মঙ্গল গ্রহের ডায়েরি

 



উপন্যাসের সুবিধা --- একদিনে পঞ্চাশ-পচাত্তর পাতা পড়ে ফেলা যেতে পারে। মাঝারি মাপের উপন্যাস তিনদিনে শেষ করে ফেলা যেতেও পারে। ছোটগল্পে কিন্তু সেটি হওয়ার যো নেই। বিশেষত যে সমস্ত গল্পে গভীরতা অনেক বেশি। সেক্ষেত্রে একটি বা দুটি --- ব্যাস! সারাদিনে নতুন গল্পে হাত দেওয়ার মত মানসিকতা রাখা দুরূহ হয়ে পড়ে।

আমার এই উপন্যাস তথা ছোট গল্প সংকলনটা শেষ করতে এক সপ্তাহ লাগল এই কারণেই।

'ফারেনহাইট ৪৫১' উপন্যাসেই আন্দাজ করেছিলাম, রে ব্র‍্যাডবেরীর একটা অন্তর্দৃষ্টি আছে। কবির অন্তর্দৃষ্টি। তার লেখার মধ্যে একটা Vision আছে। তিনি স্রেফ বেডরুম স্টোরি বলছেন না। ফলে অনুবাদ তেমন তেমন হলে বই উলটে রাখতেই হবে। ভাবতে হবে। কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হতে হবে। তারপর আবার বই হাতে নিতে হবে।

যশোধরা রায়চৌধুরী আপাদমস্তক কবি। কবি অর্থে, যার অন্তরে এক দৃষ্টি জন্মেছে। কোন লেখক যখন কবি হন, তা যেন ঈশ্বরের মহাপ্রসাদের মতো। কিম্বা সরস্বতীর অপাঙ্গ দৃষ্টিপাতের মতো। যশোধরা রায়চৌধুরী এই অনুবাদের কাজ নিজের চেতনসত্ত্বাকে নিংড়ে দিয়ে করেছেন। জানি না, অনুবাদ করতে করতে কখনও তার চশমা মুছতে হয়েছে কি না। জানি না, অনুবাদ করতে গিয়ে কটা রাত তাকে জেগে থাকতে হয়েছে ব্র‍্যাডবেরির স্বত্ত্বার অভিভূতির কাছে। তবে প্রসঙ্গত বলে রাখি, সুবিনয় দাসের অলংকরন যতটা যথাযথ, প্রচ্ছদ ঠিক ততটাই বেয়াক্কেলে টাইপের। অন্তত এই উপন্যাসটার পরিপ্রেক্ষিতে ‘মার্স জাংশানের’ একটা ছবি! ঠিক যায় না।

"মার্শিয়ান ক্রনিকলস সায়েন্স ফিকশান বা কল্পবিজ্ঞান গোত্রের বই। এবং এর জনরাঁ 'ফিক্স আপ' নভেল।" লিখছেন অনুবাদিকা বইয়ের মুখপ্রবন্ধে। অর্থাৎ, এই উপন্যাস যেন বিভিন্ন সময়ে একই বিষয়বস্তুর ওপর লেখা ছোটগল্পগুলোকে একটা সুতোয় গেঁথে নিয়ে উপন্যাসের মালা বানানোর খেলা। রে ব্র‍্যাডবেরি কি বিভিন্ন সময়ে এই গল্পগুলো লিখেছিলেন? প্রতিটা গল্পের শেষে ফুটনোটে যদি তার উৎস এবং সময় সম্পর্কে হদিস দেওয়া থাকত, তাহলে, বইটা একটা ছোটখাটো রিসার্চ পেপার হয়ে যেত। কল্পবিশ্বের সম্পাদকেরা এ ব্যাপারে ভাববেন কি?

যন্ত্রসভ্যতার ওপর রে ব্র্যাডবেরির যে একটা তিক্ততা বোধ ছিল, সেটা ‘ফারেনহাইট ৪৫১’ উপন্যাসেই বোঝা যায়। এই উপন্যাসের শেষও ঠিক একইভাবে হচ্ছে। যন্ত্রসভ্যতার ভয়ঙ্কর পতনের সংকেতের মধ্যে দিয়ে। আগের উপন্যাসের থেকে এই উপন্যাসের পার্থক্য এই যে --- এক্ষেত্রে পুরো পৃথিবীটাকেই ধ্বংস করে দিয়েছেন তার লেখনীতে। মঙ্গলও মানুষের আগমনের সাথে সাথে সাথে ধ্বংসের মুখে চলে যাচ্ছিল। যে মঙ্গলগ্রহীরা, দেখা যাচ্ছে, মানুষের থেকে অনেক উন্নত, সেই মঙ্গলগ্রহীদেরই যখন ধ্বংস হতে হল মানুষেরই নিয়ে আসা একটা সামান্য রোগ থেকে, দেখা গেল, ব্র্যাডবেরির কলম আবার যন্ত্রসভ্যতার হিংস্র আঘাত থেকে মঙ্গলকে বিপন্মুক্ত করতে পারল না। পরিশেষে, পৃথিবী মৃত, মঙ্গল মৃত, কেবল একটি পরিবারের মধ্যে দিয়ে সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইলেন। কিন্তু মানুষের হিংস্র স্বভাব থেকে মুক্তির কোন উপায় বের করতে পারলেন কি? মনে হয় না পেরেছেন। কারণ, তিনি নিজেও তো একজন মানুষ। দিনের শেষে মানুষের ওপর থেকে পরিপূর্ণ বিশ্বাস হারানোর মতন পাপ করতে পারলেন না। যদিও, প্রকৃতির পরিপ্রেক্ষিতে, মানুষের চেয়ে হিংস্র পার্থিব প্রাণী আজ পর্যন্ত জন্মায়নি।

ব্র্যাডবেরি কবি। তার কিছু কিছু গল্পের মধ্যে এই কবিত্ব চরম পর্যায়ে পৌছেছে। যশোধরা রায়চৌধুরীও কবি। যোগ্য সঙ্গত করেছেন। ধ্বংসের কবিতা কেমন হতে পারে? ‘ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হবে’ শীর্ষক অনুচ্ছেদের গল্পটি এর চমৎকার উদাহরণ। পড়তে পড়তে শিউরে উঠি। এক ধ্বংস সভ্যতার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা একটি বাড়ীর একাকীত্বকে নিয়ে এমন লেখা! যাস্ট ভাবা যায় না।

হিংস্রতার কাব্যিক সুষমা? আছে। ‘তৃতীয় অভিযান’ শীর্ষক অনুচ্ছেদ। প্রসঙ্গত, এই গল্পটি সত্যজিৎ রায় অনুবাদ করেছিলেন ‘মঙ্গলই স্বর্গ’ নাম দিয়ে। যশোধরা রায়চৌধুরীর স্বকীয় অনুবাদ স্বতন্ত্রভাবে সত্যজিৎ রায়কে মনে করায় নি একবারও।

একাকীত্বের কবিতা? আছে তো। ‘মঙ্গলগ্রহী’। আর সবশেষে নিজের চিন্তাকে প্রকাশ করার কবিতা? যেখানে তিনি অনুভব করতে পারছেন মানব সভ্যতার ধ্বংসস্বরূপ যন্ত্রসভ্যতার ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা এবং নীচ মানসিকতার প্রভাব। তা কিভাবে ধ্বংস করতে পারে নিজেদেরকেই --- ‘এবং চাঁদের আলো এরকমই উজ্জ্বল দেখাবে’ নামক অনুচ্ছেদ। এমন আরোও অনেক দৃষ্টিভঙ্গীর মোড়কে অনুচ্ছেদের পর অনুচ্ছেদ জুড়ে তৈরী ৩০০ পৃষ্ঠার এই ‘ফিক্স আপ সায়েন্স ফিকশান’।

ব্র্যাডবেরি জৈবিক সভ্যতাকে কিভাবে দেখতেন? অনেকটা আলবেয়ার কামু’র মতো কি? তার ‘মিথ অফ সিসিফাস’-এর এক পর্যায়ের প্রশ্নই কি ব্র্যাডবেরির ‘তৃতীয় অভিযান’-এ নেই --- “আমরা যখন পৃথিবীতে ছিলাম, সেখানেও তো কেউ বলেনি আমাদের, কেন সেখানে ছিলাম আমরা। মানে, আমি ওই পৃথিবীটার কথা বলছি আর কি, বুঝেছ তো? যেখান থেকে তোমাদের আগমন! কেউ কি সত্যিই জানে, যে তার আগে আরও একটা পৃথিবী ছিল কি না আমাদের?” অর্থাৎ, আমাদের বেঁচে থাকার উদ্দেশ্য কি? কেন আছি আমরা? আমাদের অস্তিত্বের সার্থকতা কোথায়? আদৌ ‘সার্থকতা’ ব্যাপারটার কোন মানে আছে কি?

রে ব্র্যাডবেরি কি এর উত্তর পেয়েছিলেন? দিয়েছিলেন কি তার অন্য কোন লেখায়??

================================= 

মঙ্গল গ্রহের ডায়েরি

রে ব্র্যাডবেরি

ভাষান্তরঃ যশোধরা রায়চৌধুরী

কল্পবিশ্ব পাবলিকেশান

মুদ্রিত মূল্যঃ ৩৫০ টাকা

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ সমর্পিতা

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে