প্রভাতসংগীতের মূর্ছনায় তিনটি কবিতা
আমার রবীন্দ্রনাথ – পর্ব ৮
এই কাব্যগ্রন্থটি পড়তে গিয়ে প্রথম আমার মনে প্রশ্ন জাগে, কাব্যগ্রন্থের নামে ‘সংগীত’ শব্দটার ব্যবহারের কারণ কি? তৎক্ষণাৎ খেয়াল করি, একটি নয়, তিন-তিনটি কাব্যগ্রন্থের নামে ‘সংগীত’ শব্দটি যুক্ত। শৈশব সংগীত, সন্ধ্যাসংগীত এবং প্রভাতসংগীত। ভাল করে খেয়াল করলে দেখা যাবে, কবিতাগুলির মধ্যে যে ছন্দ আছে তা সুরেলা। এই সুরের টাইপ অতীত গ্রীসের ধারাকে বহন করে। গ্রীকরা সুর করে ছন্দোময় পদ আবৃত্তি করত বলে সেই কবিতাগুলিকে ‘লিরিক’ বলা হয়। কালক্রমে যেখান থেকে এসেছে ‘লিরিক্স’ শব্দটি। রবীন্দ্রনাথ উক্ত তিন কাব্যগ্রন্থে তার কবিতাগুলিকে আবদ্ধ করেছেন এই ছন্দোময় সুরে। ফলে শিরোনামে এসে পড়েছে ‘সংগীত’ শব্দটি। এই কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার পর ভূদেব মুখোপাধ্যায় তাকে ‘প্রকৃত আর্য-কবি’ হিসাবে ভূষিত করেন। মজার ব্যাপার, প্রথম প্রকাশিত বইতে দেখা যায় – শব্দটি ‘সঙ্গীত’। পরবর্তীকালে পরিবর্তিত বানান – ‘সংগীত’, যা বর্তমান রবীন্দ্র রচনাবলীতে গৃহীত রবীন্দ্রসন্মতিনুসারে। এখনকার ‘বাঙালা ভাষা বাঁচাও’-এর সদস্যরা আরেকবার ‘গেল গেল’ রব তুলবেন না কি?
প্রভাতসংগীতের কালবিজয়ী রচনা ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’, এবং
দেখা যায়, আমরণ তিনি এই ভাবেরই অনুগামী ছিলেন। একুশ বছরের নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গের
কবি বাহাত্তর বছর বয়সে যখন ‘মানুষের ধর্ম’ লিখছেন, তখনও এই ভাবের আরোও পূর্ণতর
প্রকাশের কথাই বলছেন। অথচ, আটাত্তর বছর বয়সে, যখন রচনাবলীর কারণে নতুন করে
প্রভাতসংগীতের সূচনা লিখছেন, দেখা যাচ্ছে, সূচনাপর্বে মাত্র তিনটে কবিতার কথাই
গুনগুনিয়ে বলছেন --- অনন্ত জীবন, অনন্ত মরণ এবং প্রতিধ্বনি।
প্রসঙ্গত, ‘অনন্ত মরণ’ কবিতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে কবি
বলছেন, “মুহূর্তকালীন মৃত্যুপরম্পরা দিয়ে মর্ত্যজীবন এই যেমন বেড়ে চলেছে
প্রবালদ্বীপের মতো, তেমনি মৃত্যুর পর মৃত্যু আমাকে দিয়ে লোক-লোকান্তরের অভিজ্ঞতার জাল বিস্তার
করে চলবে -- আমার চেতনার সূত্রটিকে মৃত্যু এক-এক ফোঁড়ে এক-এক লোককে সম্বন্ধসূত্রে
গাঁথবে।” রবীন্দ্রনাথ কি জন্মান্তরবাদ মানতেন? কোথাও আমি এ সম্পর্কে কিছু পড়ি নি।
কিন্তু একসময়ে প্ল্যানচেটে গভীর আগ্রহ থাকা এই মহামানবের লোকান্তরের ইঙ্গিতের
মধ্যে জন্মান্তরে বিশ্বাস করার আভাস পাওয়া যায়।
প্রথম দুটো কবিতা আমার একটু অদ্ভুতই লেগেছে। ‘অনন্ত জীবন’
কবিতার কথাই ধরুন না। “পৃথিবীতে উঠিয়াছে আনন্দলহরী / তোরা তার একেকটি ঢেউ,
/ কখন উঠিলি আর কখন মিলালি / জানিতেও পারিল না
কেউ।” বিশ্বজীবনের পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষুদ্র জীবনের অস্তিত্বই
বা আর কতটুকু? তবুও যেন তার সৌন্দর্যের কোন ঘাটতি নেই। তার অস্তিত্ব কীভাবে থাকে?
স্মৃতিপথে। “স্মৃতির কণিকা তারা স্মরণের তলে পশি / রচিতেছে
জীবন আমার--” কয়েক লাইন পরেই লেখা তার এই লাইন দুটো আমাকে
মনে করিয়ে দেয় অন্যত্র তারই একটা লেখা---
“মানুষের দ্বিতীয় বাসস্থান স্মৃতিলোক।
অতীতকাল থেকে পূর্বপুরুষদের কাহিনী নিয়ে কালের নীড় সে তৈরি করেছে। এই কালের নীড়
স্মৃতির দ্বারা রচিত, গ্রথিত। এ শুধু এক-একটা বিশেষ জাতির
কথা নয়, সমস্ত মানুষজাতির কথা। স্মৃতিলোকে সকল মানুষের মিলন।
বিশ্বমানবের বাসস্থান -- এক দিকে পৃথিবী, আর-এক দিকে সমস্ত
মানুষের স্মৃতিলোক। মানুষ জন্মগ্রহণ করে সমস্ত পৃথিবীতে, জন্মগ্রহণ
করে নিখিল ইতিহাসে।” মানুষের তিনটি বাসস্থানের দ্বিতীয়টির
কথা বলছেন তিনি ‘মানবসত্য’ নামক প্রবন্ধে, ১৯৩৩ সালে। একদম জীবনের প্রান্তে এসে। বহির্জগত
আর অন্তর্জগতের মাঝে জীবন আর মরণ এসে কোথাও মিশে যায় কি? বোধহয় সে ভেদরেখা মুছে
যায় অনেকটা দিগন্তরেখার মতো। যার অস্তিত্ব নেই, কিন্তু ব্যক্তিত্ব আছে। “কোথা যে
কে মিশাইল, কেবা গেল কার পাশে / চিনিতে পারি নে তাহা আর।”
আমার কাছে এই জীবন-মৃত্যু বড়ো রহস্যের। দুটোরই কোন প্রকৃত
রূপ নির্ণয় করতে পারি না। আমরা কি বেঁচে আছি? উত্তর যদি ‘হ্যাঁ’ হয়, তাহলে কি এই
প্রশ্ন ওঠে না যে, পূর্বমুহূর্তটা মরছে বলেই পরমূহূর্ত জন্ম নিচ্ছে? জীবনের আবেদন
মৃত্যুর কারণেই। জীবনের মধ্যে দিয়ে চলে যাওয়া আর মরণের মধ্যে দিয়ে চলে যাওয়া কি এক
নয়? আসলেই কি মৃত্যু আমাকে এগিয়ে নিয়ে যায় না? যদি প্রশ্ন হয় কোন দিকে? একটাই
উত্তর --- সামনের দিকে। এই সামনের দিক-টা যে ঠিক কিরকম, মৃত্যু না আসলে তা যেন
বোঝার জো নেই। জীবন আর মৃত্যু একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ।
“যতটুকু বর্তমান,
তারেই কি বল' প্রাণ? / সে
তো শুধু, পলক, নিমেষ। / অতীতের মৃত ভার
পৃষ্ঠেতে রয়েছে তার, / না জানি কোথায় তার শেষ।” সত্যিই তো! পথের শেষ কোথায়? কি আছে শেষে? “এই জগতের
মাঝে একটি সাগর আছে / নিস্তব্ধ তাহার জলরাশি, / চারিদিক হতে
সেথা অবিরাম অবিশ্রাম / জীবনের স্রোত মিশে আসি।” তাহলে জীবন
আর মৃত্যু কি? তারাও কি এই সাগরেই এসে লয় হয়? “জীবন যাহারে
বলে মরণ তাহারি নাম, / মরণ তো নহে তোর পর।” এই চলার পথে আমার কি উপায়? ভয়, না নির্ভয়? শেষ, না শুরু? আছে, না নেই? “প্রাণ ওরে, গান গা পাখির মতো, / ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দুঃখ শোক ভুলি-- / তুই যাবি, গান
যাবে, একসাথে ভেসে যাবে / তুই আর তোর গানগুলি। / মিশিবি সে
সিন্ধুজলে অনন্তসাগরতলে, / একসাথে শুয়ে রবি প্রাণ, / তুই আর তোর এই গান।”
আর এই সাগরতল থেকে উঠে আসে প্রতিধ্বনি। তা
শোনা যায়। তাকে দেখা যায় না, ধরা যায় না। “বিশ্বসৃষ্টি হচ্ছে একটা ধ্বনি, আর সে
প্রতিধ্বনিরূপে আমাকে মুগ্ধ করছে, ক্ষুব্ধ করছে, আমাকে জাগিয়ে রাখছে, সেই সুন্দর, সেই ভীষণ। সৃষ্টির সমস্ত গতিপ্রবাহ নিত্যই একটা কোন্ কেন্দ্রস্থলে গিয়ে
পড়ছে আর সেখান থেকে প্রতিধ্বনিরূপে নির্ঝরিত হচ্ছে আলো হয়ে, রূপ
হয়ে, ধ্বনি হয়ে।” ‘প্রতিধ্বনি’ কবিতা রবীন্দ্রনাথের এই
জীবনদর্শনের অন্তিম পৈঠা। সেখানে কেবল থাকে তার মহিমা। অনন্তের মহিমা, যে মহিমা
স্বয়ং অনন্তকেও ছাপিয়ে যায়। (অনন্ত) জীবন আর (অনন্ত) মরনের সীমানা ছাড়ায়ে সে বন্ধু
দাঁড়িয়ে থাকে আমারই অপেক্ষায়। কেবল পড়ে থাকে সেই মহামহিমময় প্রভুর এক আভাস। নিবিড়
তিমির চন্দন মাখা জ্যোৎস্নায় রাতপাখীদের মোহময় ডাকে, কিম্বা প্রখর তপ্ত মেঠো রোদের
অসীম মাটিজ্বলা তীব্র বেদনার মাঝে দূর থেকে ভেসে আসা ক্লান্ত মাতৃস্বরের ঘরে ফেরার
ডাকের মতো---
কত বার আর্ত স্বরে শুধায়েছি প্রাণপণে,
অয়ি তুমি
কোথায়-কোথায়--
অমনি সুদূর হতে কেন তুমি বলিয়াছ
"কে
জানে কোথায়'?
অদ্ভুত ব্যাপার, অসীমের এই মহান প্রতিধ্বনিময় রূপকে তিনি
আবিস্কার করেছিলেন দার্জিলিং-এর নির্জন বনবীথিকার মাঝে, যেখানে শান্ত, নিমগ্ন,
আত্মস্থ রবীন্দ্রনাথ, হয়তো বা, দশ নম্বর সদর স্ট্রীটের বারান্দা থেকে এক সকালে
পাওয়া সত্য-সুন্দরের অসীম চেতনার দ্যোতনা নিয়ে, অনন্ত জীবন এবং অনন্ত মরণের
দৃশ্যকল্পনাময় মতবাদটিকে কোন এক বিকালে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের নতুন বৌঠানের
স্নেহচ্ছায়ায় উপলব্ধি করে অবশেষে অন্তিম পর্যায়ের বেদনাভাসকে উপলব্ধি করেছিলেন
পাহাড়ের আলেখ নিরঞ্জিত সুরের প্রতিধ্বনির মাঝে, কোন এক রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিনের
কালচেতনার প্রস্ফুটিত মুহূর্তে, যেখানে মানুষ আর প্রকৃতি মিশে যায় আপন জৈবচেতনার
মাঝে, পড়ে থাকে শুধু মহাকাল – স্তব্ধবাক, স্থির, শান্ত... মাঝে মাঝে কেবল
গুনগুনিয়ে গেয়ে যায় লোকে-লোকান্তরে; তার কোন অর্থ নেই, কিন্তু সুর আছে; চেতনা নেই,
অচেতনের আভাস আছে; জন্ম-মৃত্যু নেই, জন্মান্তর আছে...
==================
তথ্যসূত্রঃ রবীন্দ্র রচনাবলী, প্রভাতসংগীত, মানুষের ধর্ম,
রবীন্দ্রজীবনী – প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়
Comments
Post a Comment