এই জি ওয়েলস কল্পগল্প সমগ্র


 


‘সায়েন্টিফিক রোমান্স’ আসলেই জিনিসটা কি, আমি শিখেছিলাম জুলে ভের্নের কাছ থেকে। তার ‘এরাউন্ড দ্য ইয়ার্ল্ড ইন এইটটি ডেজ’ কিম্বা ‘মিস্টিরিয়াস আইল্যান্ড’ --- সবকিছুতেই এমন অদ্ভুত এক মানবিকতার ছাপ ছিল, যার অনুভব আমি এখনও চোখ বন্ধ করলেই অনুভব করতে পারি।

      অনেকদিন পর, এইচ জি ওয়েলসের মধ্যে আবার সেই অনুভূতিটা পেলাম। এমনকি, ওনার লেখা ছোটগল্পগুলো পড়তে পড়তে এও বুঝতে পারছিলাম, ওয়েলস, কীভাবে বাংলা সাহিত্য জগতে, বিশেষত কল্পবিজ্ঞান জগতে প্রভাব ফেলেছেন গভীরভাবে, অবচেতনে। কয়েকটা উদাহরণ দেওয়া যাক ---

১। ওয়েলসের লেখা ‘অদ্ভুত অর্কিড’ বা ‘The Flowering of the Strange Orchid’ পড়তে পড়তে স্পষ্ট বোঝা যায়, সত্যজিৎ রায় তার ‘সেপ্টোপাসের খিদে’ লেখার অনুপ্রেরণা কোথা থেকে পেয়েছিলেন। এমনকি স্পেটোপাস আর অর্কিডের বর্ণনার অনেক জায়গায় মিল আছে।

      মজা লাগবে ‘ইপাইওরনিস আইল্যান্ড রহস্য’ বা ‘Epyernis Island’ পড়লে এবং সেইসাথে তার অলঙ্করণ দেখলে। ‘বৃহচ্চঞ্চু’ নামক ছোটগল্পটার সাথে এর অনেকটাই মিল আছে, শুধু তাই নয়, বেঞ্জামিন এডুইন মিন্‌সের চিত্রিত ইপাইওরনিস ভ্যাসটাস আর সত্যজিৎ চিত্রিত বৃহচ্চঞ্চু-র মধ্যে প্রায় কোন পার্থক্যই নেই! হুবহু মিল।

      সত্যজিৎ রায় আজকের সময়ে এই গল্পদুটি লিখলে আমাদের বইপ্রেমিকরা কি তাকে ধুয়ে দিতেন? কপি করা হয়েছে বলে বা কপিরাইট ভায়োলেশান হয়েছে বলে?

২। ‘প্রস্তর-যুগের একটি গল্প’ বা ‘A Story of the Stone Age’ গল্পটার কথাই ধরুন না কেন। নক্ষত্রলোকের দেবতাত্মা লিখেছিলেন নারায়ণ সান্যাল। কৈফিয়তে ওয়েলসের ‘দ্য ওয়ার অফ দ্য ওয়ার্ল্ড’-এর কথা বললেন বটে, কিন্তু খুব সুন্দরভাবে এড়িয়ে গেলেন, প্রথম পর্বের অমন সুন্দর গল্পটার উৎস কি, মানে তিনি কোথা থেকে পেয়েছিলেন লেখাটাকে নিজের মতো করে নির্মাণ করার। মজার ব্যাপার, কৈফিয়ত ছিল দু-দুটো। এবং দুটো কৈফিয়তেই নীরব রইলেন এই ব্যাপারে যে, ওয়েলসের উক্ত গল্পটা তার মনে কতটা প্রভাব ফেলেছিল এই পর্বের গল্পটা লিখতে।

৩। উল্টোদিকে প্রেমেন্দ্র মিত্র ‘পিপীলিকা-সাম্রাজ্য’ (the Empire of the Ants) গল্পটাকে নিলেন একেবারে অন্যভাবে। যেন, যে জায়গাটায় ওয়েলস শেষ করলেন, ঠিক সেই জায়গা থেকে শুরু করলেন তিনি। বস্তুত, তিনি, চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন, গল্পটা কতটা অসম্পূর্ণ। জানি না Amazing Stories পত্রিকাটা ওয়েলসের ওপর কোন শর্তারোপ করেছিলেন কি না শব্দসংখ্যা নিয়ে। মোটকথা, যেমন সুন্দরভাবে শুরু হল, তেমনভাবে শেষ হল না। উপন্যাস বা নভেলার প্যাটার্নে শুরু করে একটা ছোটগল্পে এসে থামলেন।

      প্রেমেন্দ্র মিত্র কিন্তু তা করলেন না। ওনার ‘পিঁপড়ে পুরাণ’ পড়লে স্পষ্ট বোঝা যায়, উনি কোন গল্পের অনুকরনে নিজের এই গল্পটাকে সাজিয়েছেন। উনি গল্পটাকে নভেলাতে রূপ দিলেন, শুধু তাই নয়, মানুষের সাথে একটা সংযোগ সাধন করলেন পিঁপড়েদের মধ্যে। সার্থক সায়েন্টিফিক রোমান্স।

 

      তো, এই হল এইচ জি ওয়েলস। যিনি নিজেও লেখেন, অন্যদেরকেও লিখতে অনুপ্রাণিত করেন, শুধু তাই নয়, তার লেখার ছাপ থেকে সরে থাকার কোন উপায় থাকে না, কারণ, এই লেখক পাঠক, এমনকি লেখকের অবচেতন মনেও গভীর ছাপ ফেলে যান, ঠাহর করে ওঠা যায় না। একজন লেখক কতটা সার্থকভাবে মনের মধ্যে স্থান করে নিলে এমনটা সম্ভব ভাবলে অবাক হতে হয়।

      বাঙালীর মজা হল, এমন একজন লেখককে স্টাডি না করে স্রেফ এবং স্রেফ গিলে ফেলার অসম্ভব ক্ষমতা রাখা। কোন প্রকাশক, বা কোন লেখক নিজের মতোন করে উদ্যোগ নিলেন না পুরো ওয়েলসের সার্থক অনুবাদ করার। বিক্ষিপ্ত কিছু লেখা, বিশেষত যেগুলো লিখলে বাজার কাটবে, বিক্রী হবে বেশি সেগুলোর দিকেই নজর দেওয়া হল। ফলে পুরো ওয়েলস পড়তে হলে মূল ইংরাজী ছাড়া গতি নেই। অদ্রীশ বর্ধনের নিজস্ব উদ্যোগে যেকয়টা অনুবাদ হল, সেগুলোই আবার পুনরায় মুদ্রিত করা ছাড়া আরোও এগোনোর কোন উদ্যোগ এখনও নেই। বাংলা কল্পবিজ্ঞানের যা দশা তাতে করে ওয়েলসই আবার ফিরতে পারলে ভালো। না হলে তরুণ প্রজন্মের হাতে বিজ্ঞানের নবতম কল্পকাহিনী লেখার উদাহরণ এখনও হাতে গোনা।

অনেক বলবেন, হচ্ছে তো লেখা। ছাই হচ্ছে। যেভাবে একটা বিজ্ঞানকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা ওয়েলসের মধ্যে দেখা গেছে, তা কোথায়? ‘লোহার কচ্ছপ’ গল্পটার কথাই ধরা যাক, ১৯০৩ সালে লেখা ট্যাঙ্কের কল্পনা ১৯১৬ সালের বিশ্বযুদ্ধের সার্থক পরিণতি ডেকে আনে। এমন দুরদৃষ্টি যদি লেখায় না পাওয়া যায়, তাহলে সায়েন্স ফিকশানে মজা কোথায়? সায়েন্স ফ্যান্টাসী অনেক লেখা হচ্ছে, হবেও, তবে তার সার্থক রূপ তখনই পাবে যখন একটা সাবমেরিন, হোভারক্র্যাফটের মতন কনসেপ্ট আসবে, যা জুল ভার্ণ করে দেখিয়েছেন, যা ভবিষ্যতের সার্থক প্রতিষ্ঠা হয়ে দাঁড়াবে। গত একশো বছরে বাঙলা কল্পবিজ্ঞান তেমন কোন অবদান রাখতে ব্যর্থ। সেদিক থেকে দেখলে অদ্রীশ বর্ধন, সত্যজিৎ রায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র কিম্বা রেবন্ত গোস্বামী --- সকলে কিশোর মনে আপেক্ষিক মনোরঞ্জন করতে পেরেছেন এবং অবশেষে সার্থক কল্পবিজ্ঞান লেখার ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছেন।

========================

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ সমর্পিতা

এই জি ওয়েলস কল্পগল্প সমগ্র

অনুবাদকঃ অদ্রীশ বর্ধন

কল্পবিশ্ব পাবলিকেশান

মুদ্রিত মূল্যঃ ৬৫০ টাকা

Comments

  1. 'The Flowering of the Strange Orchid' থেকে আসে হেমেন্দ্রকুমার রায়ের ছোট গল্প 'পিশাচ' । 'সেপ্টোপাসের খিদে'-র ওপর হেমেন্দ্রকুমার মূল গল্পে যে পরিবর্ধনগুলো করেছিলেন, তাঁর প্রভাব স্পষ্ট, যদিও সত্যজিৎ-ভক্তরা তা স্বীকার করবেন কিনা সন্দেহ। পাশাপাশি দুটি গল্পের চরিত্র ও ঘটনাসমূহ রাখলামঃ দুটি গল্পের কেন্দ্রেই আছে দক্ষিণ আমেরিকা থেকে কলকাতার উপকণ্ঠে আনা – ‘পিশাচ’-এ টালিগঞ্জ-রিজেন্ট পার্ক অঞ্চলে, আর ‘সেপ্টোপাসের খিদে’-তে বারাসাতে – আমিষভুক অর্কিড।
    ‘পিশাচ’ ‘সেপ্টোপাসের খিদে’
    উদ্ভিদবিজ্ঞানী রামময়বাবু উদ্ভিদবিজ্ঞানী কান্তিবাবু
    বিমল গল্পের কথক পরিমল
    কুমার পরিমলের সহপাঠী অভিজিৎ
    ‘পিশাচ’-এ বিমল-কুমারের দুই ছায়াসঙ্গী রামহরি, এবং বিশেষ করে বাঘা, অনুপস্থিত। ‘সেপ্টোপাসের খিদে’তে অভিজিতের কুকুরপ্রীতি এবং বারাসাতে যাবার সময় সঙ্গে সঙ্গে করে তার ‘বেজায় তেজিয়ান’ রামপুর হাউন্ড বাদশাকে নিয়ে আসা কাকে মনে করায়? ‘পিশাচ’-এ রামময়বাবুর বাগানে কীটপতঙ্গ, মানুষ, এবং, বিমল-কুমার সেই বাড়ীতে আস্তানা গাড়ার পর, একটি বেড়ালের অপমৃত্যু ঘটেছে। বেড়ালের জায়গায় সেপ্টোপাসের মারণ আক্রমণে প্রাণ দিয়েছে বাদশা। 'মান্ধাতার মুল্লুকে' উপন্যাসের কথা মনে পড়ছে কি? তাকে রক্ষা করতে গিয়ে আক্রান্ত হচ্ছে অভিজিৎ । কুমারও আক্রান্ত হচ্ছে রামময়বাবুর অর্কিডের শুঁড়ের দ্বারা, যদিও কুমার মারাত্মকভাবে আহত হবার আগেই বিমলের গুলিবৃষ্টিতে ফুলসমেত অর্কিডটি দু-খানা হয়ে ভেঙে পড়ছে। পরিমলের গুলিতে সেপ্টোপাসের মাথা থেকে লাল রক্তের ফোয়ারা উঠছে আর তার শুঁড়গুলি অভিজিতকে মুক্তি দিচ্ছে, অবশ্য তার পাঁজরের দুটি হাড় ভেঙে দেবার পর। কুমারের সর্বাঙ্গ শুধু ফোড়ার মতো টাটিয়ে উঠেছিল।

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে