শুভ্রঃ হুমায়ূন আহমেদের আখরকথাঃ চতুর্থ পর্ব
‘শুভ্র’ উপন্যাসের তিন বছর পর,
২০০৩ সালে প্রকাশিত হয় ‘এই শুভ্র এই’। এবং, বলা ভাল, এই প্রথম আমি শুভ্র উপন্যাসকে
এক ছিমছাম মেদবর্জিত, বাহুল্যবর্জিত রূপে দেখতে পাচ্ছি। হুমায়ূন তার লেখকসত্ত্বার
চরম উচ্চতা থেকে লিখছেন। এবং এই প্রথম তার শুভ্র সিরিজের সব চরিত্রগুলোই হেটে-চলে
বেড়াচ্ছে।
এখানে শুভ্রর বাবা অনেক বেশি
খোলামেলা। লাইট এন্ড ডার্কনেসের শেড অনেক বেশি বিদ্যমান। শক্তের ভক্ত, নরমের যম
টাইপের। এমন মানুষটি পরিবারের অন্দরমহলে সবার সাথেই বেশ কমিউনিকেট করে চলেন।
পরিবারের একজন কর্তামানুষ যেমন হয় আর কি। এখনও পর্যন্ত যে চরিত্র প্রথম থেকেই
প্রাউ একই রকম গহীন ও জটিল চরিত্রে অবস্থান করছে, তিনি হলেন জাহানারা, শুভ্রর মা।
আগের উপন্যাসগুলোর মতো এই উপন্যাসেও তাকে চিনতে একটুও ভুল হয় না। বরং যে ধরনের কাজ
তিনি করে চলেছেন, সেটা তারই সাজে। আমার মনে হয় বিনুর চরিত্রের খানিক অংশ এখানে
সকিনা এবং মিতুর চরিত্রের খানিকটা রুনুর মধ্যে দিয়ে চলে এসেছে এই উপন্যাসে।
মূল গল্প প্রায় একই। রূপবান যুবক।
মেধাবী ও বুদ্ধিমান যুবক। অজাতশত্রু যুবক। প্রায় অন্ধ হতে চলা যুবক। কখনও কখনও
আনপ্রেডিক্টেবল এবং সবশেষে আবিস্কার হয়, মানে যুবকটি নিজেই আবিস্কার করেন সে
প্রকৃতই এই পরিবারের কেউ নয়। উপন্যাস শেষ হয়। তবে এবারের শুভ্রের সামাজিক
অবস্থানের পরিবর্তন হয়েছে। মানে, সে খানিকটা উন্নত। সে কম্পপিউটার চলাতে পারে,
সফটওয়ার বানাতে পারে, আত্রলিতা নামক এক বিদেশিনীর সাথে চ্যাট করে।
হুমায়ূন তার শুভ্রকে এক ভয়ানক ধনী
পরিবারের মধ্যে রেখেও তাকে সেই পরিবারের সদস্য করেন নি। অথচ পরিবার তাকে
অতিমাত্রায় স্নেহ ভালোবাসা দিয়েছে। এমনকি পরিবারের বাইরের লোকজনও। তার প্রতি বিরূপ
মানুষ দেখা যাচ্ছে না। কোথাও কি তথাগত বুদ্ধের প্রাথমিক পরিচয়ের ধাপ? যে নিজেকে
আস্তে আস্তে সমাজের বাইরে থেকেও সমাজের প্রতি মমত্ববোধ রাখছেন পুরো মাত্রায়? এবং
তার বড়ো কারণ পরিবারের সাথের মূল সূত্রটি ছিন্ন করে দিচ্ছেন? দেখা যাক---
১। “তার কোন খোলস নেই” --- অর্থাৎ ব্যক্তিগত
ব্যাপারটাই সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এমন এক মানুষ শুভ্র, যে জানে না নিজেকে প্রয়োজনে
খোলসের ভেতর রাখতে।
২। “ছেলেকে তিনি বুঝতে পারেন না” --- কখনও কখনও
শুভ্র একটু আনপ্রেডিক্টেবল।
৩। “শুভ্র অন্যদের মতো না” --- শুভ্র সকলের থেকে
আলাদা। আলাদা অর্থে সাধারণ মানুষের মধ্যে যে দোটানার দ্যোতনা থাকে, শুভ্রের
ক্ষেত্রে তা খানিকটা অন্যরকম। যেন সমুদ্রের মতো। ভেতরের চোরাস্রোত চট করে বাইরে
ধরা পড়ে না।
৪। “পৃথিবীর জটিলতা সে কিছুই জানে না।” --- অহেতুক
জটিলতা থেকে শুভ্র অনেক দূরের মানুষ।
৫। “শুভ্র চালাকি ধরতে পারে না।” --- ধূর্ততা
ব্যপারটা শুভ্রর ধারণার মধ্যেই নেই। সে যদিও ধুর্ত নয় তবুও ধুর্ততা তাকে পেড়ে
ফেলতে পারে না।
৬। “শুধু যে দেখতে সুন্দর তা নয়। চেহারার মধ্যে
মায়া মায়া ভাব। যে অসম্ভব রূপবান একজন যুবক বাল্ক বালক চেহারা নিয়ে বসে আছে।” ---
শুভ্রর রূপ শুরু থেকেই একটা বড়ো ফ্যাক্টর। আগের উপন্যাসে বিনু হোক, কিম্বা এই
উপন্যাসে মজনু, রুনু --- প্রত্যেকেই শুভ্রর রূপে মুগ্ধ। আর এই মুগ্ধতা এক স্বর্গীয়
মুগ্ধতা। যেখানে শুভ্র প্রতি কোন ক্ষোভ থাকে না।
৭। “নেত্রকোনার ভাষায় এই হাসির নাম --- অন্তরি
হাসি। অন্তর থেকে যে হাসি আসে সেই হাসি।” --- হাসি একটা মানুষের জাত চিনিয়ে দেয়।
যার অন্তর নির্মল, তার হাসি নির্মল। আগের উপন্যাসগুলোতে কি এই বৈশিষ্ট্য তেমনভাবে
এসেছে? মনে পড়ছে না।
৮। “যে আমাকে যে-রকম দেখতে চায়, আমি তার কাছে
সে-রকম থাকি” --- সবথেকে সাংঘাতিক ডায়ালগ, শুভ্রর মুখ দিয়ে বেরিয়ে এসেছে। আমরা
পুরাণে কিম্বা ভগবান বিশেষ করে কৃষ্ণের বর্ননায় এমন কথার আভাস পেয়েছি। এই একটা
কতাহি একেবারে মানুষ থেকে তাকে একধাপ ওপরে তুলে নিয়ে যায়, শুদ্ধতম মানুষের
নির্মানের আরেক সোপান।
৯। “আমার অনেক বুদ্ধি” --- এ শুভ্রের বোধ। এবং
সত্যবোধ।
১০। একদম শেষে এসে সে বলে --- “মানুষের প্রতি আমার
মমতা যে কি পরিমাণ বেড়েছে সেটা আমি জানি।” এই একটা জায়গায় এসে সে সবার থেকে আলাদা
হয়ে গেল। যে জন আছে মাঝখানে – সে-ই শুভ্র। সে-ই কি শুদ্ধতম মানুষ?
হুমায়ূন জানেন। আমি শেষ উপন্যাসের
জন্য অপেক্ষায় আছি।
======================
এই শুভ্র এই (শুভ্র সমগ্র)
হুমায়ূন আহমেদ
অনন্যা প্রকাশনী
মুদ্রিত মুল্যঃ ৬০০ টাকা
ছবি কৃতজ্ঞতাঃ সমর্পিতা
Comments
Post a Comment