আয় ব্যাটা তুই চড়বি আমার হিরো সাইকেলে

 



জীবনে নিজের সম্পত্তি ঠিকঠাক রাখতে গেলে কত যে কান্ড করতে হয় তার ইয়াত্তা নেই। বড়ো বড়ো নেতারা সুইস ব্যাঙ্কে কিম্বা বন্ধুনীর বাড়ীতে টাকা রেখেও যেখানে ছাড় পান না সেখানে আমি তো এক অবলা মেয়েমানুষ। আমার দুঃখের কথা আর কি-ই বা বলি। কিন্তু তা বলে কি উঠেপড়ে লাগব না? নিশ্চই লাগব।

          এই যেমন আমার সাইকেল। যেটাতে করে আমি বাজারে যাই, মাঠে-ঘাটে-হাটে-পথে চড়ে বেড়াই, সেই বাংলা ‘হিরো’ সাইকেলটার কথাই ধরুন না কেন। নীল লেডিজ সাইকেল। সুন্দর দেখতে। সামনে খাঁচা। পেছনে ক্যারিয়ার। নাম দিয়েছি --- সবেধন নীলমণি। এই সবেধন নীলমণিতে মাঝে মাঝে হতভাগাকেও ক্যারিয়ারে বসিয়ে তেপান্তরের মাঠে নিয়ে গিয়ে পিরীত করেছি। তার কোমরে টনটন করেছে রাস্তার সস্তা অবস্থার কারণে, কিন্তু আমার সাইকেল যেমন শক্ত, তেমনই পোক্ত রয়ে গেছে।

মাঝে মাঝেই আমার সাইকেলটা পরের হস্তগত হয়ে যায়। কেউ যদি জিজ্ঞাসা করেন, ওরে! ভাই কি তোর পর? আমি বলব, মোটেই না। কিন্তু ভাই তো আমার শাড়ী-সালোয়ারে হাত দেয় না, কিম্বা লিপস্টিক-নেলপালিশে। তাহলে আমার সাইকেলেই বা হাত দেবে কেন? বেরোতে গিয়ে যদি দেখি, ভাই নেই, কিন্তু ভাইয়ের বাইকটা আছে, তাহলে আমি নিশ্চিত জানি আমার সবেধন নীলমণিটি খোয়া গেছে, এবং আমাকে এখন পদব্রজে অন্তত আধাঘন্টা হেঁটে, কিম্বা অর্থ খরচ করে টোটোয় করে যাত্রা করতে হবে। এমন যাত্রায় সুখ নাস্তি। ভাইয়ের সাথে এই নিয়ে লড়াই করতে গেলে ভাইয়ের সপাট জবাব, বেশ তো, আমার বাইকটা নিয়ে তুই বেরো না হয়।

মেয়েমানুষের সুখ মেয়েমানুষ সহ্য করতে পারে না। মা’র কাছে ভাইয়ের নামে নালিশ করেছি, বদলে মুড ভালো থাকলে টোটোর টাকা, মুড ভালো না থাকলে ঝাঁটার বাড়ি কিম্বা কথার ঝাড়ি খেয়ে অসন্মানে বিদায় নিয়েছি। অতঃপর ভেবেচিন্তে মোক্ষম সমাধান পেয়েছি।

 

এবং যেদিন সমাধান তার পরদিন সকালে পাড়া মাথায় করা চীৎকার।

“দিদি...ই...ই...ই...ই...ই...ই...ই..., অ্যাই দি... এটা তুই কি করেছিস...!!!”

আমি সদ্য ঘুম থেকে উঠে ব্যালকানীতে বসে পেপারের পাতা উলাটাচ্ছিলাম। হাতে কফি। জানি এমন একটা আওয়াজ আসবে, তবুও কফি চলকে পেপারে পড়ল। মেসির এক্কেবারে মাথার ওপর। বিশ্বকাপ সমেত মেসি ভিজতে লাগল। এমন অকাল বর্ষণ চোখে দেখা যায় না।

“কি হল রে?” এটা মায়ের গলা। ত্রস্তা হরিণী আগেভাগেই মঞ্চে নেমে গেছে। এমন বাঁজখাই আওয়াজের জন্যে তিনি প্রস্তুত ছিলেন না। গৃহযুদ্ধ তিনি না হলে ঠেকাবেন কে? আড়চোখে দেখলাম, হাতে ঝাটা, কিম্বা খুন্তি, নিদেনপক্ষে বেলন চাকী নেই। ব্বাবাঃ! ফাঁড়া নেই...

“দ্যাখো, তোমার মেয়ের কান্ড দেখো। এইটা কি করেছে। এইটা কি? এমনভাবে সাইকেলটা নষ্ট করে? আমি এখন ডাব্বুর বাড়ী যাব কি করে?”

অ...! এই তাহলে ব্যাপার। আমি না জেনেশুনেই মড়ার ওপর খাড়ার ঘা বসিয়ে দিয়েছি। এই সাতসকালে উনি ডাব্বুর দিদিকে নিয়ে হাওয়া খেতে বেরোবেন! ডাব্বুর দিদি টিক্কি। ভাইয়ের প্রেমময়ী। ছোটবেলা থেকে লম্বা চুল হোক, কিম্বা বেটে চুল, টিক্কির মতো করে বেণী বানিয়ে ঘুরে বেড়াতো। প্রথমে নাম হল ‘ঘোড়ার ল্যাজ’, পরবর্তীকালে চুল একবার ছোট করার কারণে নাম হয়েছে ‘টিক্কি’। এখন চুল বড়ো হয়েছে বটে, নাম ঘোচেনি। তো এই টিক্কিকে নিয়ে এই সাতসকালে সাইকেল করে পাড়া বেড়াতে বেরোবেন বাবু। শখ কত!

বাবা চলে এসেছে। মা চলে এসেছে। আমি ধীরে-সুস্থে কফি হাতে নীচে নামলাম। হাতে কফির মগ থাকলে খানিকটা স্বস্তি। কফির মগ চীনেমাটির। মা তেড়ে এলে যদি মগটা কফিসমেত ফেলে দিই মেঝেতে, সমাধানের একটা সমস্যা হাজির হবে। মা নিশ্চই সেটা হতে দিতে চান না।

“কি হয়েছে?” আমি জিজ্ঞাসা করি সরলমনে।

“এটা তুই কি করেছিস? এখন আমি এই সাইকেল নিয়ে বেরোই কি করে? এটা তুই কি লাগিয়েছিস?????”

“কেন? প্যাডেল?”

“এটা প্যাডেল?”

“এটা প্যাডেল না? এটাকে তাহলে কি বলে?”

“আরে এটা কি সাইকেলের প্যাডেল?”

আমি কিছু বললাম না। জানি ওটা সাইকেলের প্যাডেল না। রিকশার প্যাডেল। কাঠের। বড়ো। এবং শক্ত। এবং ভাইয়ের ক্ষেত্রে তা মান-সন্মান হারানোর জন্যে যথেষ্ট। মনে পড়ে গেল ডেনড্রাইটের মুখটাও...

 

ডেনড্রাইটের সাইকেলের দোকান আমাদের এলাকার বিখ্যাত দোকান। বাপ-পিতেমোর দোকান ষোলো বছরের ডেনড্রাইট এখন চালায়। সে যখন ফেল করে, এবং না করে করে ক্লাস নাইনে এসে পৌছেছে, তখন তার বাবা মারা গেল। করোনার থাবা ইকোনমিকাল গ্রাউন্ড বোঝে না। ডেনড্রাইট স্কুল ছাড়ল। বাবার দোকানটা ধরল। ডেনড্রাইট খেয়ে নেশা করা ধরল। এই নেশাখোড় ছেলেটির সাইকেল সারানোর হাত তুখোড়। আমি সাইকেল সারাতে এলাম, কারন, ভাই তার টিক্কিকে নিয়ে সাইকেল চালতে গিয়ে একটা প্যাডেলের সত্যানাশ করে দিয়েছে।

ডেনড্রাইট তার বাবার দোকানের গোডাউন থেকে সাইকেলের প্যাডেল বের করতে করতে বলল, “ভালো প্যাডেল লাগাই দিচ্চি, দামডা এড্ডু বেসি পড়বে।”

আমার চোখ তখন বাক্সের ওপাশে।

“ওটা কি রে?”

“ওডা তো রিকশার প্যাডেল। বুড়োদাদু রিকশা চালাত না, তার প্যাডেল।”

“ওটা সাইকেলে লাগানো যাবে?”

“হ্যাঃ দিদি! তুমি যে কি বলো। ওডা রিকশার প্যাডেল গো!”

“তুই লাগাবি কি না বল?”

“তোমার কি মাথায় ক্যারা সান্দাইচে?”

“হ সান্দাইচে। তুই লাগা এটাকে। আর শোন, আরেকটা প্যাডেল যেটা আছে সেটাই থাক।”

ডেনড্রাইট হতবুদ্ধি হয়ে একটা কথাই বলল, “লোকে কয় তোমার মাতার নাটবল্টুক ঢিল্যা আচে, ঠিকই কয়।”

“তুই লাগা বলছি, নাহলে তোর মাথার বল্টু ঢিলা করে দেব রামগাট্টা মেরে।”

 

ডেনড্রাইট কোন টাকা নেয় নি এমন কাজ করার জন্য, কেবল বলেছে, মি যেন তার দোকানের নাম না করি তার প্রেস্টিজ আজকে এমন ফুটো হল, তাপ্পি মেরেও সারানো যাবে না। এরপর দোকানে লোক না কমে যায়। আমি কথা দিয়েছি। রাখতে পারলাম না।

এমন বুদ্ধির সুফল আজ হাতেনাতে পাচ্ছি। ভাই পাগলের মতো লাফাচ্ছে। মায়ের চক্ষু চড়কগাছ। ভাই বলছে, “আমি এখনি পালটে আনছি

“খবরদার! এটা আমার সাইকেল। যা খুশি করব। তুই যদি পাল্টাস তাহলে রোজ রাতে আমি তোর বাইকের হাওয়া ছেড়ে দেব। রোজ সকালে তোকে হাটিয়ে হাটিয়ে ডেনড্রাইটের দোকানে যেতে হবে হাওয়া ভরাতে।”

 

অতঃপর, দিন ভালোই চলছে। ভাই আর সাইকেলে হাত দিচ্ছে না। এমনকি আমার হতভাগাটা পর্যন্ত দেখা করতে যাওয়ার আগে খোঁজ নিচ্ছে আমি তার বাইকে বসব, না কি আমার সবেধন নীলমণীতে চড়ে আসব।

 

==========================

 

[বিঃ দ্রঃ ছবিটা এঁকেছে সমর্পিতা। এটা তার প্রথম ক্যারিক্যাচার। আমায় বলেছে, এরকম লিখলে আরও ক্যারিক্যাচার বানাবে।]

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে