শুভ্রঃ হুমায়ূন আহমেদের আখরকথাঃ শেষ পর্ব

 



হুমায়ূন আহমেদকে ধন্যবাদ। কারণ, যে হুমায়ূনকে আমি দেখতে অভ্যস্ত, একেবারে সেই হুমায়ূন স্বমহিমায় বিদ্যমান এই উপন্যাসে। উপন্যাসের নাম ‘শুভ্র গেছে বনে’। এবং, এই প্রথম, মনে হচ্ছিল, শুভ্রকে হুমায়ূন তৈরী করে নি, শুভ্র হুমায়ূনকে এগিয়ে নিয়ে গেছে আপন ছন্দে। এই উপন্যাসের প্রথম থেকে সব চরিত্রকেই মনে হচ্ছে জীবন্ত, আনপ্রেডিক্টেবল এবং হুমায়ূনোচিত।

সম্ভবত, ২০০৩ সালে যখন ‘এই শুভ্র এই’ উপন্যাস শেষ করেন, তখনই বুঝতে পারেন, এভাবে কোন শুদ্ধতম মানুষ সৃষ্টি করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। এ তার কাজ নয়। তারপর মনে হয় তিনি শুভ্রকে নিয়ে লেখার কথাই ভুলে গেছেন। তার আরেকটা কারণ হতে পারে, ‘হিমু’ এবং ‘মিসীর আলী’ সাহেবের তুমুল জনপ্রিয়তা। বিশেষ করে হিমু একটা কাল্ট সৃষ্টি হয়ে দাঁড়িয়েছে ততদিনে। আর শুভ্র তেমন করে পাঠকমানসে জমাট বাধতে অক্ষম।

ফলে, সাত বছর পর, ২০১০ সালে শুভ্র যখন আবার বের হয়ে এল তার কলম থেকে, তখন সেটা এল কোনরকম কোন এক্সপেক্টেশান ছাড়াই। সাত বছর! এবং, এই উপন্যাসের মুখবন্ধে হুমায়ূন লিখছেন, “শুভ্রর মতো কাউকে কি আমি চিনি, যাকে এই বই উৎসর্গ করা যায়? না, চিনি না। প্রকৃতি শুদ্ধতম মানুষ তৈরী করে না। কিছু-না-কিছু খাদ ঢুকিয়ে দেয়।

এই খাদ-ওয়ালা শুভ্র বরং শুদ্ধতম মানুষে পরিণত হয়েছে। পুরোপুরি অবশ্যই নয়, তবে অনেকটাই। এই শুভ্র অনেক বেশি স্মার্ট, অনেক বেশি সাহসী। আগের উপন্যাসগুলো পড়তে পড়তে আমার কোথাও মনে হয়েছিল শুভ্র সাহসী নয়। প্রতিকূল পরিস্থিতি তাকে সাহসী হতে বাধ্য করত বটে, কিন্তু ‘জাতসাহসী’ সে কোনকালেই ছিল না। সেখানে সে অনেকটাই সতর্ক। এই অহেতুক সতর্কতা শুভ্রের একটা দুর্বলতা। যে কারণে জাহানারা, এখানে যিনি আবার রেহানা, তাকে ভয় পাওয়ার কোন কারণ দেখে নি শুভ্র। তার একটা বড়ো কারণ হতে পারে, এই উপন্যাসে শুভ্র তার জন্মঘটিত সমস্যার মধ্যেই নেই। এ নিয়ে লেখক মাথা ঘামাননি। আর মাথা ঘামাননি বলেই ‘শুভ্রর চর’ তৈরী করতে পেরেছেন। একজন বেশ্যার সাথে সে ঘর করছে ভাই-বোনের পরিপ্রেক্ষিতে। সে অনায়াসেই একদম অচেনা একটি মেয়ের জন্মদিনে বসে মজা দেখতে পারার ক্ষমতা রাখে। সে অনায়াসেই মৃত্যুর সামনে বসে যুথীকে চিঠি লেখার ক্ষমতা রাখে। এই স্থিতপ্রজ্ঞতা শুদ্ধতম মানুষ হওয়ার একটা বড়ো শর্ত। আগের উপন্যাসগুলোতে লেখক সেটা ভুলে গিয়েছিলেন। এখানে তার অবচেতনেই এটা প্রকট হয়ে উঠেছে।

হুমায়ূন জীবিত নেই। এ আমাদের দুর্ভাগ্য। তিনি জীবিত থাকলে আমি হয়তো চেষ্টা করতাম তার সাথে এ বিষয়ে আলোচনা করার। আমি কি ঠিক বলছি? আর যদি ঠিক বলেই থাকি, তাহলে অনায়াসে বলতে পারি, হুমায়ূনের সবচেয়ে বড়ো ভুল, শুভ্রকে নিয়ে নিয়মিত লেখালেখি না করা। কারণ, শুভ্র সত্যিকারের শুভ্র হয়ে উঠতে পেরেছে একমাত্র এই উপন্যাসেই। দুঃখের ব্যাপার, এই উপন্যাসই তার শেষ শুভ্র উপন্যাস।

এই উপন্যাস লেখার পর আরও বারো বছর তিনি আমাদের সাথে ছিলেন। অন্তত আরোও হাফ ডজন শুভ্র যদি আসতো, হয়তো, শুভ্র আরও পরিণত হত। বরং এমন একটা চরিত্র বাংলা সাহিত্যে তৈরী হতে পারত, যে চরিত্রকে নকল করা প্রায় অসম্ভব হত। আমি অত্যন্ত কুন্ঠার সাথে জানাচ্ছি, অনেক প্রথিতযশা সাহিত্যিক হিমুকে তাদের লেখার অঙ্গ করেছেন, মিসীর আলিকেও। কিন্তু শুভ্রকে নয়। অন্তত শুভ্রকে নকল করতে গেলে যে পরিমাণ শুদ্ধতার বোধ থাকা দরকার, তা খুব কম লেখকের আছে। কপি করা আর পুণরায় সৃষ্টি করা যে এক নয়, তা যে কেউ এই চরিত্রটাকে স্টাডি করে লিখতে গেলেই বুঝতে পারবেন।

হুমায়ূন সাহেব জানেন না, তিনি নিজের অজ্ঞাতসারেই তার উদ্দেশ্য সাধনের দিকে এগিয়েছিলেন, সেই মুহূর্তেই এগিয়েছিলেন, যে মুহূর্তে তিনি আশাহত হয়ে লিখতে শুরু করেছিলেন। শুদ্ধতম মানুষ তখনই সৃষ্টি করা যায়, যখন শুদ্ধতম মানুষের চরিত্র সৃষ্টি করার ইচ্ছাটাই থাকে না। এর এখানেই ‘শুভ্র গেছে বনে’, আমার মতে, সর্বশ্রেষ্ঠ ‘শুভ্র উপন্যাস’।

 

==================================

শুভ্র গেছে বনে

শুভ্র সমগ্র

হুমায়ূন আহমেদ

অনন্যা প্রকাশনী

মুদ্রিত মূল্যঃ ৬০০ টাকা

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ সমর্পিতা

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে