অনিবার্য মৃত্যুর পাদটীকা


“মৃত্যু তো অপরিহার্য, কেউই তাকে এড়িয়ে যেতে পারবে না। কিন্তু শুধু কারুর অনুপস্থিতি নয়, মৃত্যু যেন তার চেয়ে অনেক বেশি শূণ্যতা সৃষ্টি করে। ... আসলে মৃত্যু এমন একটা ঘটনা যাতে কেউই অভ্যস্ত হয়ে যেতে পারে না।”

      খুব কম বই-ই আছে, যেটা শুরু করার সময়ে মনে হয়েছে, না করলেই ভালো হত। আসলেই সেক্ষেত্রে বইটার মানসম্মত প্রশ্ন, কিম্বা রুচিতে আঘাত করলে বেশি করে মনে হত। কিন্তু এবারে একেবারে অন্যরকম। এমন সত্য যা’র মুখোমুখি না হওয়াই ছিল ভাল, অন্তত মানসিক স্বাস্থ্যের পক্ষে।

       অলোক কাকুর কথা আমি আগে অনেকবার বলেছি। এই অলোক কাকু যে কয়েকজনের লেখা পড়তে অত্যন্ত পছন্দ করেন, গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ তার মধ্যে অন্যতম। গ্যাবোর প্রায় সবকটা বই-ই তার কাছে আছে। আমি অনেকবার বইগুলো পড়তে চেয়েছিলাম, ফিরিয়ে দিয়েছেন, বলেছেন, সময় হয় নি এখনও। মুশকিলটা হল, আমি অলোক কাকু’র প্যাম্পার্ড ছানা। 2014 সালের এপ্রিলের প্রায় শেষ অর্ধজুড়ে যার নাম পেপারে ছেয়ে গেল তিনি হলেন মার্কেজ। আমি একটু হতচকিত। গ্যাবো এমন একজন লেখক, যার সম্বন্ধে মোটামুটি ছোট-বড়-মাঝারি প্রায় সকল ভারতীয় চেনা-অচেনা লেখক কিছু না কিছু লিখছেন, শুধু তাই নয়, রীতিমতো দরবিগলিত। তার মৃত্যু যেন সাহিত্যজগতের গ্যালাক্সি পতন! অলোক কাকু’র মন খুব খারাপ ছিল। আমার আবেদন পুণরায় সপাট নাকচ হল। অনেক পরে যখন কলেজে উঠলাম, সোজা বইটা চুরি করলাম। One Hundred Years in Solitude - দুদিন পড়লাম, মনে হল, এসমস্ত বই কারা লেখে, কেনই বা লেখে? চুরির মাল চুরি করেই ফেরত দিলাম। ফেরার সময় গেটের সামনে যখন সাইকেলে চড়ছি, জানলা থেকে মুখ বাড়িয়ে অলোক কাকু বলেছিলেন, তোকে বললাম না, এখনও তোর বয়স হয় নি।

      কলেজে উঠে কিনলাম ‘নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ’। এবার আমায় আটকায় কে? পুরো বইটা পড়লাম। বিন্দু বিসর্গও বুঝলাম না। ইংরাজিটা পাশে রেখে পড়লাম, বুঝলাম না। বাংলাদেশের প্রতিথযশা অনুবাদ পড়লাম, বুঝলাম না। এত অপমান জীবনে খুব কমই হয়েছি। তবে এর একটা অদ্ভুত আকর্ষণ আছে, বলে বোঝানো কঠিন। বইটা টানছে। আমার এক বন্ধুর বাবা তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপক। বন্ধুকে বললাম, তোর বাবার সাথে আলাপ করিয়ে দিবি? কথা আছে। সে বলল, হান্ডি বিরিয়ানী খাওয়াবি, আলাপ করিয়ে দেব। মাঠের মাঝের কুটির-রেস্টুরেন্টে হান্ডি বিরিয়ানী খাইয়ে সেই অধ্যাপক কাকুর কাছে গেলাম। সাথে তিনটে বই। ঝাড়া তিনঘন্টা কথা হয়। অধ্যাপক মানুষ। বক্তৃতা দিয়ে গেলেন। বাড়ী এসে আবার পড়তে শুরু করলাম, এবং হঠাৎ করেই বুঝলাম, আমি বুঝতে পারছি উনি কি লিখতে চেয়েছেন।

      আমি মার্কেজের প্রেমে পড়লাম।

      এমন মানুষের মৃত্যু হয় না। যদিও বা হয়, তার মৃত্যুবর্ণনা পড়তে নেই। যারা রিসার্চ করে তাদের কথা আলাদা। রোদ্রিগো গার্সিয়া কাজটা ঠিক করলেন কি না জানি না, কিন্তু সারারাত প্রায় না ঘুমিয়ে চোখ লাল করে যখন আমি এখন এই লেখাটা লিখছি, মনে হচ্ছিল, কেন পড়লাম?

“এমন একজন জীবনসাধক, চিরজায়মান, জীবনরসের রসিক, যাঁর অস্তিত্বের কত রঙ, কত রূপ, তিনি আজ নির্বাপিত, এ যেন অবিশ্বাস্য।”

আর বলি হারি যাই অরুন্ধতী ভট্টাচার্যকে, এমন মরণপন অনুবাদ করার কি খুব দরকার ছিল? মোটামুটি একটা অনুবাদ করে নামিয়ে দিলে হত না? আপনারও তো অনুবাদটা করতে গিয়ে বুকটা ফেটেছে। সেটাও কি অনুবাদের লাইনগুলোর মাঝে ফল্গুধারার মতো বইয়ে দেওয়ার দরকার ছিল? চেপে গেলে লেখক-পাঠিক উভয়পক্ষে অন্তত স্বস্তি মিলত। চোখের জলে ওড়না ভেজানোর কোন দরকার পড়ত না।

 মেরসেদেস, গাবো’র স্ত্রী, যাকে গাবো প্রোপোস করেছিলেন মাত্র তার ১০ বছর বয়সে, বিবাহিত জীবন যাপন করেছেন ৫৭বছর ২৮দিন, তার চরিত্রও তেমনই অপূর্ব। “’বেচারা, সত্যি সত্যি চলে গেল?’ নিজের অন্তরে বেদনা উপলব্ধিরও আগে তিনি বাবার জন্য প্রগাঢ় করুণা অনুভব করলেন। আমার সারা জীবনে মাকে তিনবার মাত্র কাঁদতে দেখেছি। শেষবারের এই কান্নাটা স্থায়ী হয়েছিল মাত্র কয়েক সেকেন্ড, কিন্তু সেই ক্রন্দনের ক্ষমতা ছিল একটা মেশিনগানের সমান।” লিখছেন রোদ্রিগো। এই মহিয়সী মহিলা যখন মারা যান, নিঃশব্দে, তখন সারা বিশ্বে করোনার বীভৎসতা, ২০২০ সালে।

শেষ করছেন বড় সুন্দর করে রোদ্রিগো গার্সিয়া। লিখছেন---

“বাবা-মা দুজনেই চলে যাওয়া মানে রাতের অন্ধকারে টেলিস্কোপ দিয়ে সেই গ্রহটাকে আর খুঁজে না পাওয়া যা চিরদিন অবিচল ছিল। সে অদৃশ্য হয়ে গেছে, হারিয়ে গেছে তার ধর্ম, রীতিনীতি, নিজস্ব অভ্যাস ও আচার-বিচার, সে ছোট হোক আর বড়। শুধু রয়ে গেছে তাদের প্রতিধ্বনি।”

 

===========================

 

চিরবিদায়ঃ গাবো ও মেরসেদেস

রোদ্রিগো গার্সিয়া

অনুবাদিকাঃ অরুন্ধতী ভট্টাচার্য

দ্য কাফে টেবল

মুদ্রিত মূল্যঃ ১৭৫ টাকা

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ সমর্পিতা

 

  

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে