গ্রহান্তরের আগন্তুক

 


অনেক সময় এমন হয়, কিছু কিছু বই আপনাকে চ্যালেঞ্জ করে। যেন সে বলতে চায়, পড়ে দেখা দেখি, কেমন দম আছে। এই সমস্ত বইয়ের ক্ষেত্রে দুটো পথ। এক, বইটাকে না পড়া; এবং দুই, বইটাকে ঠেলে গুঁতিয়ে শেষ করে বলে ওঠা, হিপ্‌ হিপ্‌ হুররে...

তৃতীয় আরেকটা পথ আছে। বইটাকে পড়ার জন্য পড়াশোনা করা। ইংরাজীতে যাকে বলে প্রিপারেশান সেই সাথে পড়ার মাঝে মাঝেও পড়াশোনা করা। এবং আস্তে ধীরে, সময় নিয়ে, বইটাকে শেষ করাতৃতীয় ক্ষেত্রে আপনি পরিশ্রমী, কারণ, বিশেষ করে, যে পর্যায়ে আপনাকে পৌছতে হচ্ছে, সে পর্যায়ে পৌছনোর একটা মানসিকতা থাকা চাই। সেই মানসিকতা না থাকলে এ বই শেষ করতে আপনি অপারগ। আর অপারগ হলেই, আপনি জ্ঞানের কিয়দংশ খোয়ালেন, সেই জ্ঞানের সূত্র ধরে আরোও যে সমস্ত জ্ঞান অর্জন করতে চান, সেগুলোর পথও বন্ধ হয়ে গেল।

এসমস্ত কথা আমার নয়। আমি শুনেছিলাম আমার স্যারের কাছ থেকে। আজ ‘গ্রহান্তরের আগন্তুক’ গল্পগুচ্ছটা পড়তে গিয়ে আবার সে কথাগুলো মনে পড়ল। ননী ভৌমিকের বেশ কয়েকটি অনুবাদ আমার পড়া। তার অনুবাদ পড়তে আমার ভালোই লাগে। কিন্তু এই অনুবাদটা পড়তে পড়তে আমি বারবার অবাক হয়ে যাচ্ছিলাম। কীভাবে অনুবাদ করলেন তিনি? অনুবাদ করার আগে কিরকম প্রস্তুতি নিয়েছিলেন? দুর্ভাগ্য, জানার উপায় নেই

এই বইটিতে পাঁচটি গল্পের সমাহার---

১। আলেক্সান্দর কাজানৎসেভের ‘গ্রহান্তরের আগন্তুক’

২। আলেক্সান্দর বেলিয়ায়েভের ‘হৈটী হৈটি’

৩। আনাতলি দ্‌নেপ্রভের ‘ম্যাকসওয়েল সমীকরণ’ এবং ‘আইভা’

৪। ভ্‌লাদিমির সাভ্‌চেঙ্কোর ‘প্রফেসর বার্নের নিদ্রাভঙ্গ’

এর মধ্যে আনাতলি দ্‌নেপ্রভের গল্পদুটো যদি ভাল করে পড়া যায়, তাহলে বোঝা যাবে, কি পরিমাণ বিজ্ঞানে, বিশেষত ফিজিক্স, ইলেকট্রনিক্স এবং টেকনোলজিতে দখল থাকলে এমন দুটো ছোটগল্প লেখা সম্ভব! এই গল্পদুটোর মধ্যে একটা vision আছে, যা সাই-ফাই সাহিত্যের ক্ষেত্রে তাকে এক অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেম্যাক্সওয়েলের তড়িৎ-চুম্বক তরঙ্গতত্ত্ব সারা বিশ্বের পদার্থবিদ্যার মূল চার তত্ত্বের একটি, সেই তত্ত্বের জটিলতাকে সন্মান দিয়ে তার প্রভাবকে উপায় বানানোর এমন একটা গল্প হওয়া সম্ভব ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। একই কথা ‘আইভা’ সম্পর্কেও। রোবোটের প্রতাপ নিয়ে কত উপন্যাস তো পড়েছি, রোবটকে ক্ষমতা দিলে কি হতে পারে তা নিয়ে তো কত গল্প পড়েছি, কিন্তু সেই রোবটকে তৈরী করা এবং আস্তে আস্তে তার বিকাশকে বিজ্ঞান ও আঙ্কিক আঙ্গিকে প্রতিষ্ঠা করা এবং অবশেষে তার বিকাশের ধারাকে প্রতিষ্ঠা করা ও আশঙ্কাকে দর্শানো, তাও একটা ছোটগল্পে, চাট্টিখানি কথা নয়। সেটাই করেছেন দ্‌নেপ্রভ।

মূলত দ্‌নেপ্রভের গল্পদুটিই আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে। কিন্তু তা বলে এমন নয় যে, বাকি গল্পগুলো ভাল নয়বেলিয়ায়েভ, যিনি ‘উভচর মানব’ লিখে বিখ্যাত, তার লেখায় রয়েছে মানুষের সাথে মনুষ্যেতর জীবের একটা সম্পর্ক গড়ার চেষ্টা। একটা হাতিকে কেন্দ্র করে এই রচনার প্রক্রিয়াটা অভিনব।

শেষ গল্পটা সাভচেঙ্কোর। এখানে বিবর্তনবাদ নিয়েই মূলত চর্চা হয়েছে, এবং এই চর্চায় প্রায় আঠেরো হাজার বছর পর মানব প্রজাতির ভবিষ্যৎ কি হতে পারে তার একটা দৃষ্টিভঙ্গী দেওয়া হয়েছে গল্পটার টুইস্ট আমাকে সবচেয়ে বেশি চমকে দিয়েছে

তুলনামূলক প্রথম গল্পটা একটু ম্যাড়ম্যাড়ে লেগেছে। মঙ্গলগ্রহে জীবনের অস্তিত্বের প্রতিষ্ঠা নিয়ে একটা বন্ধ ঘরের কথোপকথন নিয়ে লেখাটা কোথাও একটু হলেও পীড়া দেয়। পুরো গল্পটা খোলার আগেই কেমন যেন বন্ধ হয়ে যায়, এমনকি, আলোচনার মধ্যেকার লজিকগুলোতেও গভীরতার অভাব পাওয়া যায়। অথচ এই গল্পটাকেই সবার শুরুতে রাখা হয়েছে। যদিও পাঠক মনকে আকর্ষণ করার ক্ষমতা অনেক বেশি রাখে ‘হৈটী টৈটী’।

বইয়ে লেখা আছে, প্রগতি থেকে প্রথম বইটির বঙ্গানুবাদ প্রকাশ পায় ১৯৬৪ সালে। আর ১৯৬০ থেকে ১৯৬২-র মধ্যে বিভিন্ন সময়ে গল্পগুলো প্রকাশ পায়। সেই সময়ে মঙ্গল গ্রহ, কম্পিউটারের আগ্রাসন, বিবর্তনের পথনির্দশ ইত্যাদি নিয়ে বিজ্ঞানীমহল মাথা ঘামালেও তা ছিল অনেকটাই প্রাথমিক পর্যায়ে। ফলে গল্পগুলো পড়ার সময়ে সময়কালটাকে মনে রাখলে পড়াটা সহজ হয়ে যায়। এবং এটাও দেখে আশ্চর্য হতে হয়, সেই সময়ে এই অগ্রগতির গতিপ্রকৃতি নিয়ে লেখকেরা কতটা সতর্ক ছিলেন, কতটা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন, এবং সেখান থেকে সমস্যাগুলোকে আমাদের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করছেন।

প্রচ্ছদ বড়ো সুন্দর। মনকাড়া। যদিও, ছবির পার্থিব এবং গল্পের অপার্থিব রকেটের মধ্যেকার কোন পার্থক্যই চোখে পড়ল না। কিন্তু তাতে কি? প্রকাশনা বিভাগের লক্ষ্যই যদি হয় মনকাড়া সুদৃশ্য ছবিযুক্ত প্রচ্ছদ, তাহলে গল্পের সাথে মিল হল কি হল না, তাতে কি আর এসে গেল? প্রচ্ছদ সুদৃশ্য হয়েছে, এতটাই বলার আছে।

===============================

গ্রহান্তরের আগন্তুক

লেখকঃ আ কাজানৎসেভ, আ বেলিয়ায়েভ, আ দ্‌নেপ্রভ, ভ সাভ্‌চেঙ্কো

অনুবাদকঃ ননী ভৌমিক

কল্পবিশ্ব পাবলিকেশান

মুদ্রিত মূল্যঃ ২৭৫ টাকা

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে