ফারেনহাইট ৪৫১



আমি নির্বাক। আমি নিস্তব্ধ।

এইমাত্র শেষ করলাম রে ব্র্যাডবেরির বিখ্যাত উপন্যাস ‘ফারেনহাইট ৪৫১’। যারা ডিস্টোপিয়ান উপন্যাস পছন্দ করেন, অথবা যারা সায়েন্স ফিকশান উপন্যাসের পোকা, কিম্বা যারা ব্র্যাডবেরিপ্রেমী তারা এই উপন্যাসের সাথে নিশ্চই সম্যক পরিচিত।

আমি মূর্খ মেয়েমানুষ। জীবনের অনেক বসন্ত পার হয়ে এসে আজ শেষ করলাম এমন এক উপন্যাস, যে উপন্যাসের বিষয়বস্তুগত সমস্যায় বর্তমানের তাবত বাঙালীকূল ভুগছে। এমন অন্ধকার সঙ্কটময় পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে বাঙালী চলেছে। তাদের প্রয়োজন একজন গাই মন্টাগকে, একজন ক্ল্যারিসা ম্যাকক্লিনকে।

মূল গল্প নিয়ে আলোচনার কোন মানে হয় না। যদি অল্প কথায় বোঝাতে হয়, তাহলে গল্পটা এই, একটা শহর তথা রাষ্ট্রে বই পড়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। যারা বই পড়ে, হয় তাদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়, অথবা তারা দেশান্তরী হয়। ফায়ারম্যান, যারা এক সময়ে আগুন নেভানোর কাজ করত, তারা এখন বই জ্বালানোর কাজ করে। এমনই এক ফায়ারম্যান গাই মন্টাগকে কেন্দ্র করে এই কাহিনী এগিয়ে চলে।

বই পোড়ানো অর্থটা প্রতীকী, এটা সহজেই বোঝা যায়। আসলেই আমরা পড়তে চাই না। পড়ার অর্থই হল চিন্তার ক্ষেত্রটাকে প্রশস্ত করা। কেন চিন্তা করব? চিন্তা আমাকে সুখ দেয় না। স্বচ্ছন্দ দেয় না। সে আমাকে রাতদিন অস্বাছ্যন্দে রাখে। আমার প্রতিদিনকে চ্যালেঞ্জ করে --- “শান্তি মন্টাগ, শান্তি। দ্বিধা, প্রশ্ন এই সবকিছু ভুলিয়ে দাও। ... সোজা কথায় লোকজনের মাথাগুলো অদাহ্য তথ্য দিয়ে বোঝাই করে দাও। একেবারে ঠেসে ঠেসে সাধারণ জ্ঞান ভরে দাও। আর এভাবে মাথাগুলোকে ভরিয়ে দিতে পারলেই দেখবে লোকজন খানিক আইঢাই করবে বটে কিন্তু নিজেরা কেমন জানে সেই নিয়ে খুশি থাকবে। ... ভাববে ভীষণ চিন্তাশীল তারা। ... আর, ওর বদলে তাদের খানিক পিছলে জ্ঞান দিয়ে দেখ। পিছলে জ্ঞান, মানে এই ধরো দর্শন, সমাজতত্ত্ব এইসব আরকি। সেখানে প্রশ্ন থাকে। ... লোকজনের সব স্ফুর্তি গায়েব হয়ে যাবে।”

সত্যিই তো তাই। আজ রিলস, কিম্বা ছোট ছোট শর্ট ফিল্মের যা রমরমা, ভাইরাল ভিডিওতে কত তথ্য, কত জ্ঞান, কত অজানা তথ্য ও তত্ত্ব। পোস্ট ট্রুথে ভরে গেছে সারা দুনিয়া। সেগুলো আমাকে সমৃদ্ধ করছে কি? না তো। এমনকি অনেক জনপ্রিয় গল্প-উপন্যাসের মধ্যেও আজকাল আর প্রশ্ন লুকিয়ে থাকে না। খনিক উত্তেজনা আর অলীক সুখ ভরা থাকে। আর আমরা এর মধ্যে ভাসতে ভাসতে ভাবছি আমরা এগোচ্ছি। আসলেই আমরা নর্দমার জলের মতো একই জায়গায় ভেসে খানিক এগোচ্ছি, খানিক পিছোচ্ছি --- “ভালো লেখকরা জীবনকে বহুবার ছুঁয়ে যেতে পারেন তাঁদের লেখায়। মধ্যমেধার লিখিয়েরা তার চাইতে খানিক কম। আর বাজে লেখকেরা বিষয়কে ধর্ষণ করে মশামাছির খাদ্য হিসাবে তাকে ফেলে দেয়।” বলছেন রে ব্র্যাডবেরি।

রে ব্র্যাডবেরি মোক্ষম জায়গায় ঘা মেরেছেন। বলছেন, তোমরা চিন্তাশীল না হয়েই যত গন্ডগোল করছ। অনেকে বছরে শতাধিক বই পরে। প্রশংসনীয় কাজ সন্দেহ নেই। কিন্তু সত্যিই কি পড়ার আনন্দে পরছি, না সংখ্যার আনন্দে গোগ্রাসে গিলছি? এটা ভাববার সময় এসেছে। বছর শেষে আমরা যা পড়েছি, তা নিয়ে কি কখনও কাটাছেঁড়া করছি? মনে হয় না। কারণে লিস্টের জালে আমাদের চিন্তাশক্তি বন্দী। আমাদের রিডিং পড়ার ক্ষমতা বাড়ছে। আমরা পড়ছি, কিন্তু আসলেই আমরা পড়ছি না।

রে ব্র্যাডবেরি তার উপন্যাসে বলছেন, বই পোড়ানোর জন্যে রাষ্ট্রশক্তিকে দায়ী করে কি হবে? মানুষই তো এটা চায়। সাধারণ মানুষ বই থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে, চিন্তাশক্তিকে প্রতিহত করে সুখশক্তিকে মদত দিচ্ছে। এ দোষ কার? পাঠক যদি নির্দিষ্ট কিছু জঁরের বইকে মাথায় নিয়ে নাচে, সেটা কি লেখকের দোষ? সেটা কি প্রকাশকের দোষ? সেটা কি মিডিয়ার দোষ? না তো! পাঠককে জাগাবে কে? লেখক। মজার ব্যাপার, রে ব্র্যাডিবেরির মতো লেখক বাংলাদেশে কবে জন্মাবেন, আদৌ জন্মাবেন কি না, খোদায় মালুম। আজও যারা কল্পবিজ্ঞানের বই প্রকাশ করছেন, তাদের হাতে রে ব্র্যাডবেরির মতোন মুখোশ খুলে দেওয়া লেখক নেই। তাদের হাতে স্পেশশিপ উড়িয়ে এলিয়েনের সাথে যুদ্ধ করার মতো লেখক আছে, যে লেখার বিজ্ঞানসন্মত মানের দিকে থেকে দেখলে আইনস্টাইনও লজ্জা পাবেন।

রে ব্র্যাডবেরি দুটো মোক্ষম কথোপকথনে তার যাবতীয় চেতনার নির্যাস রেখে গেছেন। একটা ক্যাপ্টেন বিটি – মন্টাগ কথোপকথন, আরেকটা ফেবার – মন্টাগ কথোপকথন।

শেষের দিকে বড়ো সুন্দর কয়েকটা কথা লিখেছেন রে ব্র্যাডবেরি। লিখছেন, “মৃত্যুর আগে প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু রেখে যাওয়া উচিৎ। একটি সন্তান কিংবা একটা বই কিংবা একটা পেইন্টিং কিংবা একটা বাড়ি কিংবা একটা দেয়াল কিংবা নিদেন হাতে গড়া একজোড়া জুতো। অথবা নিজে হাতে তৈরি একটা বাগান। তোমার হাতের ছোঁয়া লেগেছে এমন কিছু। যাতে মৃত্যুর পর তোমার আত্মার বসবাসের জন্য জায়গা থাকে একটা। তোমার পোঁতা কোন গাছ, কিংবা তার ফুলের পাপড়িতে কেউ কখনো হাত ছোঁয়ালে তোমার স্মৃতি সেখানে ঠাঁই পাবে। কী করছ সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। কোনকিছুতে তুমি হাত ছোঁয়াবার আগে তা যা ছিল, তোমার হাত ছোঁয়াবার পর তাতে খানিকটা বদল এল কি না সেটাই আসল।”

রে ব্র্যাডবেরি আমাদের জন্যে রেখে গেলেন ফারেনহাইট ৪৫১। দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য আমাদের জন্যে উপহার দিলেন আন্তর্জাতিক মানের মাতৃভাষায় অনুবাদ। আর আমরা?

===============================

ফারেনহাইট ৪৫১

রে ব্র্যাডবেরি

ভাষান্তরঃ দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য

কল্পবিশ্ব পাবলিকেশান

মুদ্রিত মুল্যঃ ৩৫০ টাকা

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ সমর্পিতা

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে