অনুবাদ পত্রিকা ‘দলিত লেখিকার স্বতন্ত্র পথ’ সংখ্যা
আমার অবাক লাগে, যেখানে অনুবাদ সাহিত্যে ভাটার টান
সুষ্পষ্ট, বাংলাদেশের অনুবাদ থমকে থমকে পড়ে আমাদের তৃষ্ণা মিটাতে হচ্ছে কোনরকমে,
সেখানে, এরকম একটা পত্রিকা কীভাবে প্রতিবারই অদ্ভুত সব বিষয় বৈষিষ্ট্য নিয়ে হাজির
হচ্ছে!
জায়গা না-পেয়ে
দাঁড়িয়ে থাকা
গর্ভবতীর দৃষ্টি এড়াতে
বাসের বাইরে
দেখার
ভান করা
তুমি
আমার কাছে কী আশা কর
ভালোবাসা নাকি?
উপরের অনবদ্য কবিতাটি
সুকীর্তরানির। তিনি একজন দলিত লেখিকা। এমনই বেশ কিছু দলিত লেখিকাদের ইন্টারভিউ,
আত্মজীবনীর অংশবিশেষ আর গল্প-কবিতা নিয়ে এবারের অনুবাদ পত্রিকা। যদিও, আমি,
সুকীর্তরানি-র ‘আমার শরীর’ কবিতাটার অনুবাদ আশা করেছিলাম, বিশেষ করে, এই কবিতাটার
সূত্র ধরেই সাক্ষাৎকারের একটা বড়ো অংশ আলোচনা হয়েছে জাতিবাদ আর নারীশরীর কীভাবে
ওতপ্রোতভাবে জড়িত, তা নিয়ে, এবং কবিতাটা লেখিকারও অন্যতম প্রিয় কবিতা।
এই পর্যায়ের সাংঘাতিক সাক্ষাৎকারটি
বেবী কাম্বলের। দলিত নারী হিসাবে যিনি একসময় আম্বেদকরের পথ ধরে এগিয়ে চলা শুরু করেছিলেন,
দলিত সমাজ আস্তে আস্তে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করা শুরু করল, তিনিও সফল হলেন, এবং
তৎপরবর্তীকালে দলিত সমাজ কীভাবে নিজেরাই নিজেদের পথের বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে তার
সুষ্পষ্ট টাইম লাইন মাত্র পাঁচ পৃষ্ঠার মধ্যে পাওয়া গেল।
“তোমরা ভগবানে বিশ্বাস করে কত
প্রজন্ম তাকে দান করে দিয়েছ। এবার আমাকে একটা সুযোগ দাও। আমাকে এই প্রজন্মটির
দায়িত্ব দাও। কুড়ি বছরের জন্য কষ্ট করতে হবে। নিজেদের সন্তানদের স্কুলে ভর্তি কর।
প্রয়োজনে না খেয়ে থাকতে হবে। কিন্তু সন্তানদের লেখাপড়া করাতে হবে। কুড়ি বছর বাদে
তোমরা নিজেরাই এসে বলবে কোনটা প্রয়োজন ছিল --- ঈশ্বরের না শিক্ষার?” আম্বেদকরের এই
ডাককে উপেক্ষা করেন নি তারা। তারপর? দলিত দমনের প্রশ্নের উত্তরে আজ বেবী কাম্বলে
বলছেন, “আগে হত দলিতরা শিক্ষিত ছিল না বলে আর আজকে হচ্ছে তারা শিক্ষিত বলে। আগে
গোটা গ্রাম আমাদেরকে একঘরে করে রাখত... আজকের দিনে শিক্ষিত দলিতরা সেই একই ব্যবহার
করছে যা তাদের সাথে উঁচু জাতের গ্রামবাসীরা করে এসেছে।” পড়ে শিউরে উঠতে হয়।
আমাদের সমাজে মেয়েরা ‘দ্য সেকেন্ড
সেক্স’ --- অনেক পথ আসতে হয়েছে এই তকমাটা কাটিয়ে ওঠার লক্ষ্যে। পুরোটা কাটিয়ে উঠতে
পারিনি এখনও। আজও মেয়েদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় যে ব্যবহার পেতে হয়, পরিবারে কিম্বা
সমাজে, তাতে করে একথা একটা শিশুকন্যাও বুঝবে, তার ভাগ্যে আছে এক বিপুল লড়াই।
সেখানে দলিত নারীদের কেমন অবস্থা? এই সময়েও? সুকীর্তরানী বা মেরুনা মুর্মুর
সাক্ষাৎকারদুটো যথেষ্ট।
তুলনামূলক বামা-র আত্মজীবনীর
অংশটুকুর মধ্যে বিষয়বস্তুর কোন মিল নেই। কেন যে ওই অংশটুকু প্রকাশিত হল, তা আমার
বোধে এল না। এক দলিত রমণী কেমন বিভূতিভূষণ হতে পারে দেখুন --- এইটা দেখানোর কারণে
কি?
অনিতা ভারতীর আটটি কবিতার
পাশাপাশি এবারের গল্পগুলো এক-একটা জ্যান্ত দলিল। পড়ে চমকে উঠতে হয়। প্রথম দুটো
গল্পে (পি শিভকামী এবং গোগু শ্যমলার লেখা) বিদ্রোহের ছাপ স্পষ্ট। অন্যদিকে জূপাকা
সুভদ্রা আর উর্মিলা পাওয়ারের গল্প পড়ে অনেকক্ষন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। নারীর
অবমাননা কতটা হতে পারে, তাকে অসন্মান কতরকমভাবে করে দেখানো যেতে পারে, ভারতবর্ষ
তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে। দেবীপূজার ছল করে, কিম্বা ঈশ্বরের অংশরূপে তাকে নমন
এবং একইসঙ্গে দমন করার উপায়রূপে ‘মা’ শব্দের সুচতুর প্রয়োগে তার নারীসত্ত্বাটাকেই
বিলোপ করার চেষ্টা করা এক বড়ো উদাহরণ। আজও, কতরকমভাবে যে তাকে হেনস্থা হতে হয়,
ঘরে-বাইরে, তা যে কোন নারীমাত্রেই কম-বেশি জানে। যে জানে না, তাকে আমরা অবশ্যই অতীব
সৌভাগ্যবতী হিসাবেই দেখি। এই পর্যায়ের গল্পগুলো প্রাথমিক উদাহরণ হিসাবে যথেষ্ট।
বিতস্তা ঘোষালের ধারাবাহিকটা বেশ।
কিন্তু ধারাবাহিক বলেই হয়তো আমার মনে দাগ কাটে না। যেমন দাগ কাটে না ‘কাইট রানার’।
অপেক্ষা আমার ধাতে সয় না। তবু, লেখাটা পড়তে মন্দ লাগে না।
=========================
অনুবাদ পত্রিকা
‘দলিত লেখিকার স্বতন্ত্র পথ’
সংখ্যা
এপ্রিল ২০২৩
মুদ্রিত মূল্যঃ ৫০ টাকা
ছবি কৃতজ্ঞতাঃ সমর্পিতা
Comments
Post a Comment