বাটখারার মাঠ, তেপান্তরের মাঠ
লোকে বলে বাটখারার মাঠ, আমি বলি তেপান্তরের মাঠ।
এর মাঝখানে দাঁড়ালে, যতদূর চোখ
যায়, মনে করুন চৈত্রের দুপুরে, দেখবেন ধু ধু করা এক মাঠ। একচিলতে ছায়া মেলা ভার।
মাটি থেকে ওঠা ভাপে তখন মরিচীকা দেখা যায় চারদিকেই। মনে হয় যেন মাঠ আর মাঠ নেই, সে
যেন জলের মধ্যে জেগে থাকা দ্বীপ। আর দেখা যায়, কপাল ভাল থাকলে, আলপথের আবডালে
বাটখারাদের।
প্রধানত দুই রকমের বাটাখারা আছে --- গোখরো আর চন্দ্রবোড়া। কয়লা ওজন করতে
বড়ো বড়ো বাটখারা যেমন হয়, তেমনভাবেই কুন্ডলী পাকিয়ে এরা পড়ে থাকে। মেঠো ইঁদুরের
যম। এবং মানুষের। এই মাঠের মাঝখানে যদি গোখরো চুমু দেয়, মাঠ পেরিয়ে বড়ো রাস্তায়
আসার আগেই অনেকের ভবলীলা সাঙ্গ হয়েছে এমন উদাহরণ বিস্তর। কত মানুষ, গোরু, ছাগল,
কুকুর, শেয়াল যে মাঠের মাঝেই পড়ে মারা গেছে, দিনের শেষে খোঁজপার্টি না বেরোলে
জানার যো থাকে নেই।
চন্দ্রবোড়ার ছোবলে মৃত্যু বড়ো করুন।
আস্তে ধীরে বিষ ছড়ানোর যন্ত্রনায় কাতরাতে কাতরাতে প্রায় প্রতি বছরই কেউ না কেউ
মারা গেছে। তেপান্তরের মাঠের আশেপাশের গ্রামে সাপের কামড়ে মৃত্যুর সংখ্যা
তুলনামূলক অনেক বেশি।
তবে বেশিরভাগ সাপ বড়ো ভাল। মানুষ
কাছে এলে ফোঁসফাঁস আওয়াজে জানান দেয় যে তেনারা আছেন। কান খাড়া রাখলে ছোবল এড়ানো
যায়, আমি বেশ কয়েকবার ফিরে এসেছি, মৃত্যুমুখ থেকে।
তবুও
কেন যাই? তেপান্তরের মাঠে আমাদের মত অনেক ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমী যায়। তারা যায় মৃত্যুর
সাথে পিরীত করতে। যার হৃদয়ে রয়েছে মারণ উচাটন, তার কি কালনাগিনীর ছোবলের ভয় সাজে?
হাতে হাত ধরে আলপথ ধরে খোলা মাঠে হারিয়ে যেতে কার না হৃদয় ব্যাকুল হয়? বৈশাখের
ধানকাটা মাঠে বিকালে নাচুনে পাখীর ঝাঁকের মাঝে, কিম্বা শীতে সরষে ক্ষেতের নাকছাবি
হারানোর সুখ কে এড়াতে চায়? সে সুখ লুটেপুটে নিই কিশোরীর আম-কাসুন্দির আয়েসের মত
করে।
আর কি
কোন ভয় নেই? আছে। পাটের ক্ষেতে মাঝে মাঝে পাওয়া যায় কিশোরীর রক্তাক্ত ধর্ষিত লাশ। ঝোপের
আড়ালে মেলে বিষাক্ত চক্রান্তে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাওয়া নীল শরীর। মুরগীর পালক গড়াগড়ি
খায় পরিত্যক্ত মদের শিশি, গাজার কলকে, সিগারেটের ফিল্টার কিম্বা বাংলার প্যাকেট
ঘিরে ঘিরে। আর পড়ে থাকে মাঠ, আর আকাশ। পরস্পরের দিকে মুখোমুখি হয়ে।
এমনটাই হয়ে চলেছে। এমনটাই হয়ে
চলবে।
Comments
Post a Comment