যে গল্পগুলোর জন্যে ম্যাগাজিনটা পড়া

#নববর্ষীয়_ম্যাগাজিন



“নববর্ষ। নামটা শুনলেই মনের মধ্যে জমতে থাকে একরাশ উড়ো মেঘের মতো আনন্দ, উচ্ছ্বাস। চৈত্রের শেষে আরও একটা নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর পালা। বৈশাখের পয়লা দিনে শাঁখ বাজিয়ে, সাড়ম্বরে সূচনা হয় বাঙালির নববর্ষের।”

লাইনগুলো পড়তে পড়তে আমি হি হি করে হেসে লুটিয়ে পড়লাম। আমার কাকা যখন ক্লাস সেভেনে পড়ত তখনকার শারীরশিক্ষার একটা ফাইল যত্নে আছে। কাকার লেখার হাত চমৎকার। ছোটবেলায় ওই হাতের লেখা দেখিয়ে আমাদের কানাচাপাটি দেওয়া হত খারাপ হাতের লেখার জন্যতো সেই খাতায় ‘পয়লা বৈশাখ’ নিয়ে লিখতে গিয়ে তার শুরুটা এরকম আছে --- “পয়লা বৈশাখ বাংলার ঘরে ঘরে মঙ্গলশঙ্খ বেজে ওঠে...”। অনিকেত গুহ-ও শুরু করেছেন সেরকমতিনি কি সানন্দার পাঠিকা বলতে নব্বইয়ের দশকের পাঠিকাদের ভেবেছেন? যদি ভেবে থাকেন, তাহলে বলব, মরণ! আপনি বাবু ঠিকই ভেবেছেন। এখনকার ইয়ং লেডিরা এই বাক্যবিন্যাস দেখলে হেসেই খুন হবেন। যদিও তারপরে নববর্ষ সবন্ধীয় পুরাতন আমলের তথ্য ঢেলে সাজিয়েছেন প্রবন্ধটা। অবশ্য কি-ই বা আর করা। নববর্ষে বাঙালিনীদের কিস্যু আসে যায় না। বরং দুঃখ হয়। হায়! আর সপ্তাহখানেক পরে এলে কী ভালোই না হত। চৈত্র সেলেই দূর্গাপূজার মার্কেটিংটা সেরে নেওয়া যেত। কম পয়সায় বড়িয়া গিফ্‌ট। তবে পুরো প্রবন্ধটা কিন্তু ক্লাস নাইনের বাংলা রচনার জন্য একদম একঘর।

তবে পায়েল সেনগুপ্তের ছোট্ট লেখাটা বেশ। তিনি লিখছেন, “এমনিতেই তো বাংলা ভাষা টিকবে কি টিকবে না, তা নিয়ে বুদ্ধিজীবী থেকে আমজনতা সকলেরই কালঘাম ছুটে যাচ্ছে” --- একদম ঠিক কথা।

আমি কিন্তু এবারের সানন্দা পড়েছি শুধুমাত্র গল্পগুলোর জন্য। বাকি বিভাগগুলো তাই আর ছুঁয়েও দেখি নি। এবারের ‘দেশ’ ম্যাগাজিনটা পড়ার পর থেকেই কোনটা বিজ্ঞাপন আর কোনটা কলাম বুঝতে পারছি নাতাঁর চেয়ে থাক ওসব থাক থোড়-বড়ি-খাড়া টাইপের শারীরশিক্ষার খাতা তৈরী করা রমণীকূলের জন্য, নিজেকে একদমই ব্যাকডেটেড ধরে নিয়ে আপাতত ওসব ত্যাগ করি আর আসি এবারের গল্পকথায়---

১। অনেকদিন পর বাংলা কোন ছোটগল্প জাস্ট ক্যাসুয়ালি পড়তে পড়তে নড়েচড়ে উঠে বসে মন দিয়ে পড়তে থাকলাম, এবং কখন যেন শেষ হয়ে গেল বুঝতেই পারলাম না। প্রচেত গুপ্তের ‘ট্রেন’ এক চিরন্তনী প্রশ্নকেই সুন্দর ঝরঝরে আঙ্গিকে পরিবেশন করল। সেই আঙ্গিকে দেখনদারি নেই, কায়দা নেই, উঁচুদরের কোন পাঞ্চলাইন নেই, চমকপ্রদ কোন ঘটনার ঘনঘটা নেইআছে কেবল একটা ট্রেন, আর একটা প্রশ্ন, “আমি বা রঞ্জন আসল নয়, আসল আমাদের ভালোবাসা। সে সব সময়ই নাছোড়বান্দা এবং নির্মম। না হলে আমার মা এমন একটা ভয়ঙ্কর কান্ড করে বসে?”

২। সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প ওপার বাংলার এক বৃদ্ধা বাসিন্দার গল্প। দেশভাগের পরের গল্প। স্মৃতিচারণ নয়, আবার স্মৃতিচারণও। যার মধ্যে বেশি মিশে আছে আবেগ। একটু গেট-টুগেদার, একটু ভাই-বোনের খুনসুটি, একটু হাতির গল্প, আর বাকিটা দিদার গল্প, তাঁর বারবার শিকড় ওপড়ানোর গল্প। ভালো, না খারাপ? ধুসসস... অতীত আবেগের মন্থন কি ভালো-খারাপ হয়? একটা স্মৃতিকে গল্প ধারণ করলে সেটা আর গল্প থাকে না, স্মৃতিচারণ হয়। তাই একে আমি গল্প বলতে নারাজ

৩। স্মরণজিৎ চক্রবর্তীকে গলায় আঁচল দিয়ে কড়জোড়ে বলি, আপনি উপন্যাস লিখুন, দোহাই, ছোটগল্প লিখতে যাবেন না। না আপনি একই ধরনের সিনেমা টাইপ বাংলা উপন্যাস থেকে বেরোতে পারছেন, না এক্সপেরিমেন্টাল ছোটগল্পে ঢুকতে পারছেন। আপনার নামকরণের জৌলুস ১৯৩৪ সালেও তাড়া করে বেড়াল। আর ছোটগল্প হয়ে গেল সত্তরের দশকের সিনেমার মতন ঔপন্যাসীয় বাহারী ককটেল।

৪। বিনতা রায়চৌধুরী ভুলে গেছেন চিঠি আর হোয়াটস অ্যাপের মধ্যে মূল যে ফারাক তা কথোপকথনেই। চিঠির মতো করে সুন্দর করে গুছিয়ে হোয়াটস অ্যাপে লেখা – বড্ড চোখে লাগে। অল্প কথায় অনেকটা লেখার যে ক্ষেত্র সেই জায়গাটায় ব্যর্থ হয়ে নিছক একটা চিঠিচাপাটি টাইপের হয়ে গেছে, তাও লেখায় আশির দশকের বাক্যবিন্যাসের স্টাইলে। হতে পারে ২০০৯ সালে আগে পরে প্রথম হোয়াটস অ্যাপ ভারতে লঞ্চ হওয়ার পরে পরেই এই ঘটনা, যদিও তা উল্লেখ নেই, যেখানে হয়তো প্রথম প্রথম গুছিয়ে লেখার চল ছিল। কিন্তু এরকম কথোপকথন ২০২৩ সালে দাঁড়িয়ে ভাবা যায় না, এবং ঘটনাটাও খুবই এক্সপেক্টেড। বিবাহ সম্পর্কের বদলে যাওয়া টানাপোড়েন। তারপর? আশির দশকের সিনেমার ডায়ালগে মাতৃপ্রীতিতে সমাপয়েৎ।

৫। কেউ যখন কোন চ্যালেঞ্জিং লেখা লিখতে চেষ্টা করে, আমার তখন বড় ভাল লাগে। রাজশ্রী বসু অধিকারীর লেখাটা সেই গোত্রের। একজন মানুষের অস্তিত্বের সংকটের গল্প। খুব কাছের সম্পর্কের চিরপরিচিত চেনা নিখুঁত সমীকরণও একসময় নিয়মের মধ্যে পড়ে যায়, বদলে যায় যা থাকে তা হল আগের সেই চাওয়াটা। “আমার মনের যত্ন নিতে ভুলে গিয়েছে মহুল”। এই মনের যত্নের অভাবে দুটো সম্পর্ক যে টানাপড়েনে এসে পড়ে তার গল্পই পুরুষ সঙ্গীর হৃদয়কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে। পুরুষটি ভুলে গেছিল, তার রমণীটিরও একইভাবে মনের যত্নের প্রয়োজন, যে যত্নটা করার দায়িত্ব তার। এমন টানাপোড়েনেরই ছান্দিক আলেখ্য। বড় সুন্দর লাগল প্রকাশভঙ্গীটা। অসাধারণ লাগল তার কাব্যিক রোম্যান্টিক পরিসমাপ্তিটাও

৬। কৃষ্ণেন্দু মুখোপাধ্যায়ের গল্প বেশ সুন্দর, সহজ, সরল, ঝরঝরে। তেমন কোন টানাপোড়েন নেই। আছে কেবল মেয়েলী অভিমানের সাথে সাথে প্রতিদিনের এক টুকরো প্রেম কিম্বা সম্পর্কের স্বাভাবিক সহাবস্থানের এক টুকরো কোলাজ। আমার তো মন্দ লাগল না। গল্পের কনটেন্ট ধরে এগোলে, পড়া শেষে বলতে হয়, বেশ...!

===========================

সানন্দা

নববর্ষ ১৪৩০ বিশেষ সংখ্যা

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে