আমার মা

 



কাল সন্ধ্যাবেলা হঠাৎ করে কাঁপতে কাঁপতে আমার ঘরে এসে হাজির আমার মা। তাকে দেখে ভুত দেখার মত চমকে উঠেছি। আপাদমস্তক একটা পাতলা কম্বল মুড়ি দিয়ে হাজির। এমন গরমে এমন চমৎকার রসিকতা করার স্বভাব ও ক্ষমতা মায়ের নেই। পয়লা এপ্রিল হলেও না।

“দ্যাখ তো, কেমন যেন শীত শীত করছে আমার। মাথাটা ধরেছে। গা-হাত-পা ব্যাথা...”

গায়ে হাত দিয়ে দেখলাম, বেশ জ্বর। মাপলাম। ১০০.৮। অতঃপর কাঁপতে কাঁপতে তিনি তার ঘরে গেলেন। আমি রান্নাঘরে। চা-বিস্কুট ছাড়া প্যারাসিটামোল দেওয়া যাবে না। ভাই গেল বাজারে রুটি আনতে। আমি রুটি বানালে দক্ষযজ্ঞ ঘটবে। বাবা দেখতে লাগলেন একপাশে বসে বসে। মাঝে মাঝে গল্প করে করে মা’কে খাওয়াতে লাগলেনচা শেষে প্যারাসিটামল।

আমার মা যতক্ষণ সুস্থ থাকে একদম পেন্ডুলামের মতন দৌড়ায়। সকালে মায়ের চোখ খুলল তো প্রথম বাক্যই হয়তো বলবে, আজকে কিন্তু মনে করে অমুক জিনিসটা আনতে হবে। আমাদের প্রত্যেকের ঘুম থেকে উঠে সিস্টেম আপ হতে সময় লাগে। মায়ের সিস্টেম ঘুমানোর সময় স্লিপিং মোডে থাকে। কোনদিনও শাট ডাউন হয় না। জেগে উঠলেই সব মিনিমাইজ করা সফটওয়ার ওপেন সমেত হাইপার এক্টিভেটেড হয়ে যায়।

এক-একসময় এই রমণীকে দেখে আমার খুব আশ্চর্য লাগে। বছরের পর বছর ধরে একটা সংসারকে সচল করে রাখা, তার সাথে সাথে আত্মীয়-স্বজনদের সাথে নরমে-গরমে সম্পর্ক রেখে চলা ছাড়া সাংঘাতিক কিছু তিনি করছেন কি? কোথাও ঘুরতে গেলেও তার মাথার মধ্যে সংসারই থাকেকে মোজা পরেনি, কার জুতোতে কাদা লেগে আছে, কেনাকাটির সময় কার জন্যে কি কিনতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি... তারপরেও মনে হয়, এই যে কাজটি উনি বছরের পর বছর ধরে করে চলেছেন, এর থেকেও সাংঘাতিক কিছু আছে কি?

বাবার মুখে শুনেছি, পাহাড়ের সামনে মা একবার চুপ করে বসেছিল। বেশ কয়েক বছর আগেকার কথা। দার্জিলিং-এ গিয়ে যেদিন পৌছেছি, প্রবল ঝড়বৃষ্টিতে সেদিন থেকেই আটকে আছি হোটেলেহোটেলের ঘরে টুকটাক খাওয়া-গল্প চলছে। আমি আর ভাই বিরক্তিতে ফেটে পড়তে চাইছি। অথচ বেরোনোর কোন উপায় নেই। ফেরার আগের দিন ভোরবেলা হঠাৎ করে আকাশ পরিস্কার। আমাকে আর ভাইকে না জাগিয়ে বাবার হাত ধরে মা চলে গিয়েছিল ম্যালে। সেদিন ঘুমন্ত বুদ্ধকে দেখা গিয়েছিল রাজার বেশে, আপন খেয়ালে সমাধিস্থ। চুপচাপ চেয়ারে বসেছিল মাএক পর্যায়ে বাবাকে বলেছিল, তুমি যাও। একটু ঘুরে এসো। আমি কিছুক্ষণ একা থাকতে চাই।

একা! এই রমণী ওই একবারই একা থাকতে চেয়েছিলকেন? কাঞ্চনজঙ্ঘাকে প্রাণভরে দেখতে চেয়েছিল? সমাহিত হতে চেয়েছিল তার অপরূপ মহিমার সামনে? না কি দূর অতীতের ঘুমিয়ে পড়া অনেক চাওয়া-পাওয়া তার মধ্যে হঠাৎ করেই আনাগোনা করতে শুরু করেছিল? এ রহস্যের সমাধান হয় নি। আমি খানিকটা আন্দাজ করতে পারি। তবে জিজ্ঞাসা করি নি কোনদিন। কিছু রহস্য রহস্য থাকাই ভাল।

বিবাহিত নারীজীবনে কি খুব কমই সুযোগ আসে একা হওয়ার? নিজের সাথে নিজের মুখোমুখি হওয়ার? আমার মা কি সারাজীবনে ওই একবারই মুখোমুখি হয়েছিল নিজের সাথে? না কি বহুদিন পরে একবার, আরও একবার নিজেই নিজেকে দেখতে চেয়েছিল? কি দেখেছিল? কি আপোষ করেছিল? কিম্বা কোন মহিমায় মহিমান্বিত করতে পেরেছিল এমন সাংসারিক সাধনার মধ্যে দিয়ে?

কাল, সবার খাওয়া শেষ হলে যখন আবার আমি রান্নাঘরে গেলাম, গোছানোর জন্য, রান্নাঘরের দিকে তাকিয়ে আমার কান্না পাচ্ছিল। তার এত বছরের ঘরকন্না কি অবলীলায় ছত্রাখান করে দিয়েছি আমি! জানি না তো, কোথায় কি আছে, কি থাকে, কিভাবে রাখতে হয়, কোথায় রাখতে হয়। মাত্র কয়েক ঘন্টায় তার এত বছরের ঘরোয়া সৌন্দর্য উলোট চন্ডাল করে দিয়েছি। আমার মনে পড়ছে না কোথায় কি রেখেছিল যত্ন করে। আমার কাঁধের পাশ থেকে উঁকি মেরে ভাই বলল, তুই করেছিস কি রে দি! মা দেখলে বটি নিয়ে তাড়া করবে!

রাত্রে শোয়ার আগে ওষুধ খেয়ে নিয়ে আমাকে মা একটা কথাই বলল, আমি অনেকটা ভাল আছি। তারপর মুচকি হেসে বলল, রান্নাঘরটা আমি আবার কাল ঠিক করে দেব। ভাবিস না।

আমি মা-র মধ্যে ইদানীং আর মা-কে খুঁজি না। তার মধ্যে এক কিশোরীকে খুঁজি, যুবতীকে খুঁজি, যাকে সে একরাত্রের মধ্যে ফেলে এসেছিল চিরচেনা জগতে, আর ঠিক পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠেছিল আরেক অচেনা জগতে, যা কয়েক দশক পর আজ তার কাছে চিরচেনা, চির আপন। তার সেই ছোট ছোট ইচ্ছাগুলোকে কি অবলীলায় মনের কোন বর্মীবাক্সে রেখে দিয়েছে, শুধুমাত্র আমাদের নিশ্চিন্তে রাখার জন্য, কে জানে!

 

অনেক রাত্রে আমি বাবা-মায়ের ঘরে ঢুকি। শান্ত, স্তব্ধ। কি আরামের এই ঘরটা! সেই ঘরের মাঝে আমি খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকি। এবং হঠাৎ করেই এক চিরচেনা গন্ধ পাই। দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণী মায়ের মন্দিরের গন্ধ...

 

[ছবি কৃতজ্ঞতাঃ তৌসিফ হক]

Comments

Post a Comment

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে