চিত্রবিচিত্র মানুষ

 



আমার একটা বদ অভ্যাস আছে। ধাঁই করে যে কোন বই শুরু করতে পারি না। প্রথমে প্রচ্ছদ দেখি। তারপর ব্যাক কভার দেখি। কেমন লাগছে দেখতে বইটাকে উলোট পালোট করে দেখি। তারপর প্রকাশকের কথা, লেখকের কথা, মুখবন্ধ ইত্যাদি হাবজি গাবজি দেখতে থাকি। অনেক সময় তারা আমাকে খালি হাতে যেমন ফেরায় না, তেমনই বইটার প্রতি লেখক থেকে শুরু করে প্রকাশক, এমনকি আর্টিস্টের মমত্ববোধও অনুভব করতে পারি।

‘চিত্রবিচিত্র মানুষ’ বা ‘দ্য ইলাস্ট্রেটেড ম্যান’ বইটার শুরুতেই অনুবাদকের লেখাটাতে চোখ বোলাচ্ছিলাম। একটা লাইনে এসে স্থির হয়ে গেলাম। অনুবাদক সুমিত বর্ধন লিখছেন, “... সিসিফাসের মতো অসম্ভবের বিরুদ্ধে নিরন্তর সংগ্রাম করে চলা মানুষ...”। স্যার, আপনি এই লাইনটা লিখলেন কেন? মানে সিসিফাসকে মনে হল কেন? আমি নিশ্চিত, আপনি রে ব্র্যাডবেরির একদম অন্তরে সেঁদিয়ে গেছেন। না হলে এই উদাহরণ আসে না।

      আমার মনে হয়, ঠিক এই লাইনটার মর্মার্থের ফল্গুধারা এই গল্প সংকলনের পরতে পরতে বয়ে গেছে। যেমন ‘ক্যালাইডোস্কোপ’, যেমন ‘কোনও বিশেষ রাত বা সকাল নয়’। পরের গল্পটার একটা জায়গায় তো সরাসরি প্রশ্ন --- “এ জীবনে কেউ কেন কিছু করে, কেউ কি বলতে পারে?” কিম্বা “বোকা আমরা সবাই... সর্বদাই। তবে ওই যা, এক-একদিন এক-এক ধরনের বোকা। আমরা ভাবি, আজ আর আমি বোকা নই। যা শিক্ষা নেওয়ার নিয়েছি। গতকাল বোকা ছিলাম বটে, তবে আজ নই। তারপর আগামীকাল বুঝব, হ্যাঁ, আজকেও বোকা ছিলাম। আমার মনে হয়, আমরা যে নিখুঁত নই সেটা ধরে নিয়ে বাঁচাটাই এই দুনিয়ায় আমাদের মানসিক উন্নতি করার, টিকে থাকার একমাত্র উপায়।” এই গল্পে রে ব্র্যাডবেরি কি নিজের চিন্তাভাবনাকেই কাঁটাছেঁড়া করার চেষ্টা করেছিলেন?

      এই গল্প সংকলনটিও হয়তো ‘ফিক্স-আপ’ নভেলের দিকে যেতে পারত। কিন্তু ‘ভাগ্যচক্র’ নামক ছোটগল্প থেকে সেই যে চিত্রবিচিত্র মানুষটি ভ্যানিশ হয়ে গেলেন, তাকে হঠাৎ করে ‘চিত্রবিচিত্র মানুষ’ নামক শেষ গল্পে ফিরিয়ে আনতেই মনে পড়ে গেল, ও আচ্ছা! এটা তো এই মানুষটার গায়ের থেকে বেরিয়ে আসা গল্পগুলো! তবে এই গল্পটার মধ্যে সায়েন্স ফিকশানের মাঝেও যে এভাবে ম্যাজিক রিয়েলিটি সুচারুভাবে ঢুকিয়ে দেওয়া যায়, না পড়লে এই অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত হতাম। আর রে ব্র্যাডবেরি একবার, মাত্র একবারই দেখলাম ঈশ্বরকে কিভাবে দেখতেন, আমাদের জানাচ্ছেন। ‘সেই মানুষটা’ গল্পে বোঝা যায়, ঈশ্বরকে কত আপন করে অনুভব করেছেন তিনি। তার প্রকাশ ঘটিয়েছেন নিজের মতো করে। কিন্তু, মাত্র ঐ একবারই।

      এই গল্প সংকলনের ভূমিকাও একই মানুষকে দিয়ে শুরু হয়েছে। চিত্রবিচিত্র মানুষকে দিয়ে। তার সারা গায়ে উল্কি আঁকা। কেমন সব উল্কি? “রকেট, ফোয়ারা, মানুষ, কী না আঁকা ছিল সেই চিত্রবিচিত্র ত্বকে। রঙে আর পুঙ্খানুপুঙ্খ কাজে সে ছবি এমনই জীবন্ত যে মনে হয়, ত্বকে আঁকা মানুষের ভিড় থেকে শোনা যাচ্ছে মৃদু, অস্পষ্ট গুঞ্জন।” এছাড়াও সারা প্যারা জুড়ে বিভিন্ন চিত্রের সমাহারের বর্ণনা। কিন্তু প্রচ্ছদের দিকে তাকালে মানুষটার শরীরে ‘পাহাড়, নীল নদী’ ছাড়া আর কিছু কমন মেলে না। রঙের বাহারের কথা ছেড়েই দিলাম। সিল্যুয়েটে আঁকা মানুষটাকে দেখে ‘তার এককালের পেশিবহুল শরীরটায় মেদ জমে ছাপ পড়েছে স্থূলতার।’ মনে হচ্ছে না। সেদিক থেকে বলতে গেলে, হয় সুমিত বর্ধন ভুল অনুবাদ করেছেন, নয় সুবিনয় দাস ভুল ছবি এঁকেছেন, অথবা প্রকাশক প্যানেল প্রচ্ছদ নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামান নি, চূড়ান্ত ফাঁকিবাজি করেছেন। অথচ, অলংকরণগুলো ‘মঙ্গল গ্রহের ডায়রী’ বইটার মতোই রীতিমতো বুদ্ধিদীপ্ততায় ভরপুর। এই প্রচ্ছদটা করার সময় যদি একই বইয়ের বিদেশি অন্যান্য প্রচ্ছদগুলো দেখতেন, ভালো করতেন। আমার মনে হয়, রে ব্র্যাডবেরির তিনটে বইয়ের মধ্যে এটার প্রচ্ছদ সবচেয়ে অ-যথাযথ।

      অনুবাদ অসাধারণ। একদম অনুভবি অনুবাদ। রে ব্র্যাডবেরির তিনটে অনুবাদই বিশ্বমানের। এমন অনুবাদ পড়লে, যারা বলে, মূল ভাষায় লেখার মাধুর্য ইত্যাদি ইত্যাদি, তাদেরকে বলতে ইচ্ছা করে ‘গোলি মারো মূলভাষা’, আ মরি বাংলা ভাষাতেই আমি হাসতে-কাঁদতে চাই। অসামান্য অনুবাদ করেছেন সুমিত বর্ধন। ‘আফ্রিকার তেপান্তর’ কিম্বা ‘রকেট’ গল্পটা পড়ে অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসেছিলাম; ‘শহর’ কিম্বা ‘বর্ষা অবিরাম’ পড়তে পড়তে প্রাণটাই যেন নিজের গলার কাছে এসে ধুকপুক করছিল; ‘বড়রাস্তা’ কিম্বা ‘সন্ধিক্ষণ’ পড়তে পড়তে নিজেরই মনে হচ্ছিল, কি অসাধারণ লেখা পড়ছি বাংলায়; কিম্বা ‘শুধু যাওয়া, আসা’ বা ‘কলপুতুল কোম্পানি’ পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল, এটা আসলেই আমার ভাষাতেই লেখা নয় তো! নামগুলো বাংলায় হলে পার্থক্য করা খুব মুশকিল হতো।

      ব্যক্তিগতভাবে আমাকে ভাবিয়েছে ‘কোনও বিশেষ রাত বা সকাল নয়’ এবং ‘ক্যালাইডোস্কোপ’। আমার মনে হয়, রে ব্র্যাডবেরির যদি নিজের কাছেই নিজেকে কিছু বলার থাকে, তা যেন এই দুটো গল্পের মধ্যে দিয়ে বলে গেছেন। মানুষ যখন শেষ মুহূর্তে এসে থামে, জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণ থেকে মৃত্যুর দিকে এগোতে থাকে, তখন তার উপলব্ধি, যেন রে ব্র্যাডবেরির সমগ্র জীবনের উপলব্ধি। তিনি বলছেন, নিজেকেও, আমাদেরকেও ----

      “কী করতে পারি আমি? একটা ভয়ানক শূন্য জীবনের প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে কিছু কি করার আছে আমার? সারাজীবন ধরে যেসব বিদ্বেষ জমা করে রেখেছিলাম, যেগুলো আমার মধ্যে রয়েছে বলে আমি জানতাম না পর্যন্ত, তার মাশুল হিসাবে যদি অন্তত একটা ভাল কাজ করতে পারতাম। কিন্তু এখানে আমি ছাড়া তো আর কেউ নেই, আর নিজে একা একা কি আর কোনও ভালো কাজ করা যায়? করা যায় না।”

 ===================================

চিত্রবিচিত্র মানুষ

রে ব্র্যাডবেরি

অনুবাদকঃ সুমিত বর্ধন

কল্পবিশ্ব পাবলিকেশান

মুদ্রিত মুল্যঃ ৩৫০/-

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ সমর্পিতা

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে