লাভক্রাফট, বাঙালী ও মৃত্যুচেতনা

 




কোটি বর্ষে মরণেরও মৃত্যু যদি হয়

অনন্তশয়ানে থাকে সে তো মৃত নয়

 

আমার কোথাও মনে হয়, ‘ভয়’ আর ‘মৃত্যুর আশঙ্কা’ পাশাপাশি হাত ধরাধরি করে আছে। যেদিন মৃত্যুকে আমরা জানতে পারব, সেদিন পুরোপুরি ভয়মুক্ত হব; কিম্বা যেদিন মৃত্যুর পরবর্তী অবস্থাকে জানতে পারব, ভয় থাকবে না; অথবা যখন মৃত্যুকে অন্তর থেকে গ্রহণ করব, ভয়ের পরিধি থেকে বেরিয়ে আসব।

লাভক্র্যাফট ভয়কে জয় করতে চান নি। ভয়কে উপভোগ করতে চেয়েছেন। ফলে তার লেখায় এত বিষন্নতা, এত অবষাদ। এবং ভয়ের রহস্যময় বীভৎসতার দিকটাই দেখার চেষ্টা করেছেন। তার সৌন্দর্যকে উপভোগ করতে পারেন নি। একদমই কি পারেন নি? দু-একটা গল্প বাদ দিয়ে। যেমনঃ Tha Man Of Stone (পাথরের মুর্তি)। প্রসঙ্গত, এই গল্পটি পড়ে ‘শঙ্কুর সুবর্ণ সুযোগ’ গল্পটার কথা মনে পড়ে যায়। দুটো গল্পের মধ্যে কোথাও কি কোন সংযোগ আছে? জানা যাবে না আর হয়তো কোনোদিন।

তো লাভক্র্যাফট এই ভয়কে বীভৎসতার রূপ দিতে গিয়ে কতকগুলো শব্দ এবং সেই শব্দের প্রতিভাস তৈরী করলেন নিজের মতো করে। যেমনঃ থুলু, ইথ, নিয়ারলাটহোটেপ, অজাথথ, নেক্রোনমিক্রন ইত্যাদি। এই শব্দগুলোর সাথে জড়িয়ে রাখলেন ভয়ঙ্কর পৈশাচিক মৃত্যুর ইঙ্গিত। একটু ভাল করে ভেবে দেখলে, হয়তো এটাও বলা যায়, বাঙলায় এই যে তন্ত্র-সাহিত্যের এত রমরমা, তার পেছনের একটা বড়ো কারণ কিন্তু এই মৃত্যুর বীভৎসতা এবং তার সাথে যোগ করুন যৌনরসের নানা উদ্ভট আচারের ইঙ্গিত। ফলে বাঙালী যে বীভৎসতা পছন্দ করে না, এমন নয়, সে লাভক্রফটের বীভৎসতা পছন্দ করে না, তার কারণ, আমি এখনও পর্যন্ত তাকে শুধুই মৃত্যুর বীভৎসতা নিয়ে চর্চা করতে দেখছি। হিপোক্রিট যৌনতা’র বীভৎসতার কদর যতটা বাঙালী করতে ভালবাসে, শুদ্ধ মৃত্যুর অবষাদগ্রস্থতার রূপটায় ততটা তারা স্বচ্ছন্দ নন। সেখানে তার কাছে গোয়েন্দা গল্পের সমাদর বেশি।

দেবজিৎ ভট্টাচার্যের অনুবাদের অনুরাগিণী হয়ে গেছি। এই বইটাতে যে দশটা গল্প তিনি অনুবাদ করেছেন, সেটা থেকেই মুলত লাভক্র্যাফট আমার কাছে পরিস্কার হয়েছে। দিনের আলোর মতো নয়, সকালের আলোছায়ার মতো।

লাভক্রাফট মৃত্যুর বীভৎসতাকে নিয়ে বেশি মাথা ঘামিয়েছেন বটে, কিন্তু সেই বীভৎসতার সৌন্দর্যটাকে কতটা সুন্দরভাবে ধরতে পেরেছেন? খাপছাড়াভাবে। কারণ, তার জীবনশৈলী তাকে নিয়ে গেছে বিষাদের অভিমুখে, এবং সেখান থেকেই তিনি পৈশাচিকতার ইঙ্গিত বারেবারে দিয়ে ছেড়ে দিয়েছেন। কারণ, আমার মনে হয়েছে, অপার্থিব বস্তুর সম্পর্কে ততটা তিনি ওয়াকিবহাল হতে পারেন নি, যতটা তার থেকে আসা মৃত্যুর ভয়াবহতা সম্পর্কে তিনি মাথা ঘামিয়েছেন।

 

“দেখেছি উন্মুক্ত হতে অন্ধকার মহাবিশ্ব এক

যে-বিশ্বে আঁধার গ্রহ নিরুদ্দেশ অন্ধকারে ভাসে

অন্তহীন আতঙ্কের মহোৎসবে প্রবল ঘুর্ণন

জ্ঞানশূন্য, জ্যোতিশূন্য, নামহীন অসীম আকাশ”

 

লাভক্র্যাফটের এই ইঙ্গিতের মধ্যে অসামাপ্ত কল্পনা আছে। সেই কল্পনার শক্তি মারাত্মক। পৃথিবীতে তার প্রভাব অনেক জায়গায় পড়েছে, অনেক লেখককে প্রভাবিত করেছেন। কিন্তু এরকম বিজাতীয় কল্পনাতে আমাদের বাঙালিদের মন টেকে না। ডাইনি, তন্ত্র, কিম্বা ভৌতিক ভয়াবহতার পাশাপাশি বীভৎরসেও যদি মাধুর্য না থাকে, তাহলে তা আমরা নিতে পারি না। সেক্ষেত্রে লাভক্র্যাফটকে পছন্দ হওয়াটা একটু কঠিনই বটে।

দেবজ্যোতি ভট্টাচার্যের অনুবাদ আলাদা করে বলার আছে। যে দশটি গল্প তিনি নির্বাচন করেছেন তা লাভক্র্যাফটের বোধের অত্যন্ত কাছের। ভালোভাবে অনুভব করে তবেই তিনি অনুবাদ করেছেন। ফলে অনুবাদ অত্যন্ত সাবলীল ও যথাযথ হয়েছে। অন্তত পড়ে সুখ আছে। তবে লাভক্র্যাফটের মজা রাত যত গভীর হয় তত বাড়ে। আর বাড়ে পাঠকের কল্পনাশক্তি ও তার কাছে সেটার বিশ্বস্ততার ওপর।

 

==========================

অজানা ১০

এইচ পি লাভক্র্যাফট

অনুবাদকঃ দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য

সুচেতনা পাবলিকেশান

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ সমর্পিতা

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে