শুভ্রঃ হুমায়ূন আহমেদের আখরকথাঃ তৃতীয় পর্ব



শুভ্র সিরিজের সবথেকে বড়ো উপন্যাস – শুভ্র। শুভ্র সমগ্রের নিরিখে ২২১ পাতার এক সুবৃহৎ আখ্যান। অর্থাৎ, হুমায়ূন আহমেদ শুভ্রকে নিয়ে রীতিমতো আদাজল খেয়ে লিখতে বসেছেন এই উপন্যাস। এই সময়ে তাকে যেন প্রতিপন্ন করতেই হবে শুভ্র একজন শুদ্ধ মানুষ। নচেৎ এতবড়ো উপন্যাস লেখার মানুষ উনি নন। সুবৃহৎ উপন্যাস লেখার স্টাইল ওনার নয়। বেশ কয়েকটি উপন্যাস লিখেছেন যদিও। কিন্তু, যে মানুষ জানেন, কীভাবে অল্প সময়ে, গুছিয়ে আসল কথাগুলো বলে ফেলা যায়, সেই মানুষ এত বেশি পাতা নেবেন না।

এই উপন্যাসে এসে শুভ্রর বাবার নাম মোতাহার সাহেব (আগের উপন্যাসগুলিতে নাম ছিল ইয়াজউদ্দিন) এবং মায়ের নাম জাহানারা (আগের উপন্যাসগুলিতে নাম ছিল রেহানা)। মোতাহার সাহেবের চারিত্রিক গঠনের একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। দ্বারুচিনি দ্বীপ, রূপালী দ্বীপের ইয়াজউদ্দিনের সাথে কিন্তু মোতাহার সাহেবের অমিল আছে, মূলত তার পেশায়। এবং এই পেশাগত কারণেই কোথাও তার চরিত্রের দৃঢ়তা নষ্ট হয়েছে অনেকটাই। এমনকি ‘মেঘের ছায়া’ উপন্যাসের থেকেও কোথাও এই উপন্যাসে এসে শুভ্রর বাবাকে বেশ দুর্বল লাগে। তুলনায় জাহানারা একই রকমের রয়ে গেছেন। বরং জাহানারার শুভ্রকে নিয়ে যে উদগ্র আত্মকেন্দ্রিকতা, যার আভাস আগের তিনটে উপন্যাসে ছিল, এই উপন্যাসে সেটা চূড়ান্ত রূপ পেয়েছে। এমনকি শুভ্রকে পর্যন্ত জাহানারার বিরুদ্ধাচরণ করতে বাধ্য করেছে।

বড়ো উপন্যাস কোথাও হুমায়ুনের দুর্বলতাকে প্রকট করে দেয়। মিতু এই উপন্যাসের সবচেয়ে দুর্বল জায়গা। কোন প্রয়োজন ছিল না অহেতুক মিতুকে নিয়ে এতটা টানাটানি করা। উপন্যাসের কোন অংশেই মিতুকে মনে হয় নি প্রয়োজনীয়। বরং দ্বিতীয় অর্ধে আসমানী শুভ্রর অস্তিত্বের এক ভয়ঙ্কর দ্বন্দ্ব হিসাবে চমৎকারভাবে ফুটে ওঠে। যে দ্বন্দ্বের মাঝখানে শুভ্রর কোন একটা সময়ে নিজের ব্যালান্সড রাখাটা বড়ো রকমের চ্যালেঞ্জ হয়ে পড়ে।

জাহানার-মিতু-আসমানীর পর এই উপন্যাসের চতুর্থ নারীচরিত্র বিনু, এই বিনু চরিত্রটি প্রথম থেকেই শুভ্রর সঙ্গে সঙ্গে ফল্গুধারার মতো এগিয়েছে। এবং কখন যে শুভ্রর কাউন্টার পার্ট হয়ে ওঠে তা পাঠকেরও মনে থাকে না। হুমায়ূন অহেতুক বিনু এবং তার বাবার ট্রেনযাত্রার প্রসঙ্গকে টেনে নিয়ে না গেলে ‘বিনু’ চরিত্র আরও ধোঁয়াশায় থাকত, এবং তার আবার ফিরে আসাটার মধ্যে যে চমক থাকত, সেটা যথাযথ হত। হুমায়ূনের ওই কয়েকটা পাতা খরচ করার সাথে সাথেই পাঠকমাত্রই পরিস্কার বুঝে যাবে যে বিনুকে আবার ফিরতেই হবে, এবং, এই বিনুই হতে চলেছে মূল উপন্যাসের কান্ডারী। আসমানী তখন বিদ্যমান ছিল বটে, কিন্তু মিতু আর আসমানীর মাঝে আড়াল করে রাখা বিনু নামক তুরুপের তাসটিকে হুমায়ূন আরও পরে খেলতে পারতেন অনায়াসেই, সেটা মাঝামাঝি সময়ে খেলে দিয়ে উপন্যাসের সাযুজ্য অনেকটাই মাটি করে দিলেন।

এবং প্রত্যাশিতভাবেই, এই বিনুর মধ্যে দিয়েই শুভ্রর আসল প্রকৃতিটাকে বর্ননা করেছেন। কেমন সেই চরিত্র?

১। “শুভ্র নামের মানুষটা সরল প্রকৃতির” --- শুভ্র মনের ভেতর কিছুই রাখে না। অর্থাৎ, সে আগাগোড়া সত্যে প্রতিষ্ঠিত। তার গোপনীয়তা থাকে ব্যক্ততার মধ্যে। এইখানেই হুমায়ূন অসামান্য। মানুষের গোপন প্রকৃতি যদি সকলের সামনেই উজাড় করে রাখা থাকে তাহলে সেই মানুষটি যে আসলেই ‘স্বচ্ছ ও সহজ’ – সাহিত্যের মধ্যে দিয়ে এ তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করতে গেলে একটা হুমায়ূন আহমেদ প্রয়োজন।

২। “শুভ্র বিভ্রান্ত না।” --- পুরো উপন্যাসের অনেক জায়গায় শুভ্রকে বিভ্রান্ত মনে হয়। কিন্তু আসলেই সে বিভ্রান্ত নয়। সে অপেক্ষায় আছে। কীসের অপেক্ষা? যে রহস্য তার সামনে উন্মোচিত হয় নি, তার উন্মোচনের অপেক্ষা।

৩। “কেউ যেন তাঁর সম্পর্কে পরিস্কার কোনো ধারণা না পায় এই জন্যেই তিনি অদ্ভুত ব্যবহারগুলি করেন।” --- শুভ্র যেহেতু পরিস্কার, ফলে তাকে বিচার করতে গেলে সরাসরিই করতে হবে। জটিলতার মধ্যে তাকে পাওয়া যাবে না। আশেপাশের মানুষ যে জটিল আবর্তে ঘুরছে তাদের কাছে শুভ্র হয় বোকা, নয় অপ্রত্যাশিত।

৪। “মাঝে মাঝে মনে হয় তিনি প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করছেন।” --- এই একটা জায়গায় বিনু ভুল করেছে। নিজের আসল পরিচয় জানতে চাওয়ার অমোঘ আকর্ষণ তাকে কোথাও নিষ্ঠুর হতেই হয়েছে। না হলে তার পক্ষে রহস্যের কিনারায় পৌছনো সম্ভব হত না। হয়তো উপন্যাসের সাপেক্ষে বিনুর এই সিদ্ধান্ত স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু শুভ্রের আসল চরিত্রের সাথে এমনটা সিদ্ধান্ত হিসাবে বেমানান।

 

সব মিলিয়ে হুমায়ূনের শুভ্রকে ‘শুভ্র’ উপন্যাসে আমরা এইভাবেই পাই। তবে এই উপন্যাসটির আকার ও আয়তন বড়ো হওয়ার কারণে অনেকটাই দুর্বল হয়ে গেছে। কিছু কিছু সময়ে যথেষ্ট হতাশ করে, বিরক্তই করে, যা হুমায়ূনের স্টাইলের পরিপন্থী।

 

=====================================

শুভ্র

হুমায়ূন আহমেদ

মূল গ্রন্থঃ শুভ্র সমগ্র

অনন্যা প্রকাশনী

মুদ্রিত মূল্যঃ ৬০০ টাকা

 


Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে