আমি তখন দশম শ্রেণী, আমি তখন...



ঘটনাটা আবার মনে পড়ে গেলযখন ক্লাস টেনে পড়ি তখনকার কথা। অন্য একটা স্কুলে আমার হতভাগা তখন পড়ছে। আমাদের দুজনকে অপেক্ষা করতে হবে আরোও একটা বছর। চার আর দুই --- ছয় চোখের মিলন ভবিষ্যতের অন্তরালে।

 

তো যা বলছিলাম। সরস্বতী পূজোর দিন। সেবারে অশৌচ ছিল বলে আমাদের বাড়ীতে পূজো হল না। কিন্তু তাতে কি? স্কুলে তো যাব। সেখান থেকে বন্ধুর বাড়ী। সেখানে আড্ডা দিয়ে বিকেলে বাড়ী ফিরব। মা যত্ন করে শাড়ী পরিয়ে দিল। এখনো মনে আছে আমার প্রথম শাড়ী পড়ার দিনটা। তার আগে ছোটবেলায় যেমন বাচ্চারা শাড়ী পড়ে তেমন পড়েছি অনেক। কিন্তু এটা যেন অন্যরকম কিছু। স্কুলে সালোয়ার পড়ে যেতাম। এই প্রথম শাড়ী পড়লাম। লাল শাড়ীপাড়ে হালকা কমলা নকশার কাজসঙ্গে ম্যাচিং ব্লাউস। গলায় সরু চেন। হাতে কাচের চুড়ী। আবার শখ করে একটা আঙটিও পড়েছি।

বাবা আমার জন্যে, মানে শুধুমাত্র আমার জন্যে শাড়ীটা কিনে এনেছে। তার মেয়ে প্রথম শাড়ী পড়বে বলে কথা! বাবার চয়েস খুব ভাল, রঙ বোঝে। এই প্রথম আমার একটা শাড়ী সম্পত্তি হ্ল। এটা আমার। একান্তই আমার। কাউকে এর ভাগ দেব না। কিন্তু তবুও, নিজেকে কেমন লাগছে ঠিক বুঝতে পারলাম না আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম। মা মুখ ঝামটা দিয়ে বলল, এই বেরো তো। এমনিতেই কেলে ধুমসী দেখতে, তার আবার আয়না। যা বেরো। ঘরটা গুছাতে দে।

মাথাটা রাগে লজ্জায় ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল। বেরিয়ে এলাম। কিন্তু কেমন লাগছে সেটা না বুঝতে পারলে ঠিক স্বস্তি মিলছে নাঅগত্যা বেসিনের আয়নাই ভরসা। ঘ্যানঘ্যান করে মায়ের কাছ থেকে নিয়ে ঝুমকো দুল পড়েছি। কানের পাশে তালে তালে দুলতে দেখছি। আমাকে কেমন লাগছে? ঠোঁটে লিপস্টিক হালকা করে দিয়েছি। একটা লাল টিপ পড়েছি। আচ্ছা, টিপটা বড় হয়ে গেল না তো? ছোট পড়ব? আঃ! বড্ড জ্বালাচ্ছি তো আমি নিজেকে!

চুল খোলা। শ্যাম্পু করেছি। কন্ডিশনার দিয়েছি। যখন যাব চুলটা তখন উড়বে, দীপিকা পাড়ুকোনের মতো। আমি যাব সাইকেলে। হাওয়ায় আমার চুল, শাড়ীর আঁচল উড়বে। সবাই হাঁ করে তাকিয়ে থাকবে। পুরো পৃথিবী ফ্রীজ হয়ে যাবে আমাকে দেখার জন্য।

“অ্যাই! তুই এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি করছিস?” ভাই সদ্য ঘুম থেকে উঠে টলতে টলতে এসে আমাকে বাথরুমের সামনে দাঁড়িয়ে অদ্ভুত মুখভঙ্গী করতে দেখে থতমত খেয়ে জিজ্ঞাসা করল।

“এই, আমাকে কেমন লাগছে রে?”

ভাই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল। বলল, “একটা কাজ কর। শাড়ীটা হাটু অবধি গুটিয়ে নেবাজারে দশকর্মার দোকান থেকে একটা টিনের খাঁড়া কিনে নে। তারপর একহাতে ওটা ঘুরাতে ঘুরাতে সাইকেল চালিয়ে স্কুলে চলে যা। পারফেক্ট মানাবে।”

“ঈ ঈ ঈ ঈ ঈ...............”, ততক্ষণে ভাই বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে।

 

কাকে জিজ্ঞাসা করি? কে বলবে? আমি বাবা-মা’র ঘরে ঢুকলামএকটাই লোক আছে যে ঠিকঠাক বলতে পারবে। আশেপাশে মা নেই তো? না নেই। বাবা বিছানায় বসে পেপার পড়ছে, পাশে চা।

“বাবা, আমাকে কেমন লাগছে?” আমি নিজেকে ঘুরিয়ে বেকিয়ে দেখালাম।

“তোকে তো অপ্সরার মতো লাগছে রে! বাঃ! দারুন মানিয়েছে তো তোকে শাড়ীটায়!”, বাবার চোখে-মুখে বিস্ময়। তার কন্যা হঠাৎ করে মহিলা হয়ে গেছে, সেটা এখনও হজম হচ্ছে না মনে হচ্ছে।

শুনে খুশি হলাম। তবুও খুঁতখুঁতানি গেল না। বললাম, “হ্যা গো! ব্লাউজটা কি একটু ক্যাটকেটে হয়ে গেল না? শাড়ীটার সাথে যাচ্ছে কি?”

“না না। একদম পারফেক্ট মানিয়েছে তোকে।” বাবা পেপারটা সরিয়ে রেখে আমার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে পা নাচাতে লাগল। বাবা উত্তেজিত হয়ে গেছে। তার মানে আমাকে ঠিকঠাকই লাগছে। না কি মজা দেখছে? কে জানে। মনে তো হচ্ছে না ইয়ারকি মারছে। চোখে-মুখে মুগ্ধতা। কিন্তু কি যেন একটা কম কম লাগছে? আমি ড্রেসিং টেবিলের আয়নার দিকে তাকালাম। ওখানে আমাকে আবার পুরোটা দেখা যাচ্ছে।

“আচ্ছা, টিপটা কি আরেকটু ছোট পড়ব? না এটাই ঠিক আছে?”

“এই বেরো তো, বেরো এখান থেকে। আদিখ্যেতা না দেখিয়ে বেরোবি না শাড়ী খুলে নেব?” মা ঝাঁটা হাতে কখন থেকে দরজার ধারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার কান্ড দেখছিল, খেয়াল করি নিঅনেকক্ষণ সহ্য করেছিল, এবার ঝাঁঝিয়ে উঠল। আমি কাঁদোকাঁদো হয়ে বললাম, “আমি শাড়ী পড়ব না। আমায় ভাল দেখাচ্ছে না।”

“ভাল লাগছে কি লাগছে না সেটা বাইরে না বেরোলে বুঝবি কি করে? তুই বেরো তো।” মা ঝাটাটা সোজা বাইরের দিকে দেখিয়ে বলল। এবার না বেরোলে ওই ঝাঁটা আমার পিঠে পড়বে, বুঝতে পারলাম। আমি বেরিয়ে এলাম।

 

প্রথম নিজেকে বড়ো মনে হওয়ার দিনটা সকলের মনে থাকে কি? আমার আছে, খুব স্পষ্টই আছেশাড়ীর প্রতি প্রীতি সেই যে তৈরী হল, আজও যায় নি। অনেক রকম ড্রেস পড়েছি। এমনকি রিভিলিং ড্রেসও। কিন্তু শাড়ী আমাকে যে সৌন্দর্য দিয়েছে, যে স্বস্তি দিয়েছে, যে সুখ দিয়েছে, তা আর কিছুতে নেই। সত্যিই নেই। শাড়ী আমাকে এক ধাক্কায় বড় করেছে, গম্ভীর করেছে, মহিলা বানিয়েছে। অনেকের কাছে সম্ভ্রম আদায় করিয়েছে। আমি কি ব্যাকডেটেড? না। বাবা সেদিন বলেছিল, “এক-এক জনকে এক-একরকম ড্রেসে মানায়। তোকে শাড়ীতে মানায়। তুই তোর মায়ের মতো হয়েছিস।” কি খুশি হয়েছিলাম সেদিন। এত খুশি কখোনো হই নি। আজও জামা-কাপড়ের দোকানে গেলে একটা না একটা শাড়ীর ভাজে হাত না বুলিয়ে বেরোই না। এত ডিজাইন, এত রঙ, এত কাজ, এত আর্ট --- আর কোন পোষাকে নেই।

 

“তোকে তো দেখতে খুন-খারাপির মত লাগছে রেঠাকুর দেখব না তোকে দেখব?”, আমার এক বন্ধু বলেছিল আমার দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে। নিজেকে কেমন সেলিব্রিটি মনে হয়ছিল সেদিনযতক্ষণ আমরা দল বেধে ঘুরেছিলাম, সে একবারও আমার পাশ থেকে নড়েনি...

 

দুঃখের বিষয়, সেদিন কোন ছবি তোলা হয় নি।

 

==========================

 

বিঃ দ্রঃ - ছবিটা ইন্টারনেট থেকে ঝেড়েছি। কয়েক বছর আগে পন্ডীচেরীর সী-বীচের পাথরের ওপরে সেই শাড়ীটাই পড়ে এভাবেই বসেছিলাম। নীল সাগরের বুকে ঝাপিয়ে মিশে যেতে ইচ্ছা করেছিল সেদিনকিছু ইচ্ছা মনের ভেতরেই রেখে দিতে হয়। না হলে প্রাণ রাখা দায়।


Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে