কেস অফ চার্লস ডেক্সটার ওয়ার্ড


 


এ সংসারে অনেক রহস্যের সমাধান না করাই মঙ্গল। অনেক জিনিস জানতে নেই, জানার জন্যে অনুসন্ধান করতে নেই, যে ভাবে চলছে সেই ভাবেই চলতে দেওয়া ভাল।


      এই প্রথম, লাভক্র্যাফটের অতীন্দ্রিয় চরম নেতিবাচক বিভীষিকা থেকে সরে গিয়ে একটু অন্যরকম লেখা পেলাম। না না, লেখার বিষয়বস্তু সেই একই --- সেই মন্ত্রগুপ্তি, সেই ভয়ার্ত আবহ, সেই বিপজ্জনক তন্ত্রাচার, সেই মৃত্যুর বিভীষিকা, সেই অন্য ভুবনের ভয়াবহতার হাতছানি, সেই কালচক্রের প্রকৃতিকে টেক্কা মারার চেষ্টা।

      কিন্তু এখানে অনুপস্থিত বিষন্নতা, অনুপস্থিত অবষাদ। লাভক্র্যাফট এখানে অবশেষে ভয়কে টেক্কা দিয়ে নির্ভয়ের অগ্রগমনেই শেষ করেছেন। এখানে ভয়কে নিয়ে নাড়াঘাটা করতে গিয়ে খুব বেশি তমসার গভীরে যেতে পারেন নি, বা, বলা ভালো, যান নি। হয়তো উপন্যাস বলেই। ওনার অন্য কোন উপন্যাস পড়া হয় নি বলেই জোর দিয়ে বলতে পারছি না। তবে এ উপন্যাস ভাল লাগল।

      যদিও, আমি এখনও আমার প্রথম দিনের সিদ্ধান্ত থেকে একচুলও হঠছি না। বাঙালী লাভক্র্যাফটকে নেয় নি, তার কারণ ভয়াবহ বলে নয়, তার কারণ নেগেটিভ এপ্রোচ। প্রায় সমস্ত ছোট গল্পগুলো ঘিরে ঘিরে ভয়ের নেতিবাচক যে ভঙ্গিমা তিনি তৈরী করেছেন, বাঙালী তা পছন্দ করে না। যেখানে কর্ণ কিম্বা দুর্যোধনের মতো আপাদমস্তক নেগেটিভ চরিত্রকে উঁচু চোখে দেখা হয়; যেখানে রাবণকে বা মেঘনাদকে রামের থেকে অনেক বেশি প্রশংসনীয় চরিত্র বলে মান্যতা দেওয়া হয়; যেখানে মহাকাব্যের খল, দুষ্ট চরিত্রের মধ্যে আমরা মহানায়কোচিত মূর্ততা আরোপ করার উদারতা দেখাই, সেখানে লাভক্র্যাফট জমে না, লাভক্র্যাফটের ভয়ের বাতাবরণ জমে না, লাভক্র্যাফটের বীভৎস রস জমে না। ভয়ের এই বীভৎস নেতিবাচক রূপকে আমরা কোথাও নায়কোচিত সৌন্দর্যতা আরোপ করতে পারি না বলেই জমে না, এমনকি, তা অদ্রীশ বর্ধন অনুবাদ করলেও না। তা পরিত্যাজ্য। উত্তম কুমারের মহালয়া পাঠের মতোই ত্যাজ্য।

      ১৯৭৬ সালে প্রথম অনুবাদ হয়েছিল এই উপন্যাসটি – কেস অফ চার্লস ডেক্সটার ওয়ার্ড। আমার ধারণা, অদ্রীশ বর্ধনের জুল ভার্ণ অনুবাদ নিয়ে যত হৈ চৈ হয়েছিল বা হয়, তার সিকিভাগ হৈ চৈ এই উপন্যাসটার ভাগ্যে মেলে নি। এমনকি ২০১৯ সালে সন্তু বাগ এবং দেবজ্যোতি ভট্টাচার্যের সম্পাদনায় পুণরায় প্রকাশিত হওয়ার পরেও নয়। স্ট্যাটিস্টিক্স আমার এই হাইপোথিসিসকে ভুল প্রমাণ করলে খুশি হব।

      অথচ এই উপন্যাসটার পর ওনার আরও কয়েকটি উপন্যাস অনুবাদ হওয়া প্রয়োজন ছিল। কে জানে, সেই উপন্যাসগুলোতেও যদি এইরকম সদর্থক ভয়ের উজ্জ্বল উপস্থিতি থাকত, কে বলতে পারে, তাহলে হয়তো লাভক্র্যাফট নিয়ে আলোচনা বাড়ত। কে বলতে পারে, তাহলে হয়তো ‘লাভক্র্যাফট উপন্যাস সমগ্র’ বের হতে পারত। কিন্তু, ওই উপন্যাস পর্যন্তই। তার ছোটগল্পের সমাদর করার মতো অবস্থায় বাঙালী এখনও পৌছাতে পারে নি।

এ পর্যায়ে লাভক্র্যাফটের সাথে জীবনানন্দ দাসের কোন পার্থক্য নেই।

যাই হোক, বাঙালী জাতটা নিশ্চিহ্ন হতে আরোও কয়েকটা জেনারেশান বাকি আছে। তার মধ্যে নিশ্চয়, আমরা আশা করতে পারি, জীবনানন্দের মতো লাভক্র্যাফটও সমাদর পাবে। বাংলায় না হোক, অন্তত ইংরাজী জানা বঙ্গপুঙ্গবদের কাছে।

 বইটা এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলার মতো। অনুবাদ এতটাই সাবলীল। অদ্রীশ বর্ধন বলেই হয়তো। তিনি লিজেন্ড। তার কাজ প্রশংসারও উর্ধ্বে। জানি না, কল্পবিশ্ব পাবলিকেশান লাভক্র্যাফটের বাকি উপন্যাসগুলোকে নিয়ে কিছু ভাবছেন কি না। যদি লাভক্র্যাফট নিয়ে কেউ কিছু করেন, আমার মনে হয়, তারাই পারবেন।

==================================

কেস অফ চার্লস ডেক্সটার ওয়ার্ড

এইচ পি লাভক্র্যাফট

অনুবাদকঃ অদ্রীশ বর্ধন

কল্পবিশ্ব পাবলিকেশান

মুদ্রিত মূল্যঃ ২০০ টাকা

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ সমর্পিতা

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে