এক অ্যাডভেঞ্চার, দুই লেখক এবং মাঝের ষাট বছর



১৮৪৯ সালের অক্টোবর মাসে বাল্টিমোরের ফুটপাথে অসহায় এবং রহস্যজনকভাবে মৃত্যুপ্রতীক্ষায় পড়ে থাকা লোকটার শেষ কথা ছিল, “Lord, help my soul.” অথচ এই লোকটিই একদা লিখেছিলেন ---

“Deep into that darkness peering, long I stood there wondering, fearing,

Doubting, dreaming dreams no mortal ever dared to dream before;

But the silence was unbroken, and the stillness gave no token,

And the only word there spoken was the whispered word, “Lenore?”

কে এই লেনোরে? মনে করা হয়, ইনি তার স্ত্রী, ভার্জিনিয়া, The Raven নামের এই কবিতাটি লেখার সময় যিনি অসুস্থ ছিলেন, কবিতাটি প্রকাশের দুবছর পর তার মৃত্যুও হয়।

অথচ কবিতাটা দেশে-বিদেশে প্রকাশিত হওয়ামাত্রই তিনি তুমুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। স্বয়ং বোদল্যের তার লেখায় এতটাই অভিভূত, যে তার লেখার অনুবাদ করতে শুরু করলেন ফরাসীতে, এবং বলা হয়, অনুবাদের মান নাকি আসলকেও ছাপিয়ে গিয়েছিল।

“প্রথমবার যখন খুলে পড়লাম তাঁর বই, আমি আনন্দ ও ভয়ের সঙ্গে লক্ষ্য করলাম সেখানে রয়েছে সেইসব জিনিস যার কথা আমি স্বপ্নে ভেবেছি, সেইসব বাক্য যেগুলোর কথা আমি ভেবেছিলাম। কিন্তু যা কুড়ি বছর আগেই তিনি লিখে ফেলেছিলেন।” বলেছিলেন বোদল্যের, বন্ধু তেওদর দরে-কে।

তার ‘To Helen’ কবিতাটা পড়লে বোঝা যায়, জীবনানন্দের বনলতা সেন কোথায় অজ্ঞাতবাস করেছিল। অথচ, তিনি তার কবিতার জন্যে অমর নন। তিনি পরিচিত ও জনপ্রিয় ছিলেন মার্কিন রোম্যান্টিক কবি, কথাশিল্পী ও সমালোচক হিসাবে, যিনি রহস্যরচনার জন্যে বিশেষভাবে পরিচিত, যিনি ভৌতিক ও গোয়েন্দা কাহিনীর এক প্রধান পুরোধা হিসাবে জনপ্রিয় তিনি বিজ্ঞানসাহিত্যের পথিকৃৎরূপে, এমনকি কস্‌মোলজি ও সংকেতবিদ্যাতেও পারদর্শী ছিলেন। প্রথম আধুনিক গোয়েন্দা কাহিনীর লেখক হিসাবেও তিনি সমাদৃত।

এডগার অ্যালান পো।

নিজের দেশে না হলেও ইউরোপে তিনি যে কি পরিমাণ সমাদৃত হয়েছিলেন তার অনেক উদাহরণ আছে। আমাকে বিশেষ করে টেনেছে তার Narrative of A. Gordon Pym নামক একমাত্র উপন্যাসটি। এই উপন্যাসটি এতটাই আকর্ষণীয়, যে উপন্যাসের পরের পর্ব লিখে ফেলেছিলেন স্বয়ং জুল ভের্ন, যাকে বলা হয় আধুনিক কল্পবিজ্ঞানের জনক। এই জুল ভের্ন তার বেশ কিছু লেখায় একের পর এক এমন সব কনসেপ্ট দিয়েছিলেন, যা পরবর্তীকালে আবিস্কারও হয়। হোভারক্র্যাফট কিম্বা সাবমেরিন তার বড়ো উদাহরণ। সেই জুল ভের্ন লেখেন ‘দ্য স্ফিংক্‌স অফ দ্য আইস-ফিলড্‌স’, ১৮৯৭ সালে, পিমের এডভেঞ্চারের প্রায় ৬০ বছর পরে!

এবং দুটোরই বাংলায় সার্থক অনুবাদ করেছিলেন অদ্রীশ বর্ধন। আমি তার অনুবাদকেই সঠিক ধরে এগিয়েছি। আসল ব্যাপারটা জানার পরে আমার খুবই কৌতুহল হয়েছিল, কি এমন আছে সেই একমাত্র উপন্যাসে, যা অন্য একজন লিজেন্ড লেখককেও পরের পর্ব লিখতে বাধ্য করে!

‘ভয়ের বিচিত্র চলচ্ছবি’ এক অসম্পূর্ণ অ্যাডভেঞ্চার উপন্যাস। এই উপন্যাসের শুরু হয়েছিল নানটাকেট থেকে, শেষ হয়েছিল ৮৩ অক্ষরেখার টসালাল দ্বীপের আশেপাশের এক অজ্ঞাত অঞ্চলে। পো তার উপন্যাস অসম্পূর্ণ রেখেছেন। একমাত্র উপন্যাস, তাও অসম্পূর্ণ!

“নক্ষত্রবেগে এগিয়ে চলেছি অনন্ত প্রপাতের দিকে --- বিশাল একটা গহ্বর মুখব্যাদান করে রয়েছে ঠিক সামনেই --- যেন গিলে নিতে চলেছে গোটা ক্যানোটাকে। আচমকা ঠিক সামনেই পথ জুড়ে উঠে দাঁড়াল একটা অবগুন্ঠন-আবৃত নরদেহ --- পৃথিবীর যে-কোনও মানুষের চেয়ে আকারে অনেক... অনেক বড়। অদ্ভুত মূর্তির চামড়ার রঙ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে --- তুষারের মতোই একেবারে সাদা।” ব্যাস, গল্প এখানেই শেষ।

কেন তিনি সম্পূর্ণ করতে পারলেন না? কেন রহস্যের সমাধান হল না? তার জীবনের মতোই এতবড় একটা অ্যাডভেঞ্চার টানটান উত্তেজনায় এমন একটা জায়গায় এসে থামল, মনে হল যেন, এর উত্তর লেখকের কাছেও নেই। পো-এর জীবন অসম্পূর্ণ, অস্বাভাবিক, সেই কারণেই কি উপন্যাটাকে আর এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ধৈর্য ছিল না? মনে রাখতে হবে, বাকি জীবনে তিনি আর কোন উপন্যাস লেখেননি। হতে পারে, অস্বাস্থ্যকর জীবনের কারণেই হঠাৎ এই উপন্যাসের শেষ। অথচ গোটা উপন্যাসটার ছোট ছোট ঘটনার লেখনভঙ্গি এতটাই শ্বাসরুদ্ধকর, যে এক-একসময় পড়াটাই একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে ওঠে।

ভাল করে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, ছোটগল্পের মাস্টার মাইন্ড এডগার পো-র এই উপন্যাসের মধ্যেকার ঘটনাপ্রবাহের যোগসূত্রগুলো বড়ো দুর্বল, অগোছালো। এরিয়েল পর্ব, গ্র্যামপাস পর্ব, জেন গাই পর্ব, টসালাল দ্বীপ পর্ব এবং সবশেষে অসম্পূর্ণ টেকেলে-লি পর্ব --- প্রত্যেকটা পর্ব যেন নিজস্বতায় ভরপুর। সেই জায়গায় অ্যাডভেঞ্চারের টানাপোড়েনে কোন খামতি নেই। অথচ, এগুলোকে জুড়ে যদি দেখা সম্পূর্ণটা দেখা যায়, তাহলে ওই জোড়-পর্বগুলোকে কেমন যেন মনে হয় দুর্বল, শুধু তাই নয়, যেন খানিকটা জোর করেই জোড়াতালি দেওয়া হয়েছে। মনে হয়েছে, প্রত্যেকটা পর্বের ঠিক পরে পরেই পো রাস্তা খুঁজছেন, লেখাটাকে কোনদিকে নিয়ে যাওয়া যায়।

এই crafting এর জায়গাতে এসেই জাস্ট গোলের পর গোল দিয়ে গেছেন জুল ভের্ন। তার ‘দ্য এন্টার্কটিক মিস্ট্রি’র প্রতিটা লাইনের লেখার পেছনে যে কতটা হিসেব নিকেশ করা আছে স্পষ্ট বোঝা যায়। এ খানিকটা তলস্তয় পড়ার মতন। তলস্তয়ের ‘ওয়ার এন্ড পীস’ ছ-বার খসড়া করা হয়েছিল। অতবড় একটা মহাউপন্যাসকে অতবার খসড়া করার ফলে তার প্রতিটা পর্ব যে কি পরিমাণে নিখুঁত হয়ে ওঠে তা দস্তয়েভস্কি’র ‘দ্য ব্রাদার্স কারামাজোভ’-কে পাশে রাখলেই বোঝা যায়।

এটাও ঠিক তেমনই। জুল ভের্ন তার উপন্যাসে ক্যাপ্টেন গাইয়ের ভাইকে সৃষ্টি করলেন, লেন গাই। যিনি কি না এই দ্বিতীয় অভিযানের প্রধান কারণমি. জিওরলিং চরিত্রকে তৈরী করা হল আর্থার গর্ডন পিম-এর কনট্রাস্টে, যিনি গোটা ঘটনাটা লিখলেন, শুধু তাই নয়, ওনার মুখ থেকেই বেরোলো একটা কথা, “আপনার মুখেই প্রথম শুনলাম কাহিনীটা নিছক রোমান্স নয়”, অর্থাৎ এডগার পো-এর উপন্যাস একটি রোম্যান্টিক ফিকশান। জুল ভের্নের উপন্যাসও তাই একইভাবে সায়েন্টিফিক রোমান্স ফিকশান হয়ে দাড়াল, যেখানে আগের উপন্যাসটা থেকে ফেরত এল স্বয়ং ব্ল্যাক পিটার্স। পরবর্তীকালে ফিরে এলেন ক্যাপ্টেন গাই, এবং দেখা পাওয়া গেল স্বয়ং আর্থার গর্ডন পিম-কে। যে পিমকে পূর্ববর্তী উপন্যাসে দুর্ঘটনায় মৃত্যু দিয়ে লেখক পো শেষ করেছিলেন, জুল ভার্নের অসাধারন কলমের জোরে, সেই পিম-এর প্রকৃত রহস্য উন্মোচিত হল দক্ষিণ মেরুতে এসে।

কিন্তু যে কারণে জুল ভার্নের কোন প্রশংসাই যথেষ্ট নয়, তা হল, টেকেলি-লি-র রহস্য উন্মোচন। যে রহস্যে পো উপন্যাস সমাপ্ত করছেন, খেই হারাচ্ছেন, সেই ‘খেই’কে কি অসামান্য দক্ষতার সাথে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গীতে রচনা করলেন! যা কি না, দক্ষিণ মেরুর স্বাপেক্ষে কোনভাবেই অসংলগ্ন বলে মনে হয় না। এখানেই জুল ভের্ন যে কতটা নিপুণ, কতটা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ভাবতে পারেন, তা প্রমাণিত হয়ে গেল। অন্য লেখকের ব্লকবাস্টার রচনাকে এতটা সুন্দর crafting করে, বিশ্বাসযোগ্য করে নির্মাণ করার ক্ষমতা ও দক্ষতা খুব কম মানুষই রাখতে পারেন। জুল ভের্ন পেরেছিলেন।

============================

কৃতজ্ঞতাঃ ১। ঘুমের দরজা ঠেলে - চিন্ময় গুহ, ২। এডগার এলান পো রচনা সংগ্রহ, ৩। জুল ভের্ন সমগ্র, ৪। ইন্টারনেট, ৫। দীপ ঘোষ

এবং সমর্পিতা...


Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে