কৃত্তিবাস ফেব্রুয়ারী সংখ্যা ২০২৩


 

প্রথমেই বলা যাক, আমি ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকাকে রীতিমতো সমীহ করিমাঝে অনেকবার স্থির করেছিলাম যে, অনেক হয়েছে, আর নেবো না, কিন্তু, এক অমোঘ আকর্ষণে বারবার পত্রিকাটা কিনি। কিছু না কিছু থাকেই এই পত্রিকাতে। অন্য একটা বড়ো কারণ --- কৃত্তিবাসের বিশেষ মেগা সংখ্যা।

এবারের ফেব্রুয়ারীতে একটাই সংখ্যা বের হল --- সাহিত্য সংখ্যাঃ বিষয় বাংলা ছোটগল্প। অনেকদিন পর এবারের সংখ্যা মেগা সংখ্যা। এবং এই মেগা সংখ্যার জন্যে একগুচ্ছ প্রাবন্ধিক লিখেছেন একগুচ্ছ প্রবন্ধ। এই একগুচ্ছ মানে সাত-আটটা নয়, একেবারে ৩৪টা! এবং তাকেও সাজানো হয়েছে সুনিপুণ দক্ষতায়---

১। প্রথম আটটা প্রবন্ধ রবীন্দ্র যুগ হয়ে পাঁচ-ছয়-সাত-আট-নয়ের দশক হয়ে থেমেছে নতুন শতকে। কৃত্তিবাসের মতে, রবীন্দ্রনাথ হলেন প্রকৃত বাংলা ছোটগল্পের জনক এবং সার্থক রূপকারমূলত তার সময় থেকেই শুরু হচ্ছে ছোটগল্পের স্বর্ণযুগ।

২। বাংলাদেশের লেখকদের লেখা ছোটগল্প নিয়ে একটা প্রবন্ধ।

৩। এক-এক করে কয়েকজন রবীন্দ্রপরবর্তী মাস্টার ছোটগল্পকারদের নিয়ে একগুচ্ছ প্রবন্ধ, যেমনঃ জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী, কমলকুমার মজুমদার, সমরেশ বসু, মতি নন্দী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় প্রভৃতি।

৪। এর মাঝে মাঝে একটু অন্যরকম বা প্রান্তিক বা আড়ালে থাকা ছোটগল্পকারদের নিয়ে লেখা কিছু প্রবন্ধ --- সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, অসীম রায়, দেবেশ রায়, রমানাথ রায়, সুবিমল মিশ্র প্রভৃতি

৫। সবশেষে নির্বাচিত পাঁচশোটি ছোটগল্পের বইয়ের তালিকা এবং ২০২২ সালে প্রকাশিত বাংলা বইয়ের একটা মোটামুটি তালিকা।

এর পাশাপাশি শুরুতেই রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আলাদা করে আছে দুটো প্রবন্ধ। আর শেষে ‘কৃত্তিবাসী বৈঠক’-এ আছে তিনটে বইয়ের আলোচনা – আমার জীবন রঙের তাস, ফেনাশীর্ষ সাগরের ডুবুরী এবং রজস্বলা। মজার ব্যাপার তিনটে বই-ই প্রতিভাস থেকে বেরিয়েছে। বেশি কিছু আর বলব না। না-না-না-না-না... ন্যাঃ। বলি? আচ্ছা বলি... ‘রজস্বলা’ বইয়ের আলোচনা করেছেন রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়। লেখিকার দুটি সুন্দর ছবি আছে পাতার আধখানা জুড়ে, দেখেই ‘টাস্কি’ খেতে হয়। অমৃতা ভট্টাচার্য কি কবি-অভিনেত্রী বা কবি-মডেল? হতে পারে। না হলেও, অতি অবশ্যই জনপ্রিয় লেখিকার তকমা পাওয়াটা সময়ের অপেক্ষামাত্রতার এই কবিতার বইয়ের শেষ কবিতার লাইন উদাহরণ দিচ্ছেন রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়, যা তার ভালো লেগেছে---

“ঊরুসন্ধি এবার ঢালো ঘৃত

রঞ্জনবাবুর মতে, “রজস্বলা’-র শেষ কবিতার এই পঙ্‌ক্তি হয়ে ওঠে ঘিয়ে ভেজা, বহ্নি-আগ্রহী অপেক্ষা...”

 

একটা ব্যাপার স্বীকার করে নেওয়াই ভাল, আমার মনে হল, এই সংখ্যাটা পড়তে পড়তে, ‘ছোটগল্প’কে বাংলা ভাষা সাহিত্যের কোহিনূর বললে অত্যুক্তি করা হবে না। অনেক ছোটগল্পকার অনেক সাহসীকতা দেখিয়েছেন সমাজের বেড়াজালে থেকেও, অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। হয়তো, যথার্থ অনুবাদ হলে বিশ্বসাহিত্যের মাইলস্টোন হয়ে থাকা সব গল্পকারদের মধ্যে বাংলার অনেক ছোটগল্পকারদের নাম অবশ্যই থাকতো। কিন্তু এ বিষয়ে বাঙালী অসাধারণ ক্ষমতার অধিকারী। তারা পাত পেড়ে ফকোটে খিচুড়ি খেয়ে রান্নার ভুলভ্রান্তি ধরতে ধরতে মুখ মুছে বাড়ী চলে যাবে, কিন্তু, এই খিচুড়ি-ভোগ যাতে বহির্বাংলায় প্রচার ও প্রসার পায় তার বন্দোবস্ত করার প্রয়োজন বোধ করবে না। পাঠক এবং প্রকাশকদের কূপমন্ডুকতার একটা বড়ো উদাহরণ হয়ে রইল এই সংখ্যাটা।

এই মেগাসংখ্যার মুগ্ধতার ব্যাপারে বলার পাশাপাশি আরও দু-একটা কথা বলে নেওয়া যাক। কৃত্তিবাস দাবী করে, তারা আধুনিক প্রাপ্তমনস্কদের পত্রিকা। তবে, আমার মনে হয়, তারা অ্যামেচার প্রাপ্তমনস্ক। কারণ, কোনদিন নিষিদ্ধ বা বিতর্কিত বিষয় নিয়ে তুমুল সাহসীকতা দেখাতে পারে নি, মনে হয় পারবেও না। মানে, আমি প্রায় দেড় বছর ধরে কিনছি, এমন একটাও সংখ্যার উদাহরণ তো পেলাম না, যে সংখ্যা পাঠক মহলে হইচই ফেলে দিয়েছে।

আবার, তারা আংশিক রঙিন হয়েছে দেখতে পারছি এই রঙিন ব্যাপারটা কেমন? তারা প্রথম আর শেষ পাঁচটি পাতা রঙীন রেখায় ভরিয়ে তুলেছে, যেখানে জনৈক কবির এক পাতা জুড়ে রঙিন প্রচার কিম্বা প্রসার ঘটাচ্ছেন প্রায় গত এক বছর ধরে, কিম্বা শেষ পাতায় সত্যের কাছে নতজানু হয়ে বসা বইয়ের দুর্ধর্ষ ইন্ট্রো দিচ্ছেন কিন্তু সম্পাদক মহাশয় ভুলে যাচ্ছেন, এদুয়ার্দ মানের পেইন্টিং-এর সাদা-কালো প্রদর্শন ততটাই মুঢ়তার কাজ, যতটা বোকামি এই রঙিন বিজ্ঞাপন দিয়ে পাঠক টানার পেছনে অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার প্রয়োজনের প্রকটতাটাযে ছবি ক্লাসিক, তার জাত মেরে কৃত্তিবাস প্রাপ্তমনস্ক হয়েছে, এটা বিশ্বাস করতে মন চায় না। হয়তো সাহিত্য ম্যাগাজিন হিসাবে একটা অন্যরকম ধারার কাজ করছে, তাহলে সেক্ষেত্রে এই ছবিগুলো দেওয়া বন্ধ করাই ভাল। কিম্বা সাদা-কালো ফটোগ্রাফি প্রিন্ট করাই বুদ্ধিমানের কাজ, যেটা জর্জ রজারের ছবিটার ক্ষেত্রে তারা করেছেন।

এতদ্‌সত্ত্বেও পরের কৃত্তিবাসের জন্য আমি অপেক্ষা করে থাকব। কারণ পরের কৃত্তিবাসের বিষয় – ১১টি ছোটগল্প এবং সুবোধ সরকারের কবিতাগুচ্ছসেই সংখ্যাটির দাম রাখা হয়েছে ৭০ টাকা। এদের এই দামের বিষয়টাও বেশ মজার। এক-এক মাসে এক-এক দাম। কখনও পঞ্চাশ তো কখনও...

======================================

কৃত্তিবাস – সাহিত্য সংখ্যা

বিষয়ঃ বাংলা ছোটগল্প

মুদ্রিত মুল্যঃ ১৫০ টাকা

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ সমর্পিতা

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে