পারত না। আমরা জানি না। কিন্তু ফেলুদার গল্পগুলো পরপর পড়লে মনে হয়, সময়ের সাথে সাথে যে স্মার্টনেস ফেলুদাতে এসেছিল, তা যেন এক ফুৎকারে সত্যজিৎ রায়ের মৃত্যুর সাথে সাথে বন্ধ হয়ে গেল। পড়ে রইল সত্যজিতের সাথে, সৌমিত্রর সাথে তুলনীয় এক হেরো ফেলুদা। আর পড়ে রইল চুড়ান্ত আনস্মার্ট কিছু সত্যজিতোত্তর ফেলু চলচ্চিত্র।

      আমার এই সিরিজ ভালো লেগেছে। কিছু দৃশ্য বেমানান লাগলেও ভাল লেগেছে। অত ভারী যক্ষীর মাথা হাতে নিয়ে চার-পাঁচজন গুন্ডার সাথে মহড়া দেওয়াটা একটু চোখে লাগে। কিন্তু হোক না সেটাই সিনেমাটিক সত্যি। জিৎ কিম্বা দেব যদি একশো ভিলেনের সাথে মহড়া দিতে পারে, ফেলুদা কেন পারবে না? বিক্রম ঘোষের নিজস্ব সত্যজিৎ থীম, পুরোনোকে আগলে রেখে, কানে রেশ থেকে যায়। অনেকদিন পর ঋত্বিককে যতটা ভালো লাগল, রুদ্রনীলের অতিরিক্ত ভাড়ামো ততটাই মন খারাপ করে দিল। ঋত্বিক যে মেক-আপ নিয়ে দুষ্টু বৈদ্য হয়েছেন সেটায় মেক-আপের অদক্ষতা স্ক্রীণে কিন্তু ধরা পড়ে যাচ্ছিল। আর ছয় নম্বর এপিসোডের পর থেকে টেনে টেনে দশ নম্বর এপিসোড করার চেষ্টায় শেষের দিকে কাহিনীর গতি রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছিল বলে একটু মন খারাপ হচ্ছিল। যদি সাত কিম্বা আট এপিসোডে শেষ হত, কি ক্ষতি হত? আরোও কমপ্যাক্ট হতে পারত।

      ক্যামেরার কাজ লা-জবাব। ঝকঝকে চিত্রগ্রহণ, কিম্বা অনেকখানিই তকতকে সংলাপ। কেবল মাঝে মাঝে তোপসে-ফেলুদার কথোপকথনে বোকা বোকা সংলাপ থাকলেও আগেরগুলোর থেকে অনেক কম। এমনকি ‘সোনার কেল্লা’ সিনেমাতেও তোপসের বেশ কিছু সংলাপ এখন শুনলে হাসিই পায়। সেদিক থেকে তোপসে কিন্তু বেশ অ্যাডভান্সড্‌।

      আরেকটা ব্যাপারও বেশ ভাল লাগল, যেটা সত্যজিৎ রায় থাকলেও হয়তো প্রশংসা করতেন। তা হল, সমসাময়িক ভুটানকে ঘিরে ভারত ও তার পার্শ্ববর্তী সমস্যাগুলোর উত্থাপন। যেন মনে হচ্ছিল, ফেলু মিত্তির আর কল্লোলিনীর ফেলু মিত্তির নেই। সে হয়ে উঠেছে তিলোত্তমার প্রদোষ মিত্র।

========================

সাবাশ ফেলুদা

পরিচালকঃ অরিন্দম শীল

অভিনয়ঃ পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, ঋতব্রত মুখার্জী, ঋত্বিক চক্রবর্তী, সৌরসেনী মৈত্র, রুদ্রনীল ঘোষ

OTT Platform: ZEE5

Comments

  1. অনেক ধন্যবাদ। লেখাটি আমাদের অবশই উদ্বুদ্ধ করল।

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে