নববর্ষে নবরসের ঝিনচ্যাক দেশ’জ কোলাজ



“তুমি গেছো, স্পর্ধা গেছে, বিনয় এসেছে

এক-একটা গল্প পড়ছি, আর শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার লাইনটা বার বার মনে মনে আবৃত্তি করছি। কেন? আরে দাড়ান দাড়ান... সবুরে মেওয়া ফলে...

      এবারের দেশ পত্রিকার নববর্ষ সংখ্যায় নবরসের ওপর নটি আখ্যান। নবরস কি? শৃঙ্গার, হাস্য, করুণ, রৌদ্র, বীর, ভয়ানক, বীভৎস, অদ্ভুত এবং শান্ত। এক-একটা রস নিয়ে এক-একজন লেখক লিখেছেন ছোটগল্প। প্রচ্ছদ দেখে খাবি খেলাম। মুখ বন্ধ করা নয়টি মানুষ। কি বলতে চাইছেন শিল্পী? গল্পগুলো পড়লে কি বাক্যস্ফুট হবে না? এমনই ধুমধাড়াক্কা গল্পগুলো? কেন নয়? নবীন প্রবীন লেখক লেখিকারা মিলে লিখেছেন। স্মরণজিৎ চক্রবর্তী থেকে শুরু করে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় পর্যন্ত! কেমন লিখেছেন তারা? এক-এক করে বলা যাক---

১। স্মরণজিৎ চক্রবর্তীর ‘স্বপ্নের মতো’ গল্পের নায়ক রাজা দক্ষিণ কলকাতার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া মডার্ন ছেলে। অথচ সে এমন উত্তমকুমার টাইপের দুধেভাতে বাঙালী যে কি না শৃঙ্গার রস কি তা জানে না! অথচ গল্পের শুরু তার শৃঙ্গার স্বপ্ন দিয়ে! কেমন সে স্বপ্ন? পঞ্চাশের দশকের সিনেমাগুলোতে যেমন প্রেম দেখাত তেমন। সে মুচুমুচু কাব্যিক স্বপ্ন দেখে। আবার বাস্তবে প্রেমিকা দূউউউউউউউরে কারো হাত ধরে বসে থাকলে মুখ ফুলিয়ে ছাদে বসে কান্নাকাটি করে, অফিস যায় না, খাওয়া দাওয়া করে না, মানে গোঁসাছাদে গিয়ে খিল দেয়মনে হচ্ছিল, বাংলা সিরিয়ালের একটা অংশ এসেছে গল্প হয়েলেখক কি নিজেই জানেন, শৃঙ্গার রস কি? তাকে কিভাবে লিখতে হয়, অন্তত আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে?

২। প্রচেত গুপ্তের ‘একটি নিরীহ কলার খোসা’ নামক হাস্যরসের গল্পে কে কে হেসেছেন দয়া করে কমেন্টসে এসে বলে যাবেন। নন্দগোপাল সেন কি টাইপের বস্তু  তা একপাতা জুড়ে লিখেছেন। তিনি অবিবাহিত, গম্ভীর, স্বভাবে পুরোনোপন্থী, ধুতি পরে হাটাচলা করেন। যার বয়স তেত্রিশ বছর তিন মাস... থুড়ি চৌত্রিশ বছর... থুড়ি তেত্রিশ... ইয়ে চৌত্রিশ... না না তেত্রি... যাই হোক, এটাও হয়তো লেখকের হাসির প্যাঁচদুজায়গায় দুরকম বয়েস লিখে বসেছেন তো এই নন্দবাবু কলার খোসায় পা দিলেন, চিত্তির হলেন, একটি মেয়ে তা দেখে হাসল, তিনি থানায় গেলেন মেয়েটির বিরুদ্ধে নালিশ করতে, মেয়েটি আবার সেই দারোগার মেয়ে, অবশেষে মেয়েটিকে বিয়ে করলেন, আর জিন্স পরা মডার্ন বর হয়ে গেলেনকার কার হাসি পেল? হাত তুলবেন... থুড়ি কমেন্টসে...

৩। বাণী বসুকে হ্যাটস অফ্‌করুণ রসকে একেবারে নিংড়ে নিয়ে এসেছেন। তার ‘অ্যাটমিক’ লেখাটা দুবার পড়েলামঅসাধারণ রিপ্রেসেন্টেশান। কিন্তু, তিনি হার মানলেন শেষে এসে। তিনি জানেন না, কিম্বা নারী বলেই হয়তো মানেন না, বাস্তব কারো তোয়াক্কা করে না। সে তার নিজস্ব নিষ্ঠুর পথেই চলাচল করেফলে করুণ রসটাকে ধাপে ধাপে যে উচ্চতায় নিয়ে গেলেন, নারীসুলভ মায়াজালে আটকে গিয়ে তার চুড়ান্ত নঙর্থক রূপ দেখাতে ব্যর্থ হলেন। ফিরিয়ে নিয়ে আসলেন আলোয়। আরেকটা প্রশ্ন, সিডেটিভ দেওয়া থাকলে কি এখনই কথা বলতে পারে? না কি ছাপার ভুল? ও হ্যাঁ, চমৎকার এই গল্পের অলঙ্করণ।

৪। অনিতা অগ্নিহোত্রীর ‘দ্রোহ’ রৌদ্ররস। পড়লাম। ভাল লাগল না মন্দ লাগল বুঝতে পারলাম না। পড়তে খানিকটা সময় লাগল এটুকু বলতে পারি।

৫। সুপ্রিয় চৌধুরীর বীররসের লেখা ‘ওই বইটা’। এক কথায় নকু-মাকুর ঠোকাঠুকি। ওনার লেখা আগে পড়িনি। আমি এটুকু বলতে পারি, এনার লেখার যদি এরকম কোয়ালিটি হয়, তাহলে হাতের কাছে যখনই পাব অবশ্যই পড়ার চেষ্টা করব। বীররস আগে-পিছে ভাবে না। সে তার চরমত্ব প্রতিষ্ঠা করেই ছাড়ে, না হলে ধ্বংস হয়। গল্পে সেটাই হয়েছে। আমার ভালো লেগেছে।

৬। বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভয়ানক রসের লেখা ‘এক প্রেমিকের জবানবন্দী’। একটা আরশোলা একজন মেয়ের প্রেমে পড়েছে। সে থাকে বাথরুমে, ইয়ে মানে রোজ মেয়েটাকে দেখে, আর দেখে কিভাবে পরকীয়া, ছলনা, ডমেস্টিক ভায়োলেন্স ইত্যাদিতে মেয়েটা তথা সমাজটা শেষ হয়ে যাচ্ছে! কাফকা দিয়ে শুরু, তারপর কি থেকে যেন কি হইয়া গেল! আমি এখন ভাবতে বসেছি, ভয়ানক জিনিসটা ঠিক কোন জায়গাটায় ছিল? মেয়েটার আরশোলার ভয়, না কি আরশোলার নারীদেহের প্রতি পিরীত। অবশ্য ‘মেটাফোর’ বলে একটা বস্তু আছে আমাকে চুপ করিয়ে দেওয়ার। এতএব চুপ করলুম।

৭। ব্যোমকে দিয়েছেন ইন্দ্রনীল সান্যাল। বীভৎস রসের যে মূলসূত্রটা তিনি এনেছেন তা সত্যিই ভয়ানক। অনেকগুলো লেয়ারে বীভৎস বাস্তবতাকে এনেছেন। অথচ গল্পের পচাত্তর শতাংশ পেরিয়ে যাওয়ার পরেও বিন্দুমাত্র বুঝতে পারি নি গল্প এইদিকে এগোতে চলেছে। বোঝা তো দূর অস্ত, এমনটা ধারনাই করা যায় না। আরও ভাল লাগল, এমন একটা চরিত্রের মধ্যে দিয়ে বীভৎসতা এনেছেন, যে চরিত্রের মধ্যে কোন জায়গাতে বীভৎসতা নেই। হয়তো অবচেতনেও থাকতে পারে না। যাকে শিকার ভাবছিলাম, সেই শিকারী হয়ে গেল! জাস্ট আনপ্রেডিক্টেবল। চমকে গেছি, শুধু তাই নয়, এটা আমার পড়া এ পর্যায়ের সেরা লেখা। এই গল্পের দুটো অলঙ্করণই অসাধারণ। পেইন্টিং যেন ইলাস্ট্রেশানের রূপ ধরে এসেছে।

৮। অভিষেক ভট্টাচার্যের ‘সেতু’ অদ্ভুত রস। অদ্ভুত লেখা। কিন্তু কনসেপ্ট অতটাও অদ্ভুত নয়। মানে যারা হারুকি মুরাকামি পড়তে অভ্যস্ত তারা জানেন এমন অদ্ভুত বিষয় নিয়ে এমন একটা সুন্দর লেখা যেতেই পারে। তবে একজন বঙ্গলেখকের কলম থেকে এরকম একটা অদ্ভুতুড়ে কনসেপ্ট এসেছে, আমার ভাবতে বেশ ভালই লাগছে।

৯। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের শান্তরসের লেখা ‘শান্তি ও অশান্তি’। যত দিন যাচ্ছে, ওনার উপন্যাসের ধার-ভার কমছিল, এখন মনে হচ্ছে ছোটগল্পেও ও রোগ ধরেছে। কিছু কিছু চমৎকার পাঞ্চলাইন ছাড়া গল্পে আর কিছুই নেই। কথোপকথনের স্টাইলের গল্প উপন্যাসগুলোর মতোই অসম্পূর্ণ। আপনি যদি বলেন ছোটগল্প আসলে ‘শেষ হয়েও হইল না শেষ’, আমি বলব, আরে না। এই গল্পটা সময় ছিল না বলে আদ্ধেক লিখে জমা দিয়ে দেওয়ার মতো অসম্পূর্ণ গল্প।

এইটুকু পড়ার পর যারা আমার মুন্ডপাত করতে চাইছেন বর্ষীয় ও জনপ্রিয় লেখক/লেখিকাদের লেখার প্রতি এমন বাক্য রচনা করার জন্য, তাদের বলি, লেখা পড়ার সময় আমি লেখক/লেখিকার নাম মনে রাখি না। আমার কাছে লেখাটাই মুখ্য। নাম গৌণ।

শেষ কথা। নবরস নিয়ে যা লেখা হল, আমার মতে, দুটো গল্প বাদে, তা খুব হিসেব করে পেলবভাবে পাঠকদের কথা বিবেচনা করে লেখা। যেন পাঠকেরা পঞ্চাশের দশকের জ্যাঠামশাই। তারা ‘Raw’ লেখা বরদাস্ত করেন না। ফলে তেমন লেখা? নৈব নৈব চ। অবশ্য তেমনটা লিখতে পারারও ক্ষমতা থাকা চাই। নবরসের আধুনিক মনস্তাত্বিক ভেদ করে একেবারে নতুন আনকোরা কোন লেখা আমি পাই নি। এমন কোন লেখা পাই নি, যা আমাকে ভাবায়। চমকে দিয়েছে, কিন্তু নতুন রকমের কিছু পড়ছি বলে ভাবাচ্ছে --- এমনটা নয়।

তাই প্রথমে ওই কথাটা লিখেছিলাম, স্পর্ধা গেছে, বিনয় এসেছে লেখক লেখিকারা বড়ো বিনয়ী হয়ে লিখেছেন গল্পগুলো। রান্না করার ফাঁকে ফাঁকে কিম্বা প্রচণ্ড গরমে হাসফাঁসে দিবানিদ্রার আগে এগুলো টুকটুক করে পড়ে নেওয়াই যায়...

================================

দেশ

‘নববর্ষে নবরসে’

মুদ্রিত মূল্যঃ ৩৫ টাকা

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে