প্রভাতসংগীতঃ রাবীন্দ্রিক উচ্ছ্বাসের বাঁধভাঙা বিলাপ

 আমার রবীন্দ্রনাথ – পর্ব ৯



অদ্ভুতভাবে প্রভাতসংগীতের রবীন্দ্রনাথ কিছুতেই যেন আমার পথ ছাড়তে চাইছে না। দশ নম্বর সদর স্ট্রীটে কিম্বা দার্জিলিং-এর বনচ্ছায়ায় তার সাথে সাথে আমিও আটকে গেছি। প্রায় একই বয়সী হওয়ার কারণেই আমি কি ওনার সাথে এমনভাবে আটকে গেছি? না কি ওনার ওই উচ্ছ্বাসের ভেতরে যে অনন্ত সৌন্দর্যের বেদনাভাস আছে, তাকে ক্ষণিক উপলব্ধি করে মুগ্ধ হয়ে গেছি --- “হাতের ধরা ধরতে গেলে ঢেউ দিয়ে তায় দিই যে ঠেলে-- / আপন-মনে স্থির হয়ে রই, করি নে চুরি।”

      যত সুন্দর, যত মহানই হউক, রবীন্দ্রনাথ কোনো ভাবনাকে মনের কোণে স্থায়ীভাবে বাসা বাঁধিতে দেন না। তাঁহার বিরাট ব্যক্তিত্ব বিচিত্র রসধারায় পুষ্ট। ক্ষীণ অষ্পষ্ট শিশু ভাবনাগুলি ধীরে ধীরে রূপ গ্রহণ করে, গতি ও শক্তি অর্জন করে, মনোরাজ্যে বৃহৎ প্রবাহ সৃষ্টি করে --- সাহিত্যে নূতন পথ বাহিয়া সেই সৃষ্টিধারা চলিতে থাকে। তাই প্রভাতসংগীতের আনন্দময় ভাবলোক হইতেও মুক্তির আকূতি শোনা গেল। লিখছেন প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়। উদাহরণস্বরূপ, চারটি কবিতাকে সামনে রাখলেন, প্রভাতসংগীতের শেষ চারটে কবিতা – স্রোত, চেয়ে থাকা, সাধ এবং সমাপন।

      আমি তার সাথে সম্পূর্ণ সহমত নই। কারণ ইন্দিরা দেবীকে লেখা একটা চিঠিতে তিনি বলেছেন, “প্রভাতসংগীতে আমার অন্তর্‌প্রকৃতির প্রথম বহির্‌মুখী উচ্ছ্বাস, সেই জন্য ওটাতে আর কিছুমাত্র বাচ-বিচার বাধাব্যবধান নেই।” আবার জীবনস্মৃতিতে লিখছেন, “সকলেই যেন নিখিলসমুদ্রের উপর দিয়া তরঙ্গলীলার মতো বহিয়া যাইতেছে। শিশুকাল হইতে কেবল চোখ দিয়া দেখাই অভ্যস্ত হইয়া গিয়াছিল, আজ যেন একেবারে সমস্ত চৈতন্য দিয়া দেখিতে আরম্ভ করিলাম।” আরেকটা তথ্য পাই ‘মানবসত্য’ প্রবন্ধে। অসীমের সেই বোধকে যখন নিজের চেতনস্তরে অনুভব করলেন, সেই সময়ের কথা লিখলেন ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’-এ, আর তার পরের অবস্থার কথা বলতে গিয়ে উক্ত প্রবন্ধে লিখলেন, “এই অবস্থায় চার দিন ছিলুম। চার দিন জগৎকে সত্যভাবে দেখেছি। তার পর জ্যোতিদা বললেন, "দার্জিলিঙ চলো।" সেখানে গিয়ে আবার পর্দা পড়ে গেল। আবার সেই অকিঞ্চিৎকরতা, সেই প্রাত্যহিকতা। কিন্তু, তার পূর্বে কয়দিন সকলের মাঝে যাঁকে দেখা গেল তাঁর সম্বন্ধে আজ পর্যন্ত আর সংশয় রইল না। তিনি সেই অখণ্ড মানুষ যিনি মানুষের ভূত-ভবিষ্যতের মধ্যে পরিব্যাপ্ত-- যিনি অরূপ, কিন্তু সকল মানুষের রূপের মধ্যে যাঁর অন্তরতম আবির্ভাব।”

      আমার মনে হয় চারটি কবিতা যদি দার্জিলিঙ যাওয়ার মাঝে লেখা হয়, তাহলে তিনি মুক্তি পাওয়ার ইচ্ছায় লেখেন নি। অন্তত প্রথম তিনটে কবিতা তো বটেই। জগতের আনন্দের স্রোতে যে ভেসে যেতে চাইছে সে কি আর সেই ভাবনার হাত থেকে মুক্তির জন্যে ভাসতে চাইছে? না কি ভেসে যেতে যেতে সেই অনন্ত রূপকে প্রাণভরে দেখতে চাইছে? অসীম কাল ভেসে যাব অসীম আকাশেতে, / জগৎ- কলকলরব শুনিব কান পেতে।এ তো কেবল আনন্দকেই নিবিড় করে পাওয়ার বাসনা। কিম্বা ‘চেয়ে থাকা’ কবিতায় একের পর এক দৃশ্যপটের কোলাজ – পাখির উড়ে যাওয়া, ছেলেদের খেলা, বালিকা মেয়ের স্নেহ, মায়ের সন্তানের প্রতি ভালবাসা --- এ সবই তো সেই চিরন্তনী সৌন্দর্য্বের এক-একটা রূপের বহিঃপ্রকাশ। ‘সাধ’ কবিতাতেও তো একইভাবে প্রকৃতি-মানুষে নিবিড় করে অনন্ত যাপনের আভাস। শুধু দেখতে চাওয়া। যে অমৃত পরশ তিনি পেয়েছেন, সমগ্র বিশ্বজুড়ে যে আনন্দ প্রবাহের আভাসকে আপন হৃদয়ে অনুভব করতে পারছেন, তারই প্রকাশকে রূপে-রূপান্তরে অনুভব করতে করতে তার যেন তৃপ্তি হচ্ছে না। “যায় রে সাধ জগৎ-পানে / কেবলি চেয়ে রই / অবাক হয়ে, আপনা ভুলে, / কথাটি নাহি কই।”

      বরং ‘সমাপন’ কবিতায় ক্লান্তির আভাস পাওয়া যায়। দিনের পর দিন সময়কে ভুলে গিয়ে কেবল সেই পরম সৌন্দর্য উপভোগে এবার যেন আস্তে আস্তে ভাটা পড়তে চাইছে। তবুও খটকা লাগে। “হেরো আজি ভোরবেলা এসেছে রে মেলা লোক”, এদের হাত থেকেই কি বাঁচতে চাইছেন? নীরবে নির্জনে সেই সুন্দরকে আরও নিবীড়ভাবে পেতে চাইছেন? তা কি আর হতে পারছে না দশ নম্বর সদর স্ট্রীটে মাসিক ১৯০ টাকায় ভাড়া করা ঐ প্রাসদোপম বাড়ীতে? যে সুন্দরকে তিনি অনুভব করছেন, এই কয়েকদিনে সে এতটাই প্রাণের হয়ে গেছে যে, সে যেন তার সখা, বন্ধু, তাকেই কি তুই সম্বোধন করে বলছেন, “আয় তুই কাছে আয়, তোরে মোর প্রাণ চায়, / তোর কাছে শুধু বসে রই। / দেখি শুধু, কথা নাহি কই।”

      এর উত্তর কখনই জানা যাবে কি? কোন রবীন্দ্রবিশেষজ্ঞই বলতে পারবেন, এই সমাপনসংগীত সেই বোধ থেকে মুক্তির ইচ্ছাপ্রকাশের সংগীত, না কি সেই বোধকে আরও অন্তরের নিভৃতে থাকা এক সিংহাসনে রাজার মতো বসিয়ে রাখার সংগীত। যে প্রতিদিন সূর্যোদয়ের প্রাক্কালে তার সামনে এসে বসত। চুপ করে। শুরু হত সংগীত। যে সংগীত তারা দুজন ছাড়া আর কেউ শুনতে পেত না। “জগতে আমাদের বিজন সভা, কেবল তুমি আর আমি-- / সেথায় আনিয়ো না নূতন শ্রোতা মিনতি তব পদে স্বামী!”

বাকিরা কি দেখত? স্তব্ধ, নির্বাক, শ্বেতশুভ্র এক রাজাধিরাজ যেন সনাতন বৈদিক যুগ থেকে উঠে এসে স্থিরভাবে বসে রয়েছেন প্রভাত-রবির দিকে চোখ মেলে। আর শুনছেন বিশ্বহৃদয় পারাবার থেকে উত্থিত অশ্রুত সেই গান, যিনি আদিতে বাক্য ছিলেন...

------------------------------------------

তথ্যসূত্রঃ রবীন্দ্র রচনাবলী, জীবনস্মৃতি, প্রভাতসংগীত, মানুষের ধর্ম, ছিন্নপত্রাবলী, কাহিনী, রবীন্দ্রজীবনী – প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, ‘এই সময়’ দৈনিক সংবাদপত্র।

[ছবি কৃতজ্ঞতাঃ সমর্পিতা]

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে