নায়কদের ‘অভিনব’ কোলাজের নববর্ষ



নায়কের জন্য বাঙালীর আবেগ মাত্রাছাড়া। আমরা বরাবর নায়কের জন্য কেঁদে মরেছি। আর এখন ‘নায়ক নেই, নায়ক নেই’ বলে হাহুতাশ করছি। এই হাহুতাশ থেকেই জন্ম হচ্ছে মধ্যমেধার, সাহিত্য-শিল্প-সংগীত-চিত্রকলা, সর্বত্রই মাঝারিয়ানা জায়গা করে নিচ্ছে। ফলে বারবার তাকাতে হচ্ছে গৌরবময় অতীতের দিকে। সেখানেই খুঁজে নিতে হচ্ছে আলো।

বড় দামী কথা বলেছেন সব্যসাচী সরকার। নায়কের জন্য আমাদের হাহাকার এতটাই সর্বজনবিদিত যে, খেয়ালই করছি না, আমরা অন্ধকার থেকে আরও অন্ধকারে ঢুকে পড়ছিএমন অবস্থা থেকেই আমরা নায়কের খোঁজ করছি। কৃত্তিবাসও তাই করছে। নয় কি? সম্পাদক লিখছেন, “নানা ক্ষেত্র জুড়ে এ হেন শ্রেষ্ঠ দশ বাঙালি ব্যক্তিত্বকে দুই মলাটের মাঝে ফের চিনে দেখার প্রয়াস।’ বেশ। তবে তাদের দাবী, ‘এই প্রয়াস অভিনব’। তাই কি? মোটেই তা নয়। গড়পড়তা বাঙালিরা প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে কাউকে না কাউকে খুঁজেই চলেছে, যার পায়ে তার মাথাটি বিকিয়ে ‘হরিবোল’ বলে দিনাতিপাত করবে। আর যারা প্রশ্ন করবে, তাদের মুণ্ডপাত করবে। অথচ এই নায়কেরা কি করেছেন তার বেশিরভাগই কেউ জানে না। ভালো লেগেছে, অনেক লোকে মানছে, আমি তাকে আমার নায়ক করলুম, বাস! কোন কথা হবে না বস্‌...

এই যেমন ধরুন ‘কৃত্তিবাস’ তার প্রথম নায়ক বেছেছেন অমর্ত্য সেন’কে। অথচ অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য লিখলেন, “এই প্রজ্ঞার পর্বতাচারী পাণ্ডিত্যের জ্ঞানচর্চার বিষয়ে কিছু বলার অধিকার যোগ্যতা সাহস কোন কিছুই আমার নেই।” আমার প্রশ্ন, তাহলে আপনার লেখারই বা কি দরকার ছিল? কোন অমর্ত্য সেন বিশেষজ্ঞকে দিয়ে লেখানো উচিৎ ছিল। জানি, বঙ্গে তেমন কোন বিশেষজ্ঞ নেই। সেক্ষেত্রে বিদেশী কারো লেখা অনুবাদ করানো যেত। মোট কথা, অমর্ত্য সেন সম্পর্কে, মানে লোকটা কেন ‘নায়ক’, তা বোঝার উপায় অন্তত এই লেখাটা পড়ে বোঝা যাবে না। শুধু বোঝা যাবে, শান্তিনিকেতনের জমিটা কার।

রুদ্রপ্রসাদেরও একই অবস্থা। একটাই কথা বুঝলাম, তিনি বাংলা থিয়েটার জগতে অনেক কিছু করেছেন এবং বৃদ্ধ মানুষটি এখন অজ্ঞাতবাস করছেন। বরং শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে লেখাটাতে, যে তাকে চেনে না, সে তার সম্পর্কে একটা মোটামুটি ধারনা পাবে। কি কি বই পড়লে তার জাত চেনা যাবে, সে সম্পর্কে খুব সুন্দর আলেখ্য হল এই লেখাটা। একই বক্তব্য যোগেন চৌধুরীকে নিয়েও। মৃণাল ঘোষ আর্ট বিশেষজ্ঞ। তিনি জানেন শিল্পীর ঠিক কোন কোন কাজ তাকে বৃহৎ শিল্পী বানিয়েছে। তার ছোট্ট লেখাটার মধ্যে আর্ট কলেজের স্টুডেন্টদের অন্তত বেশ কিছু নোটস করার জায়গা থাকবে।

বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য আরেক বঙ্গনায়ক। লেখাটার একটা জায়গায় এসে আমার বেশ মজা লাগল। শঙ্করলাল ভট্টাচার্য লিখছেন, “গীতবিতান ছিল ওঁর কাছে বাইবেল, গীতার মতো।” একজন কমিউনিস্ট যদি পূজা পর্যায়ের গানে মুগ্ধ হয়, গীতা বাইবেলের কথা বলেন, তাহলে এই নাস্তিকের অন্তরে এক মরমী ঈশ্বর অজ্ঞাতবাস করেছেন, ব্যাপারটা ভাবায়। তবে উনি যে সার্থক অনুবাদক, সেটার উল্লেখ বোধহয় দরকার ছিল। মার্কেজের দুটো বইয়ের অনুবাদ ভোলার নয়। অপর্ণা সেনকে নিয়ে রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়, পি সি সরকার জুনিয়রকে নিয়ে মানস চক্রবর্তী আর চন্দ্রশেখরকে নিয়ে আইভি চট্টোপাধ্যায়ের কলাম মোটামুটি। সুন্দর লাগল দেবজ্যোতি মিশ্রের লেখা, অজয় চক্রবর্তীকে নিয়ে। আবেগী লেখা। আর শেষে? দ্য গ্রেট সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কে নিয়ে ‘থোর বড়ি খাঁড়া’।

রূম্পা দাশ ভট্টাচার্যের ‘বাঙালীর রম্যরসনা’ তথ্যবহুল, পড়তে মন্দ লাগে না। একই কথা পবিত্র সরকারের নববর্ষ নিয়ে আলতো চড়-থাপ্পর টাইপের প্রবন্ধযা পড়লে পাঠক একটু ‘আহা উহু’ করবে, তারপর ভুলে যাবে।

এই পর্যায়ের দারুন হতে চলেছে চারটে নতুন ধারাবাহিক। হ্যাঁ হ্যাঁ, চারটে। অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য ও অমরেন্দ্র চক্রবর্তীর স্মৃতিকথন তথা আত্মজীবনী। সাহিত্য অকাদেমী পুরস্কারপ্রাপ্ত তপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ধারাবাহিক নব-উপন্যাস ‘উপমা কালিদাসস্য’ কালিদসকে নিয়ে এক জীবনালেখ্য, এবং দ্য গ্রেট রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের বইয়ের আলোচনা, যেটাতে তিনি সত্যিই গ্রেট কাজ করে চলেছেন এ পর্যায়ের বই, সলমন রুশদীর সাম্প্রতিক উপন্যাস – Victory City

আছে রণজিৎ দাশের কবিতাগুচ্ছ। একটা-দুটো কবিতা চমকে দেওয়ার মতো। “একদা আমি তাকে আদর করতাম / এখন আমি তার সেবা করি---” এমনভাবে শুরু হয় এক যুগলের কবিতা... আহা! শেষ হয়, “একদা আমরা দুজন / স্বামী-স্ত্রী ছিলাম / এখন অন্তিম বন্ধু, পারানির কড়ি।” কয়েকটা লাইনে ওল্ড জেনারেশানের বর্তমান স্বাভাবিকী সম্পর্কের পরিণতিকে ছবির মতো বলা হয়ে গেল যেন...

দুটো ছোটগল্পসমেত বাকি সব টুকটাক... ঠিকঠাক...

===============================

কৃত্তিবাস

“১০ জনে শ্রেষ্ঠ বাঙালী এবং বাঙালীর রম্যরসনা”

মুদ্রিত মূল্যঃ ৫০টাকা


Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে