স্মরণে সন্দীপ দত্ত
আমার বেশ কয়েকজন বন্ধু বলেছিলেন, এখনকার ম্যাগাজিনগুলো পড়া মানে সময় নষ্ট করা। আমিও
তাদের সাথে নব্বই শতাংশ সহমত। আমার মনে হয়, কিছু কিছু সংখ্যায়, এমন কিছু মণিমুক্তো
ভুল করে বেরিয়ে আসে, যাকে অস্বীকার করা অসম্ভব।
সম্প্রতি চলে গেলেন সন্দীপ দত্ত। ফেসবুকে ছেয়ে গেল তার প্রতি
শ্রদ্ধাজ্ঞাপনে, অথচ এমন কোন পোস্ট আমার চোখে পড়ল না যেখান থেকে এই মানুষটা
সম্পর্কে সম্যক পরিচয় পেতে পারি। সন্দীপ দত্ত-র কাজের সাথে পরিচয় হওয়া তো দূরের
কথা, তার নামটা পর্যন্ত এযাবৎ শুনি নি। অথচ, সমসাময়িক পত্রপত্রিকা তার সম্পর্কে
নীরব, হয়তো, লিটল ম্যাগাজিনগুলোর কয়েকটাতে তার সম্পর্কে লেখা বেরিয়েছে, কিন্তু
ফেসবুক, কিম্বা অন্যান্য সোশাল মিডিয়া সে তুলনায় এতটাই উদাসীন যে, কোন তথ্য পাই
নি। অথচ দুঃখবিলাসে ভরে গিয়েছিল এক-একটা বইয়ের গ্রুপ। আমার বন্ধুরাও তার ব্যাপারে
তেমন কিছু বলতে পারলেন না।
“অবসর বলে কিছু নেই, আমৃত্যু কাজ করে যেতে হবে।”
সন্দীপ দত্ত আমৃত্যু কাজ করে গেছেন। তার কাজের ক্ষেত্র ছিল লিটল
ম্যাগাজিন। যে লিটল ম্যাগাজিনকে তিনি মনে করতেন, “... সাহিত্যের আঁতুড়ঘর,
জন্মকালীন রক্তের দাগ ও গন্ধ লেগে আছে।” এই লিটল ম্যাগাজিনের সংগ্রহ, বলা হচ্ছে,
তার কাছে, এক লক্ষেরও বেশি। আমি নিজে কয়েকটি লিটল ম্যাগাজিন পড়েছি। আমার বিশ্বাস,
যদি কোথাও প্রশংসা ব্যতিরেকে পরীক্ষামূলক কাজ এখনও হয়ে চলেছে, তা এই লিটল
ম্যাগাজিনগুলোতেই। দুর্ভাগ্য, এদের কদর আমজনতার কাছে নেই।
“আমি ব্যক্তিগত ভাবে এই শহরে বহু গ্রন্থাগার, সংগ্রহকে ধ্বংস হতে
দেখেছি। লুঠপাট হতে দেখেছি। তার তালিকা দীর্ঘ।” লিখছেন হিরণ মিত্র। “এই রাজ্যের
গ্রন্থাগার-ব্যবস্থা ঠিকমতো নেই। কেমন এক হতশ্রী ছন্নছাড়া অবস্থা। মতিচ্ছন্নতার
অসুখ সংক্রামক ব্যাধির মতো ছড়িয়ে পড়েছে। অধিকাংশ গ্রন্থাগার হয়ে উঠেছে ভবনসর্বস্ব,
পাঠক পরিষেবা থেকে অনেক দূরে।” লিখছেন রমাপ্রসাদ দত্ত।
এতএব, লিটল
ম্যাগাজিনের অবস্থা কোন পর্যায়ে পৌছতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।
এদের সংরক্ষণের কোন ব্যবস্থাও নেই, এদের আলাদা করে লাইব্রেরীর কথা তো ভাবাই যায় না। কেবলমাত্র
এই একটি লাইব্রেরী তিলে তিলে সন্দীপ দত্ত গড়ে তুলেছিলেন --- কলিকাতা লিটল
ম্যাগাজিন লাইব্রেরী ও গবেষণাকেন্দ্র। জানলাম, লাইব্রেরীটা অনেক অনেক গবেষকের
তীর্থক্ষেত্র।
কেমন ছিলেন
সন্দীপ দত্ত? “এমন একবগগা, সৎ ও নির্ভেজাল মানুষ আর আমাদের চৌহদ্দিতে আসবে বলে মনে
হয় না। তার কারণ বিষয়কে খুবই গভীরভাবে অনুধাবন করার প্রবণতা, নিষ্ঠা এবং কর্ম
ক্ষমতা সবার থাকে না, সন্দীপের ছিল।” লিখছেন হিরণ মিত্র। “যৌথ সন্মেলনে তিনি
থাকতেন। কিন্তু বহুবার দেখেছি যদি বুঝতেন তার ভেতরে মিশছে ভন্ডামির চোরা নুন,
নিজেকে নীরবে বিচ্ছিন্ন করতেন তা থেকে, চলে আসতেন সম্ভ্রমসূচক দূরত্বে।” লিখছেন
সম্রাট মুখোপাধ্যায়। “পরস্পর হীন হিংস্রতা নয়, অহংকার নয়, সহনশীলতা সহৃদয়তার
প্রকাশ ছোট পত্রিকার যাত্রার পথ, যা সৃষ্টির, যত ক্ষুদ্র হোক না কেন, জন্মের মতো
পবিত্র, এর কাছেই বারবার নত হওয়া যায়।” বলছেন স্বয়ং সন্দীপ দত্ত।
‘জীবনানন্দ
প্রাসঙ্গিকী’ কিম্বা ‘স্ল্যাংগুয়েজ’ – এর মতোন বই তিনি লিখেছেন। লিখেছেন ছড়া,
সংকলন হয়েছে ‘ছড়া দিলাম ছড়িয়ে’ নামে। ‘বাংলা সাময়িকপত্রের ইতিবৃত্ত’
বেরিয়েছে দুই খন্ডে। জানি না, কেন ‘বাংলা কবিতার পঞ্জী’ নামক গবেষণাধর্মী গ্রন্থটা
আলোর মুখ দেখল না। কোন প্রকাশক দায়িত্ব নিয়ে আলো দেখাবেন কি? এর পাশাপাশি রয়েছে
অজস্র ছোট-বড়ো লেখা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়। তার সমস্ত লেখাগুলোকে নিয়ে সমগ্র বের
করার উদ্যোগ কেউ নেবেন কি? যে মানুষ গবেষণাধর্মী গ্রন্থ লিখতে পারেন, একটা হলেও,
আমি মনে করি না, বাংলা সাহিত্যে তার কোন অবদান নেই। বরং তার অবদান কতটা বা ‘শূন্য’
কি না সেটা নিয়ে এখনও জাঁক করে বলার সময় আসে নি।
জানি না,
আস্তে আস্তে তার এই লাইব্রেরীর অবস্থা কি হবে। নষ্ট হয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। কৃত্তিবাস
পত্রিকায় যারা তার সম্পর্কে নিবন্ধ লিখছেন, তাদের প্রায় প্রত্যেকেই এই আশঙ্কা
করেছেন বটে, কিন্তু আমার বিশ্বাস, তাদের কেউই নিজেরা উদ্যোগ নেবেন না। কথাই সার। বেসরকারী
কিম্বা সরকারী উদ্যোগে ডিজিটালাইজেশান করার কথা ভাবা হলেও উদ্যোগ নেওয়ার জায়গায়
আসতে আসতে হয়তো অধিকাংশ বই কীটদ্রষ্ট হয়ে যাবে।
দুর্ভাগ্য
আমবাঙালির। যারা চিরকালই রিবেলিয়ান কাজকে ব্রাত্য করেছে, বৈঠকী তান্ত্রিক বীভৎসতা
কিম্বা লুতুপুতু প্রেমজ জটিলতাকে আপন করে নিয়েছে। আর তারপর পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়েছে।
ধন্যবাদ
কৃত্তিবাস। অনেকদিন পর সংগ্রহে রাখার মতন একটা ম্যাগাজিন হাতে পেলাম।
======================
কৃত্তিবাস
লিটল নয়
গ্রেট – সন্দীপ দত্ত সংখ্যা
১৬ই মার্চ
২০২৩
মুদ্রিত
মূল্যঃ ৫০ টাকা
ছবি
কৃতজ্ঞতাঃ সমর্পিতা
Comments
Post a Comment