জামাইষষ্ঠীর একটা দুপুর


 

“আমি কি আসতে পারি?” একটি অতীব হাল্কা টেকো-মাথা লোক দরজার দুই ফাঁক দিয়ে ধ্যাবড়া নাক আর গোল গোল চোখ নিয়ে জিজ্ঞাসা করল।

“না, পারো না, আমি আর দিদি এখন গল্প করছি, ঝামেলা কোরো না। যাও ভাগো।”

লোকটা এবার গলাসমেত মুখ ঢুকিয়ে বলল, “একটু গড়াগড়ি দিতাম আর কি, খাওয়াটা জম্পেশ হয়েছে...”

“আরও তো ঘর আছে, আমাদের উত্তরের ঘরটায় যাও না। এসি আছে ওখানে...”, দিদি বলল।

“হ্যাঁ”, আমিও বললাম, “দিদিও ওইঘরেই তোমার সাথে রাত জেগে জেগে প্রেম করত, মনে নেই? আরও সব কি কি করত জানি না। উফফ...” (দিদি এক থাপ্পড় মারল) “ইয়ে মানে, ওই ঘরে গিয়ে ঘুমাও না, দেখবে খুব সুখের ঘুম হবে।”

“তা কি হয়, তোমার দিদি তো এখানে...” বুকসমেত মাথাটার পুরোটাই ঢুকে এল এবার, “আর এতদিন পরে এলাম, তুমি আছ, দিদি আছে, একসাথে...”

“মোটেই ফালতু কথা বোলো না। কতদিন বাদে দিদি এল। অনেক কথা আছে আমাদের। আজ সন্ধ্যেবেলাতেই তো চলে যাবে তোমরা...’

“বাব্বাঃ! যেন এক যুগ বাদে কথা বলছ মনে হচ্ছে। কালকেই তো রাতে দুজনায় ফোনে গল্প করে করে আমাকে আর ঘুমাতে দিলে না। তার ক্ষতিপূরণ---”, জামাইবাবু কোমর সমেত ঢুকে এল এবারে।

“বোকা পাঁঠার ঝোল দিয়ে বিরিয়ানি সাঁটালে এক গামলা, ক্ষতিপূরণ হয়ে গেছে। এবার যাও, অন্য ঘরে গিয়ে ঘুমাও।”

“সে তো আমার শাশুড়ি খাইয়েছে। তুমি কি খাওয়াবে?” জামাইবাবু এবার আমাদের দুজনের মাঝে জায়গা খুঁজছে, “আমি তোমার সাথে ঘুমাব বলে এসেছি।”

“ভাগো এখান থেকে, দিদি তোমাকে বটি দিয়ে কুপোবে এসব বললে। এই না না... একদম আমাদের মাঝখানে ঢুকবে না বলে দিলাম কিন্তু।” আমি দিদিকে চেপে ধরে বলে উঠি। আমার আরেকদিকে আমার চার বছরের ‘বর’ ঘুমাচ্ছে। তাকে দেখিয়ে দিদি কপট বিরিক্তিতে জামাইবাবুকে বলে উঠল, “আঃ! কি হচ্ছে কি! জেগে গেলে কিন্তু তোমাকেই ঘুম পাড়াতে হবে বলে দিলাম।”

জামাইবাবু থমকে গেল, “তোমার বোনটাই তো ব্যাগড়া দিচ্ছে...”

“তুমিই বা এখানে ঢুকছ কেন? ওঘরে যাও না...”

“আহা! একপাশে তুমি আর আরেক পাশে তোমার বোন, এটা তো আমার অধিকারের মধ্যে পড়ে... তোমার বোনের কটকটানি কথা শুনতে বেশ লাগে...”

“উ উ উ উ উ উ উ উ উ...” চিঠিপত্তরগুলো নেওয়ার সময় তো একথা বলতে না? আমার সাথে কথাও বলতে না। ভয় পেয়ে পালাতে। [প্রসঙ্গত, দিদি-জামাইবাবুর প্রেমপত্রের ধারক ও বাহক ছিলাম আমি। সে বেশ আগের কথা। তখন আমাদের স্মার্টফোন ব্যবহারের অধিকার ছিল না।]

“বাব্বা! তোকে দেখে যা ভয় পেত জানিস না। আমাকে বলত, তোমার বোনটা খুব একটা সুবিধের নয়। খালি পায়ে-পা লাগিয়ে ঝগড়া করার ধান্দা নিয়ে যেন ঘোরে। আর কি কটর কটর কথা...”

“তাই বুঝি? আমার পায়ে কবে পা লাগালে?”

“আজ লাগাব, সরো না দুজনে”, বলে দুজনের মাঝে আবার সেঁধোতে গেল। আমরা বাঁধা দিলাম আবার।

“বাজে ইয়ারকি হচ্ছে? যাও এখান থেকে। মেয়েদের অশ্লীল কথা বলতে লজ্জা করে না?”

“আমি আবার কি বললাম?” জামাইবাবু এবার একটু থমকে গেল। দিদির দিকে তাকাল। দিদি চুপ। রগড় দেখছে। “আর তুমি আমার আধা...” জামাইবাবু এবার পুরো শরীর দিয়ে ঝাঁপাতে চাইল।

“এই এই কি হচ্ছেটা কি??? না না না...” আমি চেঁচাতে গেলাম। দিদি হাইমাই করে বলে উঠল, “এই চুপ চুপ... জেগে যাবে যে।”

জামাইবাবু এই সুযোগে হাল্কা নাদা পেট নিয়ে আমাদের মাঝে জায়গা করে নিয়েছে। আরাম করে শুয়ে পড়েছে, “এমন আরাম ছেড়ে কোথায় যাব বল তো? তোমরা দুজন আমার দুটো এসি...”

“তাই বুঝি?”

“হ্যাঁ তো। এখন আমি ঘুমাব। তোমরা দুজন আমাকে দুদিক থেকে জড়িয়ে ধরতে পারো। আমি কিছু মনে করব না।”

“বয়েই গেছে জড়িয়ে ধরতে এই গরমে।”

“তাই বুঝি, গরম তোমার লাগে তাহলে?”

আমি খর চোখে তাকালাম। মানেটা কি? দিদি খিলখিল করে হেসে উঠল। তবে খুব সাবধানে। আমার বোম্বেটে বরটা জেগে গেলে এই রঙ্গতামাশার এখানেই সমাপ্তিকা ঘোষণা করতে হবে।

মাথার ওপর পাখা ঘুরছে। হাল্কা হাল্কা গরমের আমেজে ঠান্ডার ইমেজ। তিনজনেই চুপ। কি বলব বুঝতে পারছি না। জামাইবাবু একটু চুপ থেকে বলল, “কাল বাগবাজারে যাচ্ছি”, বলেই আমার দিকের চোখটা একটু খুলে তাকাল।

“তো?”

“না, কিছু না, তোমাকে জানালাম।”

আরে তাই তো! উদ্বোধনের অফিসটা ওইদিকে না! হ্যাঁ। তাই তো! আমি লাফিয়ে উঠলাম।

“ই ই ই ই ই ই...” আমি জামাইবাবুর দিকে ঘুরে তার একটা হাত নিবিড় করে জড়িয়ে ধরে বলতে গেলাম, “তুমি যখন যাচ্ছই...”

“তার আগে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দাও দিকি ভালো করে, দিদির থেকেও ভাল করে দিতে হবে, না হলে কিন্তু কোন কথা শুনব না... আমি ঘুমাব এখন...” বলেই সে কপট নাক ডাকতে লাগল।

দিদি তার দিকে রোষকষিত নেত্রে তাকিয়ে বলে উঠল, “আমাদের গল্পের বারোটা বাজিয়ে দিল...”

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে