আমার ভ্যাবাগঙ্গারাম, আমার হতভাগা
“অ্যাই,
ফুচকা খাবি?”, তার প্রশ্নটা ছিল খুব নিরীহ।
যে ছেলেটি
আমায় এই প্রশ্নটা করে ভ্যাবাগঙ্গারামের মতন তাকিয়ে ছিল, তখন কি জানতাম, সে আমায়
প্রপোজ করছে? জানলে কি বলতাম? জানি না... যান! তবে তারিখটা খুব মনে আছে --- ১৪ই
ফেব্রুয়ারী।
ফুচকা
মেয়েদের বড়ো দুর্বল করে দেয়। একরাশ ঘনচুলের তলাকার কাঁধটার মতোন, হালকা উষ্ণ বাতাস
পেলেই শিরশির করতে থাকে সারা শরীরটা, তেমনই, জিভটা, না খেয়েও, স্রেফ মনে মনে,
তেঁতুল জল আর কাঁচালঙ্কার স্বাদ পায়। আমি অমোঘ দুর্বলতায় বলে ফেলেছিলাম, “হ্যাঁ---”
তাকে আমি
ততদিনে চিনে গেছি। অকম্মার ঢেকি। মানে ‘কোন কম্মের নয়’ বলতে যা বোঝায়, একদম তাই। তার
যত আনন্দ খেলাতে, লেখাপড়ায় অষ্টরম্ভা, স্কুল পালিয়ে সিনেমা দেখতে গিয়ে স্যারের
কাছে এবং বাড়ীতে মার খেয়েছে একাধিকবার। আমাদের মধ্যে একমাত্র তারই কম্পিউটার
সম্পত্তি ছিল, ফলে সে আর তার বন্ধুরা হুল্লোড় করত প্রায়ই। আমরা
অনেকদিন সিনেমা দেখেছি, একসাথে, তবে, বিশেষ বিশেষ সিনেমার ক্ষেত্রে মহিলা বর্জনীয়।
আমরা সবাই মিলে তার বাড়ীতে কম্পিউটার দেখতে গিয়ে একরাশ বিস্ময় নিয়ে বাড়ী ফিরে
এসেছি। জেনেছি, সেই কম্পিউটার থেকে যা খুশি করা যায়। এই ভ্যাবাগঙ্গারাম আমাকে বেশ
কয়েকটা হুমায়ূন আহমেদ বা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ডিজিটাল ভার্সান ডাউনলোড করে, আর তার
বাবার বাইকে করে পিকনিকে নিয়ে গিয়ে, বা ঠাকুর দেখাতে নিয়ে গিয়ে মুগ্ধ করে দিয়েছে।
সে মুগ্ধতাবোধ আজও আমার কাটেনি।
ভ্যাবাগঙ্গারামের
চোখদুটো মারাত্মক রকমের স্পষ্ট। কিন্তু সেদিন মনে হয়েছিল, এ ব্যাটা এমন
ফ্যালফ্যালে চোখে তাকাচ্ছে কেন? ঘটি-বাটি হারানোর মতন চোখ। গেল না কি কম্পিউটার খারাপ
হয়ে? না কি পিতৃদেব দিয়েছেন আচ্ছাসে ঠ্যাঙানি? আশেপাশে আমাদের বন্ধুদের দেখছি না
কেন? সমর্পিতা আর পল্লবী এসেছিল, তারা কই গেল? ফুচকার দোকানের সামনে এসে দুজনে
দাঁড়ালাম।
ভ্যাবাগঙ্গারামের
হাত কাঁপছিল। ফুচকা খেতে গিয়ে পুরো তেঁতুলের জল তার টি-শার্টের বাঘের মুখে পড়ে
গেল। বাঘের মুখে কি তেঁতুল জল মানায়? আমি রুমাল দিয়ে ওর বুক মুছতে মুছতে বললাম, কি
রে, তোর কি কিছু হয়েছে? কাঁপছিস কেন?
সে উত্তরে
বলল, “ধুস্ শ্লা, কি ঝকমারি রে বাবা!” ওর বুকে হাত রাখতেই ওর পাতাটাই হাত থেকে
পড়ে গেল।
ফুচকা খেতে
যে এতো ঝকমারি তা জানা ছিল না। আমি তো দিব্বি সাঁটিয়ে যাচ্ছি। বললাম,
আর পাতা নিতে হবে না, আমার থেকে নে। একটাতেই হয়ে যাবে। ও দাদা, এখানেই দুজনের
ফুচকা দিতে থাকুন।
আমার
উদ্দেশ্য ছিল, ও ব্যাটা যে লেভেলে কাঁপছে, তাতে আর বেশি ফুচকা খেতে পারবে বলে মনে
হয় না। ওর ভাগের ফুচকাটাও মেরে দেব। এমন সুবর্ণ সুযোগ কি ছাড়া যায়? অনেকদিন হয়েছে
এমন যে, আমার মুখ থেকে বেগুনীর আদ্ধেকটা বার করে নিজে খেয়ে নিয়েছে। তখন তো এমন
কাঁপুনির সীনই ছিল না। আজ কাঁপছে কেন? কি হল রে বাবা! এ ছেলের কি জ্বর আসছে?
যাই হোক,
দুজনে মিলে একই পাতা থেকে ফুচকা খাচ্ছি। সে আমার রুমালটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
আমি একটা করে খাচ্ছি, তার মুখে একটা করে দিচ্ছি। এসবে কি ভ্যাবাগঙ্গারাম আরও ঘাবড়ে
যাচ্ছে? না কি সত্যিই ওকে নিয়ে বাড়ি চলে যাব? এই সময়টা জ্বর হয় খুব বেশি। ঠান্ডা-গরম
বলে কথা।
“ধ্যেত তেরি
ক্যা, ইত্তে ফালতু ঝেম্লা…”
ন্যাঃ! এ
দেখি কি সব বকছে। বিজাতীয় ভাষা। আমি মুখে ফুচকা ঠুসে দিলাম। বড়ো ফুচকা গোগ্রাসে
গিলতে গিয়ে আমার আঙ্গুলগুলোই দিলো কামড়ে। আবার ফুচকার জল বাঘের মুখে-ঘাড়ে-বুকে।
“তোর কি
হয়েছে বল তো? বাড়ী যাবি?” আমি আবার রুমালটা দিয়ে ওর বুক মুছতে মুছতে বললাম।
“তুই শ্লা
বড্ডো কম বুঝিস, এই বুদ্ধি নিয়ে সায়েন্স পড়িস???”
এই মরেছে!
ভ্যাবাগঙ্গারাম খেপেছে। ‘শ্লা’–তে এসে পড়েছে, ব-তে আসার আগে বাড়ি পৌছে দেব? আমি তো
বেশি ফুচকা খাইনি এখনও! এইকটাতেই এত রাগের কি আছে? ও তো জানে আমি একবারে কটা ফুচকা
খেতে পারি। তাহলে কি মানিব্যাগ ভুলে এসেছে? ফুচকাওয়ালার দিকে তাকালাম। দন্ত বিকশিত
করে হাসল সে। পাশের তিনজোড়া কাপ্ল মিটিমিটি হাসছে আমাদের দিকে তাকিয়ে।
“আর খাব না
রে। বাড়ী চল।”
ভ্যাবা আমার
হাতে মানিব্যাগটা দিয়ে বলল, তুই টাকাটা দে, আমি আসছি।
কলতলায়
ছুটল? না কি? ঝোপের ওদিকে যাচ্ছে কেন? ছোট বাইরে, না কি বড়ো বাইরে? আরে!
মানিব্যাগে একটা আংটি কেন? লেডিস রিং, কি সুন্দর! হাতে নিয়ে ভালো করে নেড়েচেড়ে
দেখলাম।
ভ্যাবাগঙ্গারাম
দেরী করছে কেন? বড় বাইরে না কি! ও, অইজন্যেই এত খেপে যাচ্ছিল। প্রকৃতির ডাক, তার
ওপর পাশে লেডিজ। মান-সন্মানের আর কিছু বাকি রইল কি ছেলের? কিচ্ছু না। কিন্তু একটা
জলের বোতল নিয়ে গেলে ভালো করত না।
এ বাবা!
আমার রুমালটা নিয়ে গেছে যে! সব্বোনাশ! টিস্যু পেপার তো আমার ব্যাগেই থাকে। একবারও
যদি বলত আমি টিস্যু পেপারটা দিয়ে দিতাম। এখন আমার রুমালের যদি কিছু হয় ওকে এখানেই
পুঁতে দেব। অবশ্য ওরই বা কি দোষ। এ অবস্থায় মাথার ঠিক থাকে না কি?
খানিকক্ষন
পরে ভ্যাবাগঙ্গারাম ফিরল বটে, কিন্তু বিধ্বস্ত অবস্থায়। ওরে বাবা! ই কি রে! পুরো
বিস্রস্তবসন টাইপের, রাধার কুঞ্জ থেকে ফেরার সময় এমন হত পড়েছিলাম, আর কাঁদো কাঁদো মুখ।
আমার সামনে এসে বিড়বিড় করে বলল, “খুঁজে পেলাম না, কোথায় যে রাখলাম!”
“কি?”
“আংটিটা---”
“ওটা খুঁজতে
ঝোপে গিয়েছিলি কেন? ওটা তো মানিব্যাগে রেখেছিলি, এই যে---”, আমি দেখালাম, “এটা
কার? বোনের জন্য, না মায়ের জন্য?”
“যাঃ শ্লা...!
ভুলেই মেরে দিয়েছিলাম। সেই থেকে পকেট হাতড়ে যাচ্ছি, কিন্তু পাচ্ছি আর না। ওটা...
ওটা... ওটা... ইয়ে তোর জন্যে”, খিলখিল করে কেউ হেসে উঠল। আমি তৎক্ষণাৎ হাতে পড়ে
নিয়ে বললাম, হাতের মাপ কোথা থেকে পেলি?
“তোর আর
অরিত্রীর হাতের মাপ এক, আমি দেখেছি, তোরা মাঝে মাঝে গয়না বদল করিস। আঙটিও পড়তে
দেখেছি... কিন্তু... কিন্তু... তুই পড়লি কেন? আমি তো...”, সে আর কিছু বলার পথ পেল
না। তাও খানিক হাতড়ে হাতড়ে বললে, “আমার আরও কিছু বলার ছিল।”
নাঃ! এ
ব্যাটাকে এবার পরিত্রাণ করা দরকার, সাতদিন ধরে প্রস্ততি নিয়েছে, আমি জানি।
বন্ধুদের সাথে অনেক অনেক আলাপ আলোচনা করেছে। তাও জানি। সিনেম্যাটিক অনেক কিছু ভেবে
আজ টেনশনে সব গুবলেট করে ফেলেছে। এখন বেচারার পরিত্রাণ দরকার। আমি ছাড়া আর করবেটাই
বা কে?
“চল বাড়ি চল
এবার, তুই কেমন যেন কাঁপছিস”
“তোকে একটা
কথা বলার ছিল”, এবার কেমন একটা মরিয়া হয়েই বলল।
“আংটিটা তো
পরেই নিয়েছি। এরপরেও আর কিছু বলার আছে? আমি তো যা শোনার শুনেই নিয়েছি। চ চ, বাড়ি
চ, তুই একটা হতভাগা---”
“অ্যাঁ...?”
“অ্যাঁ নয়,
হ্যাঁ”
আজও মাঝে
মাঝে আংটিটা হাতে নিয়ে দেখি। ইমিটেশনের আংটির জৌলুস হারিয়েছে, কিন্তু ভেতরের জৌলুস
একটুও কমেনি। তবে বন্ধু যখন পরাণসখা হয়, তখন অনেক কিছু পালটে যায়। এখন আর সবার
সামনে আমার গাল চেপে ধরে আমার মুখ অর্ধেক খুলে নিয়ে বেগুনী বের করে অবলীলায় খেতে
পারে না। লজ্জা পায়। অনেক ইচ্ছা যেমন হারিয়ে গেছে, অনেক ইচ্ছা তেমন জন্মও নিয়েছে।
আগে ছিল
ভ্যাবাগঙ্গারাম, এখন হয়েছে আমার হতভাগা।
Comments
Post a Comment