নারী দিবস

 



আমার আবার জ্বর এসেছে, আর জ্বর এলেই ধুম জ্বর। গলা এমন বসে গেছে যে, নিজের গলা শুনে নিজেই চমকে উঠছি। সঙ্গে মাথাব্যাথা, গা-হাত-পা টাটাচ্ছেমাথাব্যাথা থাকলে একটা অদ্ভুত সেবা পাওয়া যায় ভাইয়ের কাছ থেকে। সেটা হল, ভাই সোফায় বসে। তার দুপায়ের ফাঁকে মেঝেতে একটা কুশানের ওপর আমি বসি দু-পা সামনে ছড়িয়েআমার দুই হাত ভাইয়ের দুই থাইয়ের ওপর দিয়ে ঝুলতে থাকে, এমতাবস্থায় ভাই আমায় চুলগুলোর মধ্যে তার দুই কাঠি-হাত আমূল প্রোথিত করে আস্তে আস্তে টানতে থাকে, অম্রুতাঞ্জন সহযোগে কপাল দিয়ে, চোখের ওপর দিয়ে আস্তে আস্তে টেনে টেনে হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। ঘরে একটা গান হালকা করে বাজতে থাকে, আমি স্বর্গসুখ অনুভব করি। অনেকদিন ভাইয়ের কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়েও পড়েছি এমনও হয়েছে যেমন, তেমন আবার, কখনও কখনও আমাদের মধ্যে এই সময় অনেক উচ্চস্তরের দার্শনিক আলোচনাও হয়েছে যেমন আজ হল---

      “এই নারী দিবসটা এখনও তোরা চালিয়ে যাচ্ছিস কেন রে? নারীশ্রমের কেসটা তো কবেই সাল্টে গেছে...”, ভাই হঠাৎই জিজ্ঞাসা করল।

      “তোরা নারীদের ওপর এখনও অত্যাচার করছিস বলে।”

      “তাই? করব না কি অত্যাচার?”, চুলের গোছায় জোরে টান মারে সে।

“উফফফফ... আস্তে... মা-কে ডাকব কিন্তু... তুই তো রোজ পেপার পড়িস, কতটা অত্যাচার হচ্ছে তুই জানিস না?”

“সে তো ছেলেদের ওপরেও অত্যাচার হয়, তার বেলা?”

“তা কর না আন্দোলন, কে মানা করেছে? মেল বয় ট্রাফিকিং, ডেমেস্টিক ভায়োলেন্স, 420 কেস, আর্টিকেল 375 --- এগুলোতে তো তোদের জন্যেও আইন পাশ হওয়া উচিৎ, কিন্তু তুই বল, রেপ করে বীভৎসভাবে খুন, জ্যান্ত জ্বালিয়ে দেওয়া --- এটা তো মধ্যযুগীয় বর্বরতা। আর ছাড়, অতদূরে গিয়েও লাভ নেই, আমাদের পেছনের কলোনীতে মদ খেয়ে মেয়ে-বউ কারা কারা পেটায় তুই জানিস না?”

“আইন কিন্তু আছে, আমাদের তো তাও নেই।”

“আমাদের সম্বল নেই। বউগুলো কোর্টে যাবে, টাকা দেবে কে? সেই সময়টা আশ্রয় দেবে কে?”

“তা বটে”, ভাই খানিকক্ষণ কি যেন ভাবল, চুল টানাটা খুব একটা ছন্দে হচ্ছে না। আমি কিছু বললাম না। চোখ বুজে কোলে মাথাটা এলিয়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “কি ভাবছিস?”

“আমরা বোধহয় জাত বর্বর, তাই না?”

“পুরুষেরা বলছিস?”

“হ্যাঁ?”

“না, সেটা সত্যি না। মানুষ জাতটাই জাত হিংস্র ছেলে-মেয়ে মিলেই। তুই ইতিহাসটা ঘেটে দ্যাখ, কি ছিল পঞ্চাশ হাজার বছর আগে, আর সেখান থেকে কি হয়েছে। যাযাবর, আর খাদ্য পিরামিডের একদম নীচে থাকা জন্তুগুলোর হিংস্র না হয়ে উপায় নেই --- সারভাইভাল স্ট্র্যাটেজি। আর তার ওপর আমরা তো মানুষের বাকি জাতগুলোকেও শেষ করে দিলাম। এমন হিংস্রত্ব আর কোন প্রাণীর আছে কি? যেখানেই গেছি, সেখানেই ছারখার করে দিয়েছি কয়েক দশকের মধ্যে। ইভোলিউশন হওয়ার টাইমটুকু পর্যন্ত দিই নি প্রকৃতিকে

আমি যখন এরকম জ্ঞান দিই ভাই চুপ করে থাকে। কিছুটা প্রচুর বই নিয়ে নাড়াঘাটা করি বলে, কিছুটা পাছে ওর হাতে বই তুলে দিই এই আশঙ্কায়, কিছুটা গল্প শুনতে এখনও ভালোবাসে বলে, আর বাকিটা আমি ওর দিদি বলে।

“আর তোরা ছেলেরা মাথামোটার জাত। ঘ্যাম আর লজ্জা --- এই দুটো কাটাতেই তোরা অনেক সময় নিয়ে ফেলিস। ফলে যা ঘাপলা হওয়ার এর মধ্যেই হয়ে যায়। তোদের গায়ের জোর বেশি, কিন্তু মাথা চলে কম। অ্যাবস্ট্রাক্ট লজিকে মাথা চলে, কিন্তু রিয়েলিটিতে? ন্যাঃ, কিস্যু হবে না। টিক্কির(*) জন্যে টাকা ম্যানেজ করতে হলে তোর আমার বুদ্ধি লাগে। কোনদিন শুনেছিস টিক্কিকে টাকা ম্যানেজ করার জন্য তার দাদার সাহায্য লাগছে? তোদের বাস্তববুদ্ধি কম বলেই এত নাস্তানাবুদ হোস, আর গায়ের জোর, ক্ষমতার জোর দেখাস। গায়ের জোর সবসময়েই ভয়ঙ্কর। তোরা নিজেও নষ্ট হোস, আমাদেরকেও নষ্ট করিস...”

“মোটেই না, আমরা আছি বলেই ইন্ডাস্ট্রি চলছে, সেখানে, মাথার ওপর কটা মেয়ে আছে, বা ইনভেন্টার হিসাবে কটা মেয়ে আছে, স্ট্যাট দ্যাখ, হাতে গোনা ---”

“উ উ উ উ উ উ উ উ উ উ... আমাদের প্রোডাক্টের ওপর ভালোবাসা আছে বলে ইন্ডাস্ট্রি চলছে। আমরা নিজেরা সাজতে ভালোবাসি, আর সবকিছুকে সাজাতেও ভালোবাসি। তোরা কিরকম ‘হুট বলে ফুট যাই’ করে চলিস। কোন ছিরিছাদ নেই। টিক্কির সাথে যাচ্ছিস ডেটিং-এ, দেখি জামায় হলুদের দাগ। টিক্কিকে দেখেছিস কখনও এরকম থাকতে? আর ইন্ডাস্ট্রি? তাহলে মডেলদের অমনভাবে সাজিয়ে সামনে আনতে হচ্ছে কেন? এত ট্র্যাপ দিতে হচ্ছে কেন? আল্টিমেটলি কেনে কারা, আমরাই তো। মানে বেশিরভাগ প্রোডাক্ট আর কি। বাবার জাঙ্গিয়া এখনও মা কিনে আনে। কেন? বাবা বাজারের সবজীটা পর্যন্ত পচা আনে, আর তোর কথা তো ছেড়েই দিলাম, বাড়ির কোন কাজটা সুন্দরভাবে করিস?”

“কি! আমি কাজ করি না?”

“করিস, তবে গায়ের জোরে করিস, পরিপাটি করে করিস কি? না বাবা করে?”

“অত টাইম নেই আমাদের...”

“একটা কাজ করবি ভালো করে করবি না? সুন্দর করে করবি না?”

“তার জন্যে তোরা আছিস...”

“অ্যাই... এই কারণেই এত নারীদের ওপর অত্যাচার, এই বারবার কাজ ঠেলে দিস তোরা। নিজেরা আদ্ধেক কাজ করিস, মেয়েরা না বললে আবার ঝাপিয়ে পড়িস। ফলে আমাদের ‘নারী দিবস’ এখনও প্রয়োজন। যতদিন না তোরা আমাদের মতো হতে পারছিস...”

“উ উ উ উ উ উ উ...”, বিজাতীয় গলায় আমরা দুজনেই চমকে উঠলাম। মা কখন পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে বুঝতেই পারি নি, “ভাইকে কি বললি? তুই সুন্দরভাবে গুছিয়ে কাজ করিস, কান টেনে ছিঁড়ে নেব তোর। বাড়ীর একটা কাজেও পাওয়া যায় না, এদিকে আবার ভাইকে জ্ঞান দেওয়া হচ্ছে। তোরা তিনজনে মিলে আমার ওপর সারাজীবন ধরে অত্যাচার করছিস সে বেলা? চল, যত্তোসব বাজে গালগপ্পো... স্নানের জন্য গরম জল হয়ে গেছে, এবার স্নান করে আমাকে উদ্ধার করো গে যাও...”

আমি যেতে যেতে ভাবলাম, “এইজন্যেই বলে, মেয়েরাই মেয়েদের শত্রু... হুঃ!”

 

নোট্‌সঃ নারী দিবসে, আমার মনে হয়, সম্পর্কগুলোকে ঠিকঠাক, সুস্থ, বন্ধুত্বপূর্ণ রাখাটাই মেয়েদের লক্ষ্য হওয়া উচিৎ, তাতে করে ‘সমতা’ আসার পথ প্রশস্ত হবে। আর অন্যায় সহ্য? কভি নেহি...

====================

(*) ‘টিক্কি’ ভাইয়ের মনমোহিনী। এর সম্বন্ধে বিস্তারিত পরে কোন একদিন জানাব।

বিঃ দ্রঃ – ওরে আমার সমর্পিতা রে! তোকে আমি হতচ্ছাড়ি এত্তো ভালোবাসি...

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে