এইচ জি ওয়েলস ও তিনটি উপন্যাস

 



      George Mann এর লেখা The Mammoth Encyclopedia of Science Fiction বইতে দেখছি, ‘সায়েন্টিফিক রোমান্স’ নামে এক জঁরের উৎপত্তি হচ্ছে যুগপৎ জুলে ভের্ণ এবং এইচ জি ওয়েলসের হাত ধরে। জুলে ভের্নের ‘জার্নি টু দ্য সেন্টার অফ দ্য আর্থ’ এবং এইচ জি ওয়েলসের ‘টাইম মেশিন’। প্রসঙ্গত, জর্জ মানের বইটার জন্যে সন্তু বাগ দাদাকে অনেক কৃতজ্ঞতা। এই বইটার সন্ধান দিয়ে উনি আমাকে সায়েন্স ফিকশনের ইভোলিশানের ছবিটা স্পষ্ট করলেন।

হাতের কাছে ছিল দ্বিতীয় উপন্যাসটা। অনুবাদ করেছেন অদ্রীশ বর্ধন। কয়েক সপ্তাহ আগে ওয়েলসের ‘কল্পগল্প সমগ্র’ বইটা হাতে এসেছিল। বইটা খুললাম। এবং গোগ্রাসে পড়ে ফেললাম, এক রাত্রে মধ্যে! আমাকে সারাটা সময় এক মুহূর্তের জন্যে থামতে দেন নি ওয়েলস এবং অদ্রীশ বর্ধন। পড়ার পরে ভাবতে বসেছিলাম, এই তাহলে সায়েন্সের রোমান্টিসিজম! যে কারণে ওয়েলসের এত জনপ্রিয়তা!

টাইম মেশিনের গল্প সবাই জানে। টাইম মেশিন-কে কেন্দ্র করে পরবর্তীকালে বহু সিনেমা হয়েছে। ভবিষ্যতে বহু সিনেমা হবেও। অতএব নতুন করে বিষয়বস্তু নিয়ে কিছু বলার নেই। কিন্তু গল্পের বুনন, প্রতি মুহূর্তে টেনশন তৈরী করা, সত্যিই জুলে ভের্নের পরে আর কেউ পেরেছে কি? আমি পড়িনি। অনেকদিন পর পড়লাম।

তুলনামূলক, আমার দম আটকে দিয়েছিল, এই সমগ্রের দ্বিতীয় উপন্যাস --- ‘দ্য ওয়ার অফ দ্য ওয়ার্ল্ডস’! একে উপন্যাস বলে, আমার মতে, নভেলা বলা ভাল। এমনভাবে প্রথম থেকে দমচাপা সিনেমা টাইপ লেখনিতে লিখে ফেলা যায় আমি যাস্ট ভাবতেই পারিনি। প্রতিটা মুহূর্ত তৈরী করা যে কি অসামান্য ক্ষমতার বলে সম্ভব হয়েছে ভাবতেই পারি না। বস্তুত, আমি ওনার সমস্ত লেখা না পড়েও বলছি, এটাই হয়তো ওনার সেরা টানটান উত্তেজনাপূর্ণ উপন্যাস। আমার হতভাগার সাথে এই উপন্যাসটা নিয়ে কথা হচ্ছিল, কথাপ্রসঙ্গে বলল, ২০০৫ সালে স্টিভেন স্পিলবার্গ সিনেমা বানিয়েছেন, অভিনয় করেছে টম ক্রুজ! আমি শুনেই তৎক্ষণাৎ বললাম, জানিস তো, কথা কম কাজ বেশি। সে আমাকে চেনে যে বয়েস থেকে তাতে করে এ কথার উদ্দেশ্য সে ধরে ফেললে এবং ফোন রেখে বিধেয়তে চলে গেল। সিনেমাটার হিন্দী ডাব করা ভার্সান আমার হাতে চলে এসেছে। সে দেখে পরে জানাব, এখন নয়।

‘অ্যা স্টোরি অফ দ্য ডেজ্‌ টু কাম’ উপন্যাসটা কোথাও কোথাও বরং ঝিমিয়ে গেছে। মাঝে মাঝে পড়তে পড়তে একটু বোরই লাগছিল। কিন্তু এই উপন্যাসে একটাই ব্যাপার লক্ষ্য করা যায়, ওয়েলস ভবিষ্যৎ পৃথিবীকে কীভাবে দেখছেন। অনেক কিছুর আভাস তিনি দিয়েছেন, যা মিলেছে বৈ কি। আচ্ছা, ওয়েলস কি মার্ক্সিস্ট ছিলেন? এই উপন্যাসে কিন্তু মার্ক্সিজমের ছাপ পড়েছে বলে মনে হল। যদিও একদম শেষ পর্বে আবার ফিরে গেলেন রোম্যান্টিক পরিবেশনায়। এবং এই উপন্যাসে প্রেমজ উপখ্যানের রোম্যান্টিক টানাপোরেন আছে, তা মোটামুটি ভালই লাগে।

ওয়েলসের যে বিষয়টা আমাকে টেনেছে, জুলে ভের্নের মতোই, তা হল বিজ্ঞানের বাস্তবতা থেকে তিনি পথনির্দেশ খোঁজেন। খোঁজেন বিজ্ঞানের পরিভাষায় অন্তর্দর্শন। ‘দ্য টাইম মেশিন’ লেখাটাকেই নিন না, ‘সূচনা’ পর্ব জুড়েই রয়েছে, টাইম মেশিন যে বানানো যেতে পারে তার একটা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী। এখানে কোন সুররিয়েল উপস্থাপনা নেই। ফলে অলীক কল্পনালতা থেকে বরং বাস্তবের বিশ্বাসযোগ্যতা বেশি এসেছে। কে ভাবতে পেরেছে মঙ্গলের অজেয় প্রাণী অবশেষে রোগ-জীবাণুর কাছে অবশেষে পরাস্ত হবে! ‘দ্য ওয়ার অফ দ্য ওয়ার্ল্ড’ কাহিনীর এই যুক্তির বিশ্বাসযোগ্যতা এমনই, যেন পড়ার পর মনে হল, হয়তো মঙ্গলে প্রাণী আছে, তারা আঘাতও হানতে পারে, কিন্তু ওই রোগের বীজানুর শক্তি তো কম নয়, তা আমাদের রক্ষাও করতে পারে! এটা এতটাই কট্টর যুক্তিগ্রাহ্য, যে, রে ব্র্যাডোবেরি পর্যন্ত তার ‘দ্য মার্শিয়ান ক্রনিকল’ নভেলে এ থিয়োরিটা নিয়েছেন। আবার তৃতীয় উপন্যাসেও ভবিষ্যৎ পৃথিবীর যে গতি-যান্ত্রিকতা তার পূর্ণরূপ, তার বিস্তার, এবং সেই সাথে সাথে আর্থ-সামাজিক পটভূমিকাকে আঁকতে গিয়ে পাতার পর পাতা খরচ করছেন বৈজ্ঞানিক অ্যানালিসিসে, তা যথেষ্টই ভাবায়।

সব মিলিয়ে, চমৎকার বই, চমৎকার অনুবাদ, চমৎকার সমগ্র। এর ছোটগল্পগুলো পড়া শেষ হয় নি, ওগুলো এবার পড়ব। তবে প্রচ্ছদে তাতসুয়া মারিনোর ছবি প্রচ্ছদটার সাথে খাপ খাচ্ছে না। হয়তো, পিপীলিকা সাম্রাজ্য (পড়িনি, আন্দাজ করছি) গল্পটার প্রেরণায় বানানো হয়েছে প্রচ্ছদটা। কিন্তু একটা কল্পগল্প সমগ্র-র প্রচ্ছদ কি একটা ছোটোগল্প থেকে নেওয়ায় যুক্তিযুক্ত? জানি না। আমার তো মনে হয়, না।

 

==========================

এইচ জি ওয়েলস কল্পগল্প সমগ্র

অনুবাদকঃ অদ্রীশ বর্ধন

কল্পবিশ্ব পাবলিকেশান

মুদ্রিত মূল্যঃ ৬৫০/-

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ সমর্পিতা

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে