আএলিতা, অপার্থিব প্রেম, ও তার অভিঘাত

 



"চারিদিকে মরচে ধরা লোহালক্কড় আর সিমেন্টের ফাঁকা পিপে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত। তারের তালগোল পাকানো কুন্ডলী, ভাঙা কলকব্জা, তার মধ্যে আবর্জনার স্তুপের ওপর ঘাসের রুগ্ন শীষ গজিয়েছে।"

     লাইনদুটোর মধ্যে কাব্যের ছোঁয়া পেতেই আমি নড়েচড়ে বসলাম। যারা 'গারিনের মারনরশ্মি' পড়েছেন, তারা জানেন আলেক্সেই নিকোলিওভিচ তলস্তয়ের মধ্যে যতটা মার্ক্সিজম আছে, কাব্যিক ব্যাপার স্যাপার তার ছিঁটেফোঁটাও নেই। যদিও একটা উপন্যাস দিয়ে একজন লেখককে যাচাই করা উচিৎ নয়, তবুও, একটা ধারণা তো করা যায়। কিন্তু এক্ষেত্রে হঠাৎ করে এমন একটা কাব্যিক বাক্যের জন্যে সত্যিই আমি প্রস্তুত ছিলাম না।

     'বিনিদ্র রাত্রি' নামক পর্বে এসে আবার চমকালাম। কি লাইন বেরিয়ে এসেছে ওনার হাত ধরে! তলস্তয় লিখছেন,

     "প্রেমের বিষ কেন খেয়েছিলাম? অসাড় থাকলে আরো ভালো হত। প্রাণের হিমজমাট বীজ, ইথারে ভাসমান সব স্ফটিক বিন্দু, তারা কি গভীর নিদ্রায় মগ্ন নয়? কিন্তু আমাকে ধরণীতলে পড়তে হল, অঙ্কুরিত হতে হল -- জানা যে চাই প্রেমের সেই ভয়ঙ্কর তৃষ্ণার অর্থ কি, অন্যতে বিলীন হওয়ার, নিজেকে হারানোর, নিঃসঙ্গ বীজ হয়ে না থাকার মানেটা কি। আর সবকিছু কীসের জন্য? ভঙ্গুর এই স্বপ্নের পর আবার মৃত্যুর সঙ্গে মুখোমুখি হওয়া, আবার বিচ্ছেদ, আবার সেই শূন্যে ভাসা হিম কঠিন স্ফটিক।"

     আমি পড়া থামিয়ে একবার চোখ রগড়ে নিলাম। ভাবছি এটা কি সত্যিই সাই-ফাই উপন্যাস? নিজের মনকে বোঝালাম, কেন? কল্পবিজ্ঞানে কি বিরহ বেদনা থাকতে পারে না? মন বলল, পারেই তো। এমন তো কত্তো গল্প আছে। মন একটু শান্ত হল। আমি আবার পড়তে শুরু করলাম। মূল চরিত্র দুইজন --- মস্তিলাভ সের্গেয়েভিচ ওরফে লস এবং আলেক্সেই ইভানভিচ গুসেভ। লসের পত্নীবিয়োগ হয়েছে, এবং এই বিয়োগান্তক বিরহ বেদনাতুর হৃদয়ের হাহাকার এক পর্যায়ে কাব্যিক সুষমায় লেখা হয়েছে, যার কিয়দংশ লিখলাম। গুসেভের পত্নী আছে, মাসা, দুজন দুজনকে বেজায় ভালোবাসে, কিন্তু, গুসেভের ঘরের চালে মাথা ঠেকে না। ফলে গুসেভ লসের সাথে যেতে চায়।

     কোথায়?

     ইঞ্জিনিয়ার লস একটি রকেট আবিষ্কার করেছেন, যার সাহায্যে নয়-দশ ঘন্টার মধ্যে মঙ্গল গ্রহে পৌছানো যাবে। সময়ের যে হিসাব লেখক দেখিয়েছেন, সেই ব্যাপারে আমি বিস্তারিত যেতে চাই না। মোট কথা, এই রকেটের সাহায্যে দুজনে মিলে পাড়ি দেয় মঙ্গলগ্রহে। কেন মঙ্গলগ্রহ? কারণ সেখান থেকে এক শক্তিশালী তরঙ্গ রেডিওতে ধরা পড়ছে, যে ভাষা অজানা। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে, ওখানকার অধিবাসীরা খুব উন্নত প্রজাতির।

      তো গল্পটা যেহেতু কল্পবিজ্ঞান গোত্রের, দেখা যায়, মঙ্গলগ্রহে জল আছে, ফণিমনসার ঝোপ আছে, দৈত্যাকার মাকড়সা টাইপ জীব আছে, মঙ্গলগ্রহের অধিবাসীরা আছে, যারা মানুষ মানুষ টাইপ কিন্তু মানুষ নয়, তাদের সমাজ আছে, আর আছে আএলিতা।

     উপন্যাসে লস আএলিতার প্রেমে পড়ল, গুসেভ ইখশকার প্রেমে পড়ল। দেখা গেল, তারা হল আকাশ সন্তান, যারা মঙ্গলের অধিবাসীদের ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করবে, যে গ্রহটা আস্তে আস্তে অনিবার্য বিনাশের দিকে চলে যাচ্ছে।

     তলস্তয় গল্পটাকে সাজিয়েছেন খুব সুন্দরভাবে। 'আএলিতার প্রথম গল্প' নামক পর্ব থেকে অসাধারণভাবে মঙ্গলের ইতিহাস মোটামুটিভাবে দুই পর্বে বিস্তৃত হয়েছে। পড়তে পড়তে বোঝা যায়, বাইবেল কিম্বা মিথোলজিকাল গল্পগুলোর ধারা মঙ্গলের অধিবাসীদের ইতিহাসেও বিদ্যমান। মানে লেখক এর বাইরে কিছু ভাবতে পারেন নি।

     এখন কথায় আছে না, 'ঢেকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে', তলস্তয়ও তাই। মঙ্গলে গেলেও শ্রমিক অভ্যুত্থানের বেশি ভাবতে পারেন না। ফলে, মঙ্গলগ্রহে গুসেভের নেতৃত্বে শ্রমিক অভ্যুত্থান হয়। বাকিটা সেই 'থোড় বড়ি খাড়া' আর 'খাড়া বড়ি থোর'। এক্ষেত্রে অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়, তারা দুজনে কোনরকমে প্রাণ নিয়ে আবার রকেটে চেপে ফিরে আসে পৃথিবীতে।

     এক পর্যায়ের রাশিয়ান লেখকদের নিয়ে আমার একটা ভয় কাজ করে, যা অমূলক নয়, এবং আমি কোনবারই ভুল হই নি। তা হল, কোন না কোনভাবে শ্রমিক অভ্যুত্থান এরা আনবেই আনবে, নচেৎ, অন্তত শ্রমিকদের নিয়ে, তাদের দুর্দশা নিয়ে, কিম্বা সেই সময়কার পার্টি পলিটিক্স নিয়ে লেখা হবেই হবে। নিদেনপক্ষে একটা প্যারা হলেও, কিম্বা একটা চরিত্র হলেও।

     রাজনৈতিক মতাদর্শের মনে হয় এই একটাই সমস্যা। কোন না কোনভাবে শিল্পে তার প্রভাব রেখেই যেতে চায়। খুব কম শিল্পীই আছেন, যিনি কোন একটা রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী, কিন্তু তার শিল্পসত্ত্বায় সে প্রভাব নেই। এখানেও তাই। তলস্তয় একটা প্রেমের সাই-ফাই গল্প লিখলেন বটে, কিন্তু সেখানেও মার্ক্সিজমকে হঠাতে পারলেন না। বরং অত্যন্ত দৃষ্টিকটুভাবে এল। গল্পের আঙ্গিকে এটা একটা হাস্যকরই বটে। একটা অপার্থিব সভ্যতাতেও শ্রমিক অভ্যুত্থান হয়, তাও আবার 'আকাশ সন্তান' আসার কয়েকদিনের মধ্যে, তাদেরই হাত ধরে। আচ্ছা, আমাদের এখানে মঙ্গলের দুজন অধিবাসী এসে একমাসের মধ্যে শ্রমিক অভ্যুত্থান ঘটাতে পারবে? সম্ভব? জনসমাজে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের কি কোন মা-বাপ নেই?

    যাই হোক, এসবের বাইরে থেকে যদি দেখা যায়, তাহলে বলা যায়, এ গল্প আএলিতার আনন্দ-বেদনার গল্প, যে এক পৃথিবীবাসীর প্রেমে পড়ে মৃত্যুকেও গ্রহণ করতে চেয়েছে। মরণ আসেনি, এসেছে বিরহ। পৃথিবীবাসীটিও তার প্রেমে পড়েছে। দুজন দুজনকে নিবিড়ভাবে চেয়েছে। গ্রহন করেছে। আএলিতা সমাজের বিরুদ্ধে গিয়েছে। তার পিতার বিরুদ্ধে গিয়েছে। সে লসের বুকের মাঝে নিজের প্রণয়বার্তার বীজ প্রোথিত করেছে। অবশেষে তাদের বিচ্ছেদ হয়েছে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে।

     জীবন্মৃত আএলিতা খুঁজে বেড়ায় তার দয়িতকে। যে এক পৃথিবী সন্তান। দুজনে এখন দুই গ্রহের অধিবাসী। তার জন্যেই বার্তা পাঠায় আএলিতা। যে বার্তায় আছে তাদের ভাষায় বলা এক বেদনার্ত আবেদন, যে আবেদনে আছে এক অপার্থিব বিষন্ন সুর, যে আবেদন প্রতিদিন একটা নির্দিষ্ট সময়ে বেতার তরঙ্গ বেয়ে আছড়ে পড়ে পৃথিবীতে, বলে,

     "কোথায় তুমি, কোথায় তুমি, কোথায় তুমি, আকাশ সন্তান?

    আএলিতার কন্ঠস্বর, প্রেম আর মহাকালের কন্ঠস্বর, ব্যাকুল বিরহের সে কন্ঠস্বর মহাশূন্য পার হয়ে এসেছে তার কাছে, ডাকছে তাকে, অনুনয় করছে, মিনতি করে বলছে, কোথায় তুমি, তুমি কোথায়, প্রিয়তম..."


======================

আএলিতা

আলেক্সেই তলস্তয়

অনুবাদকঃ সমর সেন

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ সমর্পিতা

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে