উভচর মানব

 


কিছু কিছু বই প্রশ্ন রাখে। এক-এক বইয়ের প্রশ্ন এক-এক রকম। কোন কোন প্রশ্নের উত্তর হয়, কোন কোন প্রশ্নের উত্তর হয় না, সে উত্তরের জন্য অপেক্ষা করতে হয়, অনেক ক্ষেত্রে উত্তর অমিমাংসীত, অনেক ক্ষেত্রে উত্তর অনন্তকালের অপেক্ষার। এতএব, প্রশ্ন করার ক্ষমতা রাখে যে বই, সেই বই আমার চোখে মারাত্মক শক্তিশালী বই। চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন রাখার সাহস দরকার, ক্ষমতা দরকার।

আলেক্সান্দর বেলায়েভ প্রশ্ন করেছেন। প্রশ্ন একটা না, বেশ কয়েকটা। চিরন্তনী সেই সব প্রশ্ন---

১। বিজ্ঞান সত্যিই আশীর্বাদ, না অভিশাপ?

২। মানুষের প্রয়োজনে প্রকৃতি, না কি প্রকৃতির প্রয়োজনে মানুষ?

৩। প্রকৃতির স্বাভাবিকী ক্ষমতাকে প্রয়োজন এবং ইচ্ছামতো পরিবর্তন করার ক্ষমতা এবং ঔচিত্য কি আমাদের আছে?

৪। ধর্ম বিজ্ঞানের হাত না ধরে আর কতদিন বিরোধিতা করবে?

৫। মানুষ মানুষকে মানুষের প্রয়োজনে কতখানি পর্যন্ত কাজে লাগাতে পারে?

৬। মানুষের নিজস্ব স্বাধীনতা এবং সেই সাথে সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা --- কতটা কি হবে তা কে ঠিক করবে?

      এ প্রশ্নের অবশেষ উত্তর কি? সব প্রশ্নের উত্তর হয় না। কালের গর্ভে থাকে। কালই তার উত্তর দেয়। হতে পারে, মানুষে মানুষে সেই উত্তরের বিভেদ হতে পারে। পরিবর্তন এবং পরিবর্ধন, কিম্বা পরিমার্জন সাধিত হতে পারে। কিন্ত তা যদি মানূষের মঙ্গলের জন্য না হয়, তাহলে, সেক্ষেত্রে কি হবে? কে বলবে?

      “রাত কত হল? উত্তর মেলে না।”

      যেমন প্রথম প্রশ্নটার কথাই ধরুন না কেন। এই প্রশ্ন ক্লাস নাইনের ছাত্র-ছাত্রীরাও পরীক্ষায় রচনা আসলে লেখে। কিন্তু, আজও, প্রশ্নটা মলিন হয় নি। বরং যত দিন যাচ্ছে, প্রশ্নটা জোরালো হচ্ছে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রশ্নের উত্তর কচি খোকাটিও জানে, কিন্তু যারা ইউভাল নোয়া হারারির ‘সেপিয়েন্স’ পড়েছেন, আমি নিশ্চিত, তারা নতুন করে ভাবতে বাধ্য হবেন, কারণ একটা পর্যায়ের পর ‘চাকা উল্টোদিকে ঘুরছে না তো!’ এই আশঙ্কায় অনেকের মত প্রকৃতির হাতে ধ্বংসযজ্ঞ ছাড়া আর কিছুই করার নেই। আর কে না জানে, ধ্বংস অর্থেই প্রকৃতির হাত থেকে বেরিয়ে যাওয়া সিস্টেমকে ‘রিবুট’ করার চেষ্টা। এটা একরকমের প্রকৃতির পরাজয়ও বটে।

আবার, চতুর্থ প্রশ্নের রেলিভেন্সী আস্তে আস্তে হারাচ্ছে। ধর্ম বুঝে গেছে, বিজ্ঞানের হাত না ধরলে অস্তিত্ব টিকবে না। কটা ফ্ল্যাটে এখন আর সন্ধ্যেবেলা শঙ্খে ফুঁ দেওয়া হয়? আর তাই, ধর্মের মধ্যেও বিজ্ঞান খোঁজার মরিয়া চেষ্টা চলছে। আমরা আতঙ্কিত, আশঙ্কিত, পুলকিত এবং শিহরিত হচ্ছি। পঞ্চম প্রশ্নের কোন উত্তর নেই। দেশভেদে, কালভেদে কত আন্দোলন হয়েছে, ইতিহাস সাক্ষী। কিন্তু এখনও কি তার সম্পূর্ণ উত্তর মিলেছে? না। একজন আইটি ইন্ডাস্ট্রীর দশ ঘন্টা কঠোর পরিশ্রম করা শ্রমিকের কাছে এর উত্তর নেই। শেষ রাত্রে মদের বোতলের গড়াগড়ির প্রত্যুত্তর আছে। কিম্বা উইক এন্ডে আউটিং-এর নামে প্রকৃতিকে দুষিত করার নিষ্ঠুর আনন্দ আছে।

      আর শেষেরটা? কেউ ঠিক করবে না। ঠিক করবে মানুষ নিজে। কিন্তু মানুষ যতদিন অন্যের অধীনে থাকে, দেখা যায়, তার স্বাধীনতার একটা সীমানার মধ্যে সে নিজেকে স্বাধীন মনে করে আনন্দ পায়। কিন্তু অবশেষে, সে-ও কোথাও না কোথাও পরাধীন। অতএব এর উত্তরও ধর্মে কিম্বা বিজ্ঞানে নিহিত থাকলেও, শেষ উত্তর নেই।

আর এই সমস্ত উত্তরই বেলায়েভ নিজের মতো করে খুঁজতে চেয়েছেন। আর অবশেষে নিজের চরিত্রকে দেখেছেন জনবিবর্জিত দ্বীপে, প্রকৃতির কাছাকাছি, প্রকৃতির সাথে মিশে।

 

      ‘উভচর মানুষ’ উপন্যাসটা বহুল আলোচিত এবং সাই-ফাই জগতের এক ক্লাসিক উপন্যাস। ফলে গল্পের প্লট নিয়ে আলোচনা করার কোন মানেই হয় না। উপন্যাসের নামকরণই বলে দিচ্ছে, একজন মানুষকে নিয়ে লেখা, যে কি না জলে এবং স্থলে বিচরণ করতে পারে। সালভাতর নামক এক বিজ্ঞানীর হাতে তৈরী সে মানবকে সমুদ্রোপকূলবর্তী মানুষেরা চেনে, ‘দরিয়ার দানো’ নামে।

      এখানে প্রেম আছে, সমাজ আছে, লোভ আছে, উচ্চাকাঙ্ক্ষা আছে, কুসংস্কার আছে --- এবং সবই এই উভচর মানব ইকথিয়ান্ডরকে কেন্দ্র করে ঘটে চলে

      তবে বিজ্ঞান কোথায় আছে? বৈজ্ঞানিক বাদ-বিবাদ কোথায় আছে? যেখান থেকে চেনা যায় আসল বেলায়েভকে? আছে তৃতীয়াংশে ‘আসামীর জবানবন্দী’ শীর্ষক পর্বে। জলকে কীভাবে কাজে লাগানো যেতে পারে, অন্তত মানব সমাজের জন্য তার এক বিশাল বয়ান তিনি দাড় করিয়েছেন। যদিও, এই তত্ত্ব খাড়া করতে গিয়ে কোথাও ডারউইনের বিবর্তনবাদকে অত্যন্ত স্বপ্নিল চোখে দেখতে চেয়েছেন লেখক। সার্জারি কখনই বিবর্তনের বিকল্প হতে পারে না। কৃত্রিমতার প্রয়োগ যে কোন জীবনের পক্ষেই সাময়িক স্বস্তি, কিন্তু তা যদি অন্যান্য দেহগঠনের ক্ষেত্রে অনুকূল না হয়, তাহলে সেটাই হয়ে ওঠে বিষবৎ। যে কোন জীবের সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গই একে অপরের পরিপূরক, না হলে জীবনকে রক্ষা করার ক্ষমতা প্রাণীটির থাকে না। যে সাপের বিষ মানুষের পক্ষে বিষ সেই বিষই সাপের কাছে জীবনকবচ। আবার সেই বিষ যদি মানব অঙ্গের কোন কাটা অংশকে বা খোলা অংশে না ছোঁয়, তাহলে সেই বিষ মানুষের হাতে দিনের পর দিন থাকলেও ক্ষতির আশঙ্কার কারণ হয় না।

সব মিলিয়ে এ উপন্যাস বড়োই সুখপাঠ্য। এমন উপন্যাস হাতে নিয়ে বসলে কখন যে ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে যায়, টেরই পাওয়া যায় না।

=====================

উভচর মানব

আলেক্সান্দর বেলায়েভ

অনুবাদঃ ননী ভৌমিক

কল্পবিশ্ব পাবলিকেশান

মুদ্রিত মূল্যঃ ৩৫০ টাকা

[ছবি কৃতজ্ঞতাঃ সমর্পিতা]


Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে