রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়: এক অসম্পূর্ণ রবীন্দ্রচেতনা


 

“ভগবান হতে-হতে, ভগবান হতে-হতে, ভগবান হতে-হতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পাথরের মুর্তি হয়ে গেছেন। তাঁর রক্তমাংস, বাসনা-কামনা, সুখ-দুঃখ, শোক-ভোগের সমস্ত চিহ্ন ঠাকুরপুজোর ফুলচন্দনের তলায় লুপ্ত। সমস্ত বাংলা জুড়ে এক প্রাণহীণ, প্রবৃত্তিহীন, ইন্দ্রিয়রুদ্ধ রবীন্দ্রনাথের পুজো করেন তাঁর ভক্তের দল বছরে দু-দিন। ... এই রবীন্দ্রস্মরণ ও উদ্‌যাপনের একটি বহুনির্জিত চেনা ছক আছে। যেমন আছে সমস্ত অন্ধভক্তি এবং প্রতিমাপূজোর মন্ত্রে, মুদ্রায়, রীতিতে, ভানে ও আড়ম্বরে। এই ভাবেই আমরা রবীন্দ্রনাথকে ক্রমশ দূরে সরিয়ে দিয়েছি, তাঁকে প্রতিষ্ঠিত করেছি আরোপিত দেবত্বে।”

      রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্য্যের সম্পর্কে অনেক কথাই কানে এসেছে, বিশেষত বিভিন্ন সন্মানীয় সাহিত্যিককে নিয়ে তার লেখার ব্যাপারে। এর মধ্যে রবীন্দ্রনাথ তার প্রিয় বিষয়। মোটামুটিভাবে তিনি কিছু গল্পগাছাকে স্বকপোলকল্পিত কল্প-আঙ্গিকে সাজিয়ে এখনও পর্যন্ত মোট নটা রবীন্দ্র বিষয়ক পুস্তক রচনা করেছেন এবং কুখ্যাত হয়ে গেছেন।

      এবারের কৃত্তিবাসে তার লেখা রবীন্দ্র-প্রবন্ধে মূলত তিনি যে বিষয়টা নিয়ে লিখতে চেয়েছেন, তা হল রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তার এই ধরনের লেখাগুলোর একটি কৈফিয়ত এবং লেখার শুরুই হচ্ছে উক্ত কথাগুলো দিয়ে। আমি জানি, কথাগুলো কি নিদারুন সত্যি

      পঁচিশে বৈশাখ স্কুল-কলেজ-অফিস (বিশেষত সরকারি অফিস) ছুটি থাকে। কিছু কিছু স্কুলে অনুষ্ঠান হয়, যারা অংশগ্রহণ করেন তাদের অধিকাংশই রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করেন যত না, তার থেকেও বেশি ‘পারফর্ম’ করেন রিল কিম্বা সোশাল মিডিয়ার জন্য। কিছু এলিট কলকাত্তাইয়ান টাইপ মহিলারা শাড়ী পরেন, খোঁপায় ফুল গোঁজেন; এবং পুরুষেরা জিন্সসহ পাঞ্জাবী পরে জোড়াসাঁকো যান (সবাই অবশ্যই নন), টিভিতে দেখি ভক্তের দল রবীন্দ্রনাথের সাথে সেলফি নেওয়ার জন্য সম্ভব হলে মুর্তির ঘাড়েই উঠে পড়েন। বোলপুরের আশেপাশে তো বোধহয় ডিজে সহযোগে রিমিক্স রবীন্দ্রসঙ্গীত চলে। আর অবশিষ্ট বাঙালী মদ, বিরিয়ানি কিম্বা মাংসের দোকানে ভীড় করেন। তারা সারাদিন টলোমলো রবীন্দ্র জয়ন্তী পালন করেন। এবং নিজেদের ভক্ত প্রমাণ করার জন্য সকালের শুরুতেই একটা ছবিসহ কোটেশান পোষ্ট করেন, যার অনেক কথা রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলে যান নি, অন্তত সজ্ঞানে। বাঙালীর রবীন্দ্রচেতনা নিয়ে রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় যা বলেছেন, এই পর্যায়ে, আমি তার সঙ্গে সম্পূর্ণ সহমত। এখন তো রবীন্দ্র জয়ন্তী একটা ট্রেন্ডস হয়ে গেছে

      কিন্তু তিনি তার কৈফিয়তটি কি দিলেন? তিনি বললেন, “রবীন্দ্রনাথের প্রাণহীন পাথরের মুর্তিটাকে ... টুকরো করে প্রাণস্পন্দিত মানুষ রবীন্দ্রনাথকে আমাদের যাপনের মাঝখানে নিয়ে আসতে ইচ্ছে করল।” কারণ কি? তার মতে “তাঁর (রবীন্দ্রনাথ) সর্বোচ্চ পরিচয় তিনি ভগবান নন। তিনি মানুষ। সমস্ত মানুষী দুর্বলতা, ইন্দ্রিয় প্রবণতা, প্রবৃত্তি তাড়না নিয়েই তিনি আমাদের মতোই এক মানুষ।” এবং অবশেষে নারী সংসর্গের আকুতি ও আদরের উপবাসে ক্লিষ্ট এই মানুষটির সৃষ্টির উৎসটি কি? রঞ্জনবাবু লিখছেন, “তাঁর সৃষ্টির প্রধান রস, সন্দেহ নেই, শৃঙ্গার।”

      এই পর্যায়ে আমার মুখ ফসকে অস্ফুটে স্বগতোক্তি করলাম, আ মোলো যা! মিনসের ভীমরতি হয়েছে না কি লো! কিছুদিন আগে এই কৃত্তিবাসেই তার আত্মজীবনী ধারাবাহিকভাবে বের হত, আমি তা পড়েছি, এবং সেখানে তিনি তার বন্ধুনীদের নিয়ে অনেক সরস ইঙ্গিতপূর্ণ গল্প লিখেছেন। সন্দেহ নেই, তার নিজের জীবনের উৎস, শৃঙ্গার রস। আর তাই, তিনি এই রসটির জয়জয়াকার সর্বত্রই দেখতে পান রবীন্দ্রনাথের মধ্যেও অবধারিতভাবে দেখেছেন। রামকৃষ্ণদেব বলতেন, মুলো খেলে মুলোর ঢেকুর ওঠে। ওনার হয়েছে সেই দশা। নচেৎ, রবীন্দ্রনাথের ভাব, যদি আমরা তার লেখা এবং তার অন্যান্য দৈনন্দিন ব্যবহারিক ক্ষেত্রে দেখি, তা হলে অবশ্যই তা ‘শান্তরস’ জীবনের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বিষাদ, এমনকি কামনা-বাসনারও তিনি শান্তভাবে মুখোমুখি হয়েছেন, তা থেকে উত্তীর্ণ হয়েছেন এবং অবশেষে সংযতভাবে তার প্রকাশও ঘটিয়েছেন তার বিভিন্ন সৃষ্টির মধ্য দিয়েমহামানবেরা কোনদিন কপট হন না। রবীন্দ্রনাথ কপটাচারী ছিলেন না, এটা স্বয়ং রঞ্জনবাবুও মানবেন। সেক্ষেত্রে তার জীবনটাকেও যদি ভালভাবে খেয়াল করা যায়, তাহলে সন্ধ্যাসংগীত থেকে সভ্যতার সংকট --- সর্বত্র দেখা যায় এক আশ্চর্য শান্ত সংযত বহিঃপ্রকাশ।

      এই লেখাটা লেখার আগে ‘কাদম্বরীর সুইসাইড নোট’ কিম্বা ‘আমি রবিঠাকুরের বউ’ ইত্যাদিতে চোখ বোলাতে গিয়ে দেখলাম, সেগুলো কল্পকাহিনী মাত্র। ওনার চোখে যেন, এরকমটা হতে পারত। কিন্তু বাস্তবিক তাই হয়েছিল কি, কিম্বা সেটা হওয়ার যো ছিল কি? উনি জানেন, তা হয় নি। আর তা হয় নি বলেই উনি আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে ‘ধরে নিয়ে’ এগিয়েছেন। এবং ওনার লেখার রবীন্দ্রনাথ হয়ে উঠলেন নারীশরীর সর্বস্ব এক কামুক, অত্যাচারী রবীন্দ্রনাথ। এবং সেখানে একে একে এসে মিশল ইন্দিরা দেবী থেকে শুরু করে রাণী চন্দ হয়ে ভিক্টোরিয়া ওকোম্পো পর্যন্ত। অথচ এর পাশাপাশি নৈবেদ্য, শান্তিনিকেতন, গোরা কিম্বা পূজা পর্যায়ের গানগুলো পড়লেও বোঝা যায় সাধক রবীন্দ্রনাথ এইসব ক্ষুদ্রতার ঊর্ধ্বে নিজেকে কিভাবে নিয়ে গিয়েছিলেন। ‘ছোট আমি’-কে কিভাবে বির্সজন দিয়েছিলেন ‘বড় আমি’-র পায়েএমনকি তার অন্যান্য চিঠিপত্র, সে হেমন্তবালা দেবীকেই লেখা হোক, মৈত্রেয়ী দেবীকেই লেখা হোক, কিম্বা অজিতকুমার চক্রবর্তীকেই লেখা হোক – পড়লে বোঝা যায়, তার দৈনন্দিন জীবনযাত্রাটিও কতটা উচ্চসুরের বাঁধা ছিল। সেখানে রাণু বা ইন্দিরাকে লেখা চিঠির কোন অংশ ছেঁড়া, কালি দিয়ে কাটা বা সম্পাদিত সেটা বড়ো কথা নয়, বড়ো কথা তার অন্যান্য লেখায় কিম্বা ব্যবহারে তার যে পরিচয় আমরা পাই তার সাথে তুলনা করে এইক্ষেত্রেও সম্যকরূপে একই পরিচয় পাচ্ছি কি নাকোথাও কোন বিরুদ্ধভাব রইল কি না।

      অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ রক্তমাংসের মানুষ। তারও অনেক ভুল-ত্রুটি ছিল। তিনি এমন অনেক কাজ করেছেন যা সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রেও মেনে নেওয়া যায় না। কিন্তু এটাও দেখা যায় যে, তিনি তা থেকে বেরিয়ে আসার জন্যে সাধনা করেছেন, আজীবন, না তো কি ‘রক্তমাংসের উপবাসে অস্থির হয়েছেন’। বরং অস্থিরতাকে স্থিরতা দিয়ে, মিথ্যাকে সত্য দিয়ে, ক্ষুদ্রতাকে বৃহতের কাছে সমর্পণ করে, শান্তভাবে সমগ্র জীবনকে সত্য ও সুন্দরের মধ্যে দিয়ে রবীন্দ্রনাথ হয়ে ওঠাই ছিল তার সাধনা। সেই সাধককে অহেতুক রক্তমাংসের মানুষে টেনে নীচে নামানোর মতন সাধনায় নামলে আর যেই হোক, তা রাবীন্দ্রিক প্রতিভাকে চরম অপমান করা বৈ আর কিছুই নয়এতে নিজের অক্ষমতাই প্রকাশ পায়।

      জানি আমার এ লেখা আপনার চোখে পড়বে না। কারণ আপনি সোশাল মিডিয়ায় থাকেন না। কিন্তু যদি কোনভাবে চোখে পড়ে, তাহলে অনুরোধ করব, দয়া করে, একটা বছর এই শৃঙ্গার রসের রক্তমাংসের রবীন্দ্রনাথকে না খুঁজে, সাধক রবীন্দ্রনাথকে যদি খোঁজেন, দার্শনিক রবীন্দ্রনাথকে যদি খোঁজেন, ঈশ্বরপ্রেমিক রবীন্দ্রনাথকে যদি খোঁজেন, যিনিও কি না রক্তমাংসেরই ছিলেন, তাহলে হয়তো আপনি তার এমন দিকটাকে খুঁজে পাবেন, যা কি না মানবের শাশ্বত খোঁজ। আপনি আস্তিক হোন, কিম্বা নাস্তিক, রবীন্দ্রনাথকে জানতে হলে তার আস্তিকতাকেও গ্রহণ করতে হবে। দেখবেন সেখানেই তার শৃঙ্গার রস মিশে গেছে তার অকুন্ঠ তৃষ্ণা সেখানেই নির্বাপিত হয়েছে, সংযমিত হয়েছে, পরিবর্তিত হয়েছে শৈল্পিক মেধা ও বোধের পথেতিনি আমাদের থেকে অনেক অনেক উঁচুতে উঠে গেছেন। আর যেতে পেরেছেন বলেই, তিনি রবীন্দ্রনাথ, আপনি রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়। আকাশে-পাতালে তফাত হয়ে গেছেতার সেইদিকটা অজানা থাকলে একচক্ষু হরিণের মতন আপনার এই নয়টি লেখা এবং এর অপরাপর লেখাগুলিও একদিন সময়ের স্রোতে হারিয়ে যাবে, কিম্বা কিছু মানুষের খিল্লির বিষয় হবে, অথবা কিছু রবীন্দ্রবিদ্বেষীর হাতিয়ার হবে। আপনার উদ্দেশ্য হয়তো সৎ, কিন্তু অপরিণত, অসম্পূর্ণ। অসম্পূর্ণ উদ্দেশ্য কুয়াশার মতোই সর্বনেশে, আলোকে সে লোপ করে খায়, আপনার জন্যেও, আপনার ভক্তদের জন্যেও...

 

[ছবি কৃতজ্ঞতাঃ সমর্পিতা]


Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে