আমার গডব্রাদার, আমার জান-এ-মন্‌

 


যারা আমার লেখা নিয়মিত পড়েন, তারা জানেন, আমার একটা গডফাদার আছেন; তারা জানেন, আমার একটা বর আছেন; তারা জানেন, আমার একটা ভ্যাবাগঙ্গারাম হতভাগা আছে; তারা জানেন, আমার তিনটি বন্ধু আছে; তারা জানেন, আমার একটা বাবা, একটা মা আর একটা ভাই আছে; তারা জানেন, আমার জেমস্‌ বন্ড আছেন; এবং এদের প্রত্যেককেই তারা চেনেন আমার লেখার মধ্যে দিয়ে।

কিন্তু তারা জানেন না, আমার একটা গডব্রাদার আছে।

এই গডব্রাদারটিকে আমি আমার শাড়ীর আঁচলের খুঁটে পরম যত্নে বেঁধে রেখে দিয়েছি, আমি তার বড়ো আদরের, আমি তার কোহিনূর। সে আমার ইন্দ্রমণির হার। আমার গলার মালা করে তাকে রেখে দিয়েছি পরম যত্নে।

আমাকে যারা জানেন, তারা যদি ধারণা করেন, আমার মা আমার ভাইকে, কিম্বা সমর্পিতাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে, তাহলে ভুল করছেন। আমার এই গডব্রাদারটি হল তার নয়নের মণি।

এই গডব্রাদারটির সবচেয়ে যে পুরোনো ছবি আমাদের বাড়ীতে আছে তা হল আমার বাবা-মা’র বিয়ের দিনের ছবি। সে ছবিতে সে সরাসরি আমার মায়ের কোলে চড়ে বসে গলা জড়িয়ে ধরে ছবিটা তুলেছিল। পাশে আমার বাবা। মায়ের সাথে তার পিরীতির সেই শুরু। ‘ইচ্ছা হয়ে ছিলি মনের মাঝারে’ বোধহয় মায়ের অনুভূতিতে সেইদিন থেকেই ঢুকে পড়েছিল। ভাই আসার পর তার সে ইচ্ছাপূরণ হয়, যদিও স্নেহ এই গডব্রাদারের দিকেই বেশি বলে ভাই আর আমি তাকে পরম হিংসা করি।

আমি যখন মায়ের পেটে, শুনেছিলাম, সে নাকি আমার মায়ের পেটে কান চেপে ধরে থাকত, আমি যদি তার সাথে কথা বলি এই আশায়। অবশেষে আমি এলাম। ছোটবেলায় আমি ছিলাম তার ন্যাওটা। তার ছায়াসঙ্গিনী। সে বড়ো হল। দূরে চলে গেল। ইন্ট্রোভার্ট হল। বিয়ে করে নি এখনও। কাজের পাশাপাশি পড়াশুনা করে যাচ্ছে, এবং মেঘনাদের মতো, নিজেকে আড়ালে রেখে যাবতীয় তথ্য, তত্ত্ব আর বই, গান, ছবি, সিনেমা আমাকে সাপ্লাই করে চলেছে। সে আমার প্রতিটা লেখা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ে। আলোচনা হয়। আমি ঋদ্ধ হই। যে কোন বই কিম্বা সিনেমার ক্ষেত্রে সমর্পিতা ব্যর্থ হলে গডব্রাদার আমার শেষ আশ্রয়স্থল। সে ব্যর্থ হলে, আমি জানি, আর কারো কাছে পাওয়ার আশা নেই বললেই চলে।

      আজ, ঘরে ঢুকেই ডাইনিং রুমে গডব্রাদারের গলার আওয়াজ পেয়েই ছুট্টে গেলাম। দেখি কি, আমার মায়ের পেয়ারের গডব্রাদার, চেয়ারে বসে আছেন, আর আমার মা তার পাতের মাছের কাঁটা বেছে দিচ্ছে! আমি হিংসায় জ্বলেপুড়ে গেলাম। মা-কে বললাম, “উঁ উঁ উঁ উঁ উঁ... আমার তাড়া থাকলে তোমাকে খাইয়ে দিতে বললে তো সে বেলা...”

      কথা শেষ হল না, মা ঘ্যাঁক করে উঠল, “বাজে বোকো না, ধাড়ি ধুমসী হয়েছ, নিজে হাতে নিজে খাবে। আমি কেন খাইয়ে দেব?”

      “আর ও...?”

      “ও কাঁটা বেছে খেতে পারে না, জানিস না...! ওকে খাইয়ে দিচ্ছি কই, ও নিজেই খাচ্ছে...”। আমি আর কিছু বললাম না। এই বয়সে এত পিরীত জাস্ট চোখে সয় না।

      গডব্রাদার এতক্ষণ রগড় দেখছিল। এবার বলল, “তোর ঘরে একটা জিনিস রাখা আছে, তুই দ্যাখ গে যা, আমরা একটু গল্প করে নিয়ে আসছি।” বলেই মায়ের সাথে আবার টুকুটুকু গল্প করতে লাগলেন তিনি, আর মা-ও কাঁটা বেছে মাছ একপাশে দিতে লাগল, তিনিও ভাত দিয়ে অম্লানবদনে খেতে লাগলেন। গডব্রাদার মাছ একদম পছন্দ করেন না। তার বাড়ীতে তার মায়ের সঙ্গে এই নিয়ে ধুন্ধুমার হয়। ব্যতিক্রম, আমার মা। সেখানে সে বিন্দুমাত্র আপত্তি তো দূর, একটা কুঁইকুঁইও করে না।

      আমি রেগেমেগে ধুমধুম করে ঘরে ঢুকতেই বিছানার দিকে চোখ পড়ল। এবং ‘ভ্যাঁক’ করে কেঁদেই ফেললাম। বইগুলোকে কি যত্নেই না সে সাজিয়ে রেখেছে আমার জন্যে! বেশ কয়েকদিন আগে তার সাথে আমার কথা হচ্ছিল জুলে ভের্ণ, এডগার এলান পো নিয়ে। আর রবীন্দ্রনাথের ‘সাধনা’ বইটার কথা আমি জানতামই না। আমি রবীন্দ্রনাথকে ইংরাজীতে পড়তে ভালোবাসি না জানে, ফলে কলেজ স্ট্রীট ঢুঁড়ে কিনে নিয়ে এসেছে সে। আজ বিছানায় পরম মমতায় সেগুলো সাজিয়ে রাখা আছে। আমারই জন্য। আমার হাত বইগুলোকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে গেল।

আমি কাকে হিংসা করব?

গডব্রাদার, আমি জানি, তুই আমার এ লেখা পড়ছিস। আমার বেশি আবেগ সয় না, তোরও সয় না। তোর পছন্দ না তোকে নিয়ে আমি কিছু লিখি। তোর মানা আছে। তুই আড়ালে থাকতে চাস। কিন্তু আজ না লিখে পারলাম না। তুই জানিস না, তুই আমার কি। শিল্পকে পরিচর্যা করার আনন্দ তুই-ই দিয়েছিস। আমার একটুকরো নীলাকাশ তুই। রবীন্দ্রনাথকে তুই-ই দিয়েছিলিস আমার অন্ধকারের কালে। রাসেল-দস্তয়েভস্কি-কাম্যু তুই-ই আমাকে চিনিয়েছিস। চিনিয়েছিস তারাশঙ্কর-শরৎচন্দ্র-সমরেশ বসুকে। ভালবাসতে বাধ্য করিয়েছিস বই-গান-আর আশেপাশের মানুষজনকে। আমার মা তোকে তো আর এমনি এমনি ভালোবাসে না। আমিও বাসি --- এত্তো ভালোবাসি...

তুই আমার হারানিধি, আমার জিগরের টুকরো, কলিজার আধা, দিলের খুন, চোখের রোশনাই, তুই আমার জানেমন্‌... তুই ভালো থাক, তুই আনন্দে থাক...

===============================

১। জুলে ভের্ন সমগ্র (৪ খন্ড) – লালমটি প্রকাশন – ২৬০০ টাকা

২। এডগার এলান পো রচনা সংগ্রহ (বক্স সেট) – ১৬০০ টাকা

৩। সাধনা – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর – সিগনেট প্রেস – ৪৫০ টাকা

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে